স্মরণকালের ইতিহাসে বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের শিক্ষার্থীদের জীবনে এমন বিব্রতকর ঘটনা আর ঘটেনি। গত দেড় দশক ধরে জানুয়ারি মাসের ১ তারিখ থেকেই হাতে নতুন বই পেয়ে অভ্যস্ত শিক্ষার্থীরা। নতুন বই হাতে নিয়ে তাদের শুরু হয় বই উৎসব। কিন্তু এবার জানুয়ারি মাস শেষ হয়ে যেতে চলল অথচ এখনো তারা সব বই হাতে পায়নি। অনেকে দু-তিনটি বই পেলেও সব বই কবে নাগাদ হাতে পাবে তা নিয়ে রয়েছে সংশয়। গত সোমবার সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, শিক্ষা বিভাগ থেকে বলা হচ্ছে, সব বই পেতে ফেব্রুয়ারি লেগে যাবে। তবে যে অবস্থা দেখা যাচ্ছে, তাতে প্রাথমিকের সব বই হয়তো ফেব্রুয়ারিতে দেওয়া সম্ভব হতে পারে। কিন্তু মাধ্যমিকের সব বই পেতে মার্চ মাস লেগে যেতে পারে বলে মনে করছেন ছাপা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা।
এতে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে লেখাপড়া চলছে টেনেটুনে। অনেক শিক্ষার্থী স্কুলে যায় না। গেলেও একটি-দুটি ক্লাস হয়। এ অবস্থায় দেশের শিক্ষার্থীদের যে বড় ধরনের ক্ষতি হচ্ছে তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। এর চাপ সারা বছর ধরেই পড়বে, হয়তো সারাজীবন ধরেই; কারণ, একটি বছর শিক্ষার্থীদের জন্য অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
শিক্ষা-সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, এবার বিশেষ একটি পরিস্থিতির কারণে বই ছাপার কাজে দেরি হয়েছে। আগস্টের পর যখন প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের বই ছাপার প্রক্রিয়া পুরোপুরি চলে; এবার তখন শিক্ষাক্রম পরিবর্তন, পাঠ্যবই পরিমার্জন ও দরপত্র সংক্রান্ত কাজগুলো হয়েছে। তাই এই বাস্তবতা মেনে এবার শিক্ষকদের বিশেষ দায়িত্ব পালন করতে হবে। শিক্ষার্থীদের যাতে পড়াশোনায় সমস্যা না হয়, সে জন্য শিক্ষকদের উচিত এনসিটিবির ওয়েবসাইটে দেওয়া পাঠ্যবই সংগ্রহ করে নিয়মিত ক্লাস নেওয়া।
এনসিটিবির ওয়েবসাইটে কিছু বইয়ের পিডিএফ কপি দেওয়া হয়েছে কিন্তু ডাউনলোড করতে গেলে সমস্যা হচ্ছে। একদিকে সব শিক্ষার্থী এখনো পাঠ্যবই পায়নি অন্যদিকে ওয়েবসাইটে পাঠ্যবইয়ের পিডিএফ ভার্সন ডাউনলোড করতে সমস্যার প্রভাব পড়াশোনার ওপর প্রভাব পড়ছে। অভিভাবক-শিক্ষকরা বলছেন, বই দিতে যত দেরি হবে সমস্যাটি তত দীর্ঘ হবে। এ ক্ষেত্রে আরেকটি বৈষম্যের আশঙ্কাও আছে। কারণ, বই ডাউনলোড করে তা প্রিন্ট করার ক্ষেত্রে খরচের একটা ব্যাপার আছে। তাই যত দ্রুত সম্ভব সব শিক্ষার্থীর হাতে সব পাঠ্যবই তুলে দেওয়া হবে সবচেয়ে ভালো কাজ। কিন্তু শিক্ষার্থীরা কবে নাগাদ সব বই হাতে পাবে এটা জানেন না স্বয়ং শিক্ষা উপদেষ্টাও। সব দেখেশুনে মনে হচ্ছে, বই ছাপাতে দেরি হওয়ায় সরকারের কিছু গাফিলতিও আছে। এখন যে কোনো সমস্যায় সরকার একটা কথা বলে পার পেয়ে যাওয়ার চেষ্টা করে যে, রাজনৈতিক পটপরিবর্তনের কারণে সবকিছুতে সমস্যা হচ্ছে। কিন্তু শিক্ষার মতো গুরুত্বপূর্ণ একটি বিষয়ে যদি রাজনৈতিক পটপরিবর্তনকে দায়ী করা হয় তাহলে এটিই একটি বড় সমস্যা। সরকারের উচিত ছিল অন্য যে কোনো সমস্যার চেয়ে এই সমস্যাটিকে আরও গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করা। শিক্ষার্থীদের এভাবে জিম্মি করা সরকারের সুবিবেচনার কাজ হয়নি।
আরেকটা কথা না বললেও নয় যে, বইয়ের অভাবে ক্লাস হবে না এটা কেমন কথা! বই ছাড়া কি ক্লাস চালু রাখা যায় না? সদিচ্ছা থাকলে শিক্ষকরা বিষয়ভিত্তিক ক্লাস নিতে পারতেন। বাংলা, অংক, ইংরেজি, সমাজ, বিজ্ঞান- যেকোনো বিষয়েরই প্রাথমিক ও সার্বজনীন জ্ঞানগত বিষয়গুলো নিয়ে ক্লাসে আলোচনা করতে পারতেন। বই নেইÑ এই ছুতোয় ক্লাস বর্জন শিক্ষার্থীদের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর হবে। তারপরও প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরে বইয়ের বিকল্প নেই। বই দিতে দেরি হলে প্রথম সাময়িক পরীক্ষাও হয়তো পিছিয়ে যাবে। প্রতিটি বইয়ের আলোচ্য পাঠ্যসূচি হয়তো এক বছরে শেষ করা সম্ভব হবে না অনেক স্কুলেই। তাতে শিক্ষার্থীরা নির্দিষ্ট বিষয় সম্পর্কে সম্মক জ্ঞান ও ধারণা না পেয়েই হয়তো পরবর্তী ক্লাসে উন্নীত হবে, তার প্রভাব পরের শ্রেণিগুলোতেও পড়বে নিশ্চিতভাবেই। তাই যথাসম্ভব দ্রুত সব শিক্ষার্থীর হাতে সব বই তুলে দেওয়ার চেষ্টা করুন এবং বই দিতে যদি দেরি হয় সব ক্লাস অন্তত চালু রাখার চেষ্টা করুন।