সিএনজি অটোরিকশায় রাজধানীর মগবাজার থেকে মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটের সামনে নামলেন মো. ইকবাল হোসেন। একটি বেসরকারি কোম্পানিতে কাজ করেন তিনি। মিটারে নয়, চুক্তিতে ২শ’ টাকা ভাড়া দিয়েছেন। শুধু ইকবাল হোসেনের মতো নগরবাসীর প্রত্যেকেই অটোরিকশাচালকের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছেন। ব্যস্ততা ও জরুরি কাজের প্রয়োজনে এক জায়গা থেকে আরেক স্থানে চলাফেরা করতে গিয়ে এভাবেই অসহায় নগরবাসীরা। ব্যাটারিচালিত রিকশার কারণে দৈনিক আয় হ্রাস পেয়েছে বলে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চালকরা। চুক্তিতে যাওয়ার বিষয়টি যাত্রীরা স্বীকার করেন না বলে পুলিশের অভিযোগ।
যাত্রীদের অভিযোগ, রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশার ভাড়া নিয়ে নৈরাজ্য চলছে। কিছুতেই শৃঙ্খলায় আনা যাচ্ছে না এই পরিবহনকে। মিটার দিয়ে সিএনজি চলাচলের নিয়ম থাকলেও কোনো চালকই মিটারে চলতে চায় না। ফলে যাত্রীরাও মিটারের কথা ভুলে গেছেন। এ সুযোগে সিএনজিচালিত অটোররিকশার মিটার যেন উধাও।
রাজধানীর সাতরাস্তা মোড় থেকে ১৯০ টাকা চুক্তিতে বিজয়নগর পানি ট্যাংকির সামনে সিএনজি অটোরিকশা থেকে নামলেন ফলমূলের ব্যবসায়ী মো. আবুল কাশেম। মিটারে, না চুক্তিতে- প্রশ্ন করতেই রেগে গেলেন অটোরিকশাচালক। তবে মো. আবুর কাশেম জানালেন, ‘চুক্তিতেই এসেছি ভাই। নগরীর কোনো চালকই মিটারে যেতে চায় না। তারা যেতে না চাইলে আমাদের করার কিছুই থাকে না। নিজেদের প্রয়োজনে আমরা তাদের কাছে হার মেনে যাই।’
চাকরিজীবী ফয়সাল আহমেদ জানান, মতিঝিল থেকে গুলশান-২ গোলচত্বর যেতে তার কাছ থেকে ভাড়া দাবি করা হয়েছে ৩০০ টাকা। মিটারে যেতে বললে চালক বেঁকে বসেন। তার এক কথা মিটারে যাবেন না। কয়েকটি অটোরিকশাচালকের সাথে দামাদামি করে ২৯০ টাকায় যেতে বাধ্য হয়েছেন তিনি।
শাহবাগ মোড়ে দাঁড়িয়ে সিএনজি অটোরিকশা খুঁজছিলেন খোরশেদ আলম। জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের সামনে যাবেন তিনি। অটোরিকশা থাকলেও চালকদের কেউ মিটারে যেতে রাজি হননি। চুক্তিতে তারা ৩০০ টাকা ভাড়া হাঁকেন। চালকদের অজুহাত-মিটারে গেলে তাদের পোষাবে না। সিএনজি অটোরিকশায় না গিয়ে জাহির অ্যাপভিত্তিক মোটরসাইকেল কল করেন।
শুক্রবার আজিমপুরে সিএনজি অটোরিকশা খুঁজছিলেন মহাখালীর বাসিন্দা সোহেল রানা। তার দাবি, আটটি সিএনজি অটোরিকশা চালকের সঙ্গে কথা বলেও কাউকে তিনি মিটারে যেতে রাজি করাতে পারেননি। তার গন্তব্যের দূরত্ব প্রায় ১০ কিলোমিটার। যেখানে মিটারে ভাড়া সর্বোচ্চ ১৪০ টাকা আসার কথা। কিন্তু চালক ভাড়া চান ৪০০ টাকা।
শাহবাগ মোড় থেকে যাত্রাবাড়ী যাওয়ার জন্য সিএনজি অটোরিকশা ভাড়া করার চেষ্টা করছিলেন আল রহিম শেখ। তিনি জানান, একটি সিএনজি অটোরিকশাও মিটারে যেতে চাচ্ছে না। চুক্তিতে একেকজন ভাড়া দাবি করছে ৩৫০ থেকে ৪০০ টাকা। ৫০ টাকা বাড়িয়ে মিটারে যেতে চাইলেও কেউ রাজি হচ্ছে না। তার গন্তব্যের দূরত্ব প্রায় ৭ কিলোমিটার। এ দূরত্বে সর্বোচ্চ ভাড়া আসার কথা ১০০ থেকে ১১০ টাকা। তিনি বলেন, দিনদুপুরে আমাদের পকেট কাটা হচ্ছে। কিন্তু এ নৈরাজ্য কেউ দেখে না।
বংশাল থেকে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় যেতে চাওয়া যাত্রী মো. মানিক বলেন, পান্থপথ যাওয়ার জন্য অনেক সময় ধরে অপেক্ষা করছি। কিন্তু কোনো বাস পাচ্ছি না। সিএনজি অটোরিকশায় যেতে চাইলেও তারা ইচ্ছে মতো ভাড়া চান। এই দূরত্বের ভাড়া ৩০০-৪০০ টাকা দাবি করছে। কি আর করবো হাতে কিছু মালামাল আছে তাই বাধ্য হয়ে বেশি ভাড়ায় যেতে হবে।
চালকদের অভিযোগ : অটোরিকশা চালকরা বলছেন, বিআরটিএ ২০১৫ সাল থেকে অটোরিকশা মালিকদের ৯০০ টাকা করে জমা নেওয়ার নির্দেশনা দিয়েছিল। কিন্তু সিএনজিচালিত অটোরিকশা মালিকরা ৯০০ টাকার বদলে ১৩০০-১৮০০ টাকা ভাড়া নেন অটোরিকশা প্রতি।
শাহবাগ মোড়ে সিএনজিচালক মিন্নাত আলী বলেন, যাত্রীদের অনেকেই মিটারের নাম ভুলে গেছে। সবাই এখন চুক্তিতে চলে। তারা এসে আগে জিজ্ঞেস করে ভাড়া কত। আমাদের যেভাবে পোষায়, আমরা সেভাবেই ভাড়া চাই। তিনি বলেন, মিটারে গাড়ি চালাতে হলে আগে সরকার ও মালিকদের ঠিক হতে হবে। মালিকরা তো সরকারের আইন মানে না। সরকার দৈনিক জমার হার বেঁধে দিয়েছে ৯০০ টাকা। অথচ একবেলা গাড়ি চালিয়ে মালিককে দিতে হয় ৯০০ থেকে এক হাজার টাকা। আরেক বেলা যে চালায় তার কাছ থেকেও একই পরিমাণ টাকা আদায় করা হয়। এরপর অনেক গাড়ির কাগজ ঠিক না থাকায় রাস্তায় পুলিশ ধরলে টাকা-পয়সা দিয়ে ছাড়িয়ে আনতে হয়। রাস্তায়ও থাকে জ্যাম, বেশি ট্রিপও নেওয়া যায় না।
সিএনজি অটোরিকশাচালক মুছা মল্লিক বলেন, ঢাকায় রাস্তায় যে যানজট হয় তাতে মিটারে যাত্রী উঠালে সারাদিনে জমার টাকাও উঠবো না। তাই আমরা বাধ্য হয়েই চুক্তিতে যাত্রী উঠাই। দৈনিকের টাকা দৈনিক দিতে না পারলে পরদিন থেকে মালিক আর গাড়ি দিবে না।
আরেক সিএনজিচালক সাদ্দাম জানান, একবার সিএনজি নিয়ে বের হতে জমা, গ্যাস ও নিজের খাওয়াসহ ২ হাজার টাকা খরচ আছে। রাস্তার কিছু খরচ আছে। এই খরচ উঠিয়ে তারপরে পরিবার চালানোর খরচ তুলতে হবে। কিন্তু যানজটের কারণে দিনের খরচ উঠাতেই হিমশিম খেতে হয়। মিটারে চললে টিকে থাকা যাবে না।
যাত্রী কল্যাণ সমিতির বক্তব্য : বাংলাদেশ যাত্রী কল্যাণ সমিতির মহাসচিব মোজ্জাম্মেল হক চৌধুরী বলেন, সিএনজি অটোরিকশা অন্যতম গণপরিবহনের ভূমিকা পালন করে। অনেক দিন থেকেই অটোরিকশার নৈরাজ্য চলছে। কিন্তু সরকারের ভূমিকা দুর্বল হওয়ার কারণে নৈরাজ্য বন্ধ হচ্ছে না। মনে হয় সরকার চায় না সিএনজি অটোরিকশা মিটারে চলুক। সরকার চাইলে রাস্তার নৈরাজ্য কমে আসতো। এতো দিনেও সরকার সিএনজি অটোরিকশার মিটারে চলাচল নিশ্চিত করতে পারেনি। সরকার মনে হচ্ছে চাইছে মালিকদের কিছু বিশেষ সুবিধা দেয়ার জন্য।
পুলিশ ও বিআরটিএ কর্তৃপক্ষ : পুলিশ ও বিআরটিএ সূত্র জানায়, বায়ুদূষণের কারণে টু-স্টোক অটোরিকশা রাজধানী থেকে তুলে সিএনজি অটোরিকশা নামানো হয়। প্রথমে ১৩ হাজার সিএনজি অটোরিকশাকে বিআরটিএ থেকে নিবন্ধন দেয়া হয়। তবে এখন বৈধ ও অবৈধ মিলিয়ে ৩০ হাজারের বেশি অটোরিকশা চলাচল করছে। অবৈধ সিএনজিগুলো রাজধানীর প্রধান সড়কে কম চলাচল করে।
আইনের প্রতি বৃদ্ধাঙ্গুলি দেখিয়ে রাজধানীতে সিএনজিচালিত অটোরিকশায় নৈরাজ্য চলছে। চুক্তিতে দুই-তিন গুণ বেশি ভাড়ায় অটোরিকশা চালানো হচ্ছে। এমন নৈরাজ্যে যাত্রীদের রীতিমতো নাভিশ্বাস উঠেছে। অথচ আইন অনুযায়ী-যাত্রীর ইচ্ছামতো মিটারেই অটোরিকশার গন্তব্যে যাওয়ার কথা। এ আইন ২০ বছরেও বাস্তবায়ন করা হয়নি। বর্তমানে অটোরিকশায় ভাড়া নৈরাজ্য আরও ভয়াবহ হয়ে উঠেছে। অটোরিকশার এমন নৈরাজ্য প্রতিরোধে ট্রাফিক বিভাগের তৎপরতাও তেমন একটা চোখে পড়ে না বলে যাত্রীদের অভিযোগ। তবে ট্রাফিক পুলিশ বলছে-এ নৈরাজ্য বন্ধে তাদের আন্তরিকতার কোনো ঘাটতি নেই।
এ বিষয়ে গত সোমবার বাংলাদেশ রোড ট্রান্সপোর্ট অথরিটি (বিআরটিএ) জানায়, সড়ক আইন অনুযায়ী চুক্তিতে চলাচলকারী সিএনজি অটোরিকশার বিরুদ্ধে বিআরটিএ’র ভ্রাম্যমাণ আদালত অব্যাহত আছে। কোনো অটোরিকশা চালক মিটারে না চললে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে। সীমিত জনবল দিয়েও এ প্রচেষ্টা অব্যাহত রেখেছি। এছাড়া ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের সঙ্গেও এ বিষয়ে আমরা আলোচনা করছি। তিনি আরও বলেন, যাত্রীদেরও এ বিষয়ে সচেতন হতে হবে।
ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ট্রাফিক) মো. সরওয়ার পিপিএম বলেন, মিটার ছাড়া সিএনজি অটোরিকশা চলা নিয়ে শাস্তির বিষয়ে সড়ক আইনে সুস্পষ্ট কিছু বলা নেই। এ কারণে সিএনজিচালকদের বিরুদ্ধে আইন অনুযায়ী ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয় না। তিনি বলেন, সিএনজি অটোরিকশা যান্ত্রিক যানবাহন নয়। আবার অযান্ত্রিকও বলা যায় না। ফলে বিভ্রান্তি রয়েছে। মিটারে চালাতে চালকদের বাধ্য করতে আইনি কাঠামোর আওতায় আনতে হবে। তিনি বলেন, মিটারে না গিয়ে চুক্তিতে যাওয়ার কোনো ঘটনা নজরে এলে অন্যভাবে ব্যবস্থা নেওয়া হয়। কখনো কখনো ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে সাজার ব্যবস্থাও করা হয়, গাড়ি ডাম্পিং করা হয়। কেউ অভিযোগ করলে অটোরিকশার বিরুদ্ধে মামলা করা হয়। তবে ট্রাফিক পুলিশ ধরলে বেশির ভাগ সময় যাত্রীরা বলে, তারা মিটারে যাচ্ছে। এ কারণে ব্যবস্থা নেওয়া যায় না।
উল্লেখ্য, ২০০২ সালের শেষ দিক থেকে ঢাকা শহরে সিএনজিচালিত অটোরিকশা চলাচল শুরু হয়। এরপর পর্যায়ক্রমে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন কর্তৃপক্ষ (বিআরটিএ) প্রায় ১৩ হাজার অটোরিকশার নিবন্ধন দেয়।