আসন্ন জাতীয় সংসদ নির্বাচনকে টার্গেট করে ইসলামী দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার চেষ্টা করছে বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। গত মঙ্গলবার জামায়াতের আমিরের সঙ্গে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ-এর আমির ও চরমানোই পীরের বৈঠকের পর বিষয়টি আলোচনায় এসেছে। গত বছর ৫ আগস্টের পর থেকে দলগুলোর মধ্যে ঐক্য প্রক্রিয়াটি শুরু হলেও হালে তাতে গতি ফিরেছে। প্রথম প্রথম ছোটখাটো মতপার্থক্য ও সিদ্ধান্ত গ্রহণে চিন্ত-ভাবনায় ধীর গতি থাকলেও জাতীয় সংসদ নির্বাচন নিয়ে জোরেসোরে আলোচনা শুরু হওয়ায় ইসলামী দল ও সংগঠনগুলোর ঐক্য প্রক্রিয়ায় গতি বাড়ছে বলে মনে করছেন ইসলামী দলগুলোর মাঠ পর্যায়ের নেতাকর্মীরা।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন ও খেলাফত মজলিসের শীর্ষ নেতারা দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেছেন, তাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা বেশ আগে থেকেই অব্যাহত রয়েছে। বেশিরভাগ ইসলামী দল এককাতারে আসতে আগ্রহীও রয়েছে। একটু সময় লাগলেও মৌলিক জায়গায় এককাতারে পৌঁছাতে পারবেন বলেও তারা আশাবাদ ব্যক্ত করছেন।
জানা গেছে, বাংলাদেশে নির্বাচন কমিশনে (ইসি) নিবন্ধিত এবং অনিবন্ধিত সব মিলিয়ে ৬০টিরও বেশি ইসলামী দল ও সংগঠন রয়েছে। এসব দলের মধ্যে হাতে গোনা ৭-৮টি দলের মাঠ পর্যায়ে কার্যক্রম থাকলেও অনেক দল অস্তিত্ব বিলীনের পথে। আর ইসিতে নিবন্ধিত ইসলামী দল রয়েছে মাত্র ১১টি। নিবন্ধিত ইসলামী দলগুলো হলো-খেলাফত মজলিস, জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম বাংলাদেশ, ইসলামী আন্দোলন, ইসলামিক ফ্রন্ট, খেলাফত আন্দোলন, বাংলাদেশ তরীকত ফেডারেশন, ইসলামী ঐক্যজোট, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিস, বাংলাদেশ ইসলামী ফ্রন্ট, জাকের পার্টি ও বাংলাদেশ সুপ্রিম পার্টি। এর বাইরে বড় ইসলামী দল জামায়াতে ইসলামী এখন নিবন্ধনহীন। এক সময় দলটির নিবন্ধন ছিল। বারবার সংসদ নির্বাচনে নিজস্ব প্রতীক ‘দাঁড়িপাল্লা’ নিয়ে ভোট করে নির্বাচিত হয়ে জাতীয় সংসদে প্রতিনিধিত্ব করেছে দলটির নেতারা। তবে একটি রিট মামলায় জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৩ সালের ১ আগস্ট রায় দেন হাইকোর্ট। ওই বছরের ২ নভেম্বর হাইকোর্টের পূর্ণাঙ্গ রায় প্রকাশিত হওয়ার পর জামায়াত ওই আদেশের বিরুদ্ধে আপিল করে। যদিও জামায়াতের নিবন্ধন বাতিল করে ২০১৮ সালের ৭ ডিসেম্বর প্রজ্ঞাপন জারি করে ইসি। তারপর থেকে দলটির আর নিবন্ধন নেই। আপিল বিভাগে জামায়াতের নিবন্ধনের বিষয়টি এখনো বিচারাধীন। তারপরও ভোটের ক্ষেত্রে জামায়াতের পাশাপাশি ইসলামী আন্দোলনের মাঠ পর্যায়ে গুরুত্ব রয়েছে।
গতবছর ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার আন্দোলনে পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের পতনে ইসলামী দলগুলো নিজেদের মধ্যে ফের ঐক্যের প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি করে। সেই জায়গা থেকে দলগুলোর নেতারা একে অপরের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা শুরু করেন। বিশেষ করে বড় দুটি ইসলামী দলকে এ ব্যাপারে বেশ তৎপর দেখা গেছে। যার একটি হচ্ছে জামায়াতে ইসলামী আর অন্যটি চরমোনই পীরের নেতৃত্বে ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ। ইসলামী আন্দোলন বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোকে নিয়েও সভা সেমিনার করেছে।
তবে, আওয়ামী লীগের পতনের পর ইসলামী দলগুলোকে এক ছাতার নিচে আনার জোর চেষ্টা শুরু করে জামায়াতে ইসলামী। যার অংশ হিসেবে গত বছর ৫ আগস্টের পর বিভিন্ন ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময় শুরু করে জামায়াত ইসলামী। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, জাকের পার্টি, খেলাফত মজলিস ও ফরায়েজী আন্দোলনও ছিল। এছাড়া খেলাফত মজলিসের বর্তমান আমির (সাবেক মহাসচিব) মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের (একাংশ) আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমীর মতো আলেমদের সঙ্গেও জামায়াত নেতারা নানাভাবে বৈঠক করেন।
মূলত ওই বৈঠকের মূল বিষয় ছিল ইসলামী দলগুলো যেন একে অপরের প্রতি বিদ্বেষমূলক কথাবার্তা বলা থেকে রিবত রাখা এবং নির্বাচনকেন্দ্রিক ঐক্য গড়ে তোলা। যার প্রভাব মাঠ পর্যায়েও পড়ে। দলগুলোর বেশিরভাগ নেতাকর্মীর মধ্যে আশার সৃষ্টি হয়। তারা মনে করেছিলেন, হয়তো দ্রুত সময়ের মধ্যে দলগুলো একটি সিদ্ধান্তে পৌঁছাবেন। দলগুলোর শীর্ষ পর্যায়ের নেতাদের পক্ষ থেকে মাঠ পর্যায়ে এমন বক্তব্যও আসতে শুরু করে। তবে সে প্রক্রিয়ায় ভাটা পড়ে।
ইসলামী দলগুলোর সেই ঐক্য প্রক্রিয়া এখন কোন পর্যায়ে সেটি জানতে দৈনিক ভোরের আকাশের পক্ষ থেকে ইসলামী ঘরানার রাজনৈতিক দলগুলোর বিভিন্ন পর্যায়ের নেতাকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করা হয়। নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার পতনের পর যে ঐক্য প্রক্রিয়া চলছিল সেটি এখনো চলমান। দলগুলোর নেতাদের পরস্পরের সঙ্গে কথাবার্তাও অব্যাহত রয়েছে। তবে, কারণ হিসেবে বেশিরভাগ মাঠ পর্যায়ের কর্মী বলেছেন, দলগুলোর একে অপরের সঙ্গে বেশ ‘আকিদাগত’ অমিলই গতি মন্থর হয়ে যাওয়ার অন্যতম কারণ। এছাড়া জামায়াতে ইসলামীকে অনেকে ‘মওদূদীবাদ’ মনে করাও নিজেদের মধ্যে ঐক্যে বাধার সৃষ্টি হয়। তবে একেকটি সংসদীয় আসনে সব দলের আলাদা প্রার্থী না দিয়ে একক প্রার্থী দেওয়ার ক্ষেত্রে সব দলের নেতাকর্মীর ইতিবাচক আগ্রহ রয়েছে।
তবে হঠাৎ করে গত মঙ্গলবার চরমোনাই সফর ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মদ রেজাউল করীমের সঙ্গে জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমানের বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। নিজ দলের বরিশালে কর্মিসভায় যোগ দেওয়ার আগে জামায়াত আমির চরমোনাই পীরের দরবার শরীফ সফর করেন। সেখানে বৈঠক শেষে দেশের প্রধান দুই ইসলামী দলের আমিরদ্বয় বলেন, ‘তারা ভোট কেন্দ্রে ইসলামী দলের পক্ষে একটি বাক্স পাঠাতে চান। সে লক্ষ্যে কাজ করছেন তারা।’
ইসলামী দল হলেও ভিন্ন মতাদর্শের দুই নেতা বৈঠকের পর একই সুরে বক্তব্য দেওয়ার পর ফের ইসলামী দলের এক্যের বিষয়টি সামনে এসেছে। এছাড়া জাতীয় নির্বাচন নিয়ে যেহেতু রাজনীতির মাঠ সরগরম হচ্ছে তাই অনেকে এখন মনে করছেন যে, দ্রুত ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের গতি ত্বরান্বিত হচ্ছে।
এ বিষয়ে জামায়াতে ইসলামীর সেক্রেটারি জেনারেল অধ্যাপক মিয়া গোলাম পরওয়ার দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, আমরা দীর্ঘদিন থেকেই ইসলামী দলগুলোর মধ্যে ঐক্যের কথা বলে আসছি। এটা আমরা আওয়ামী লীগ পতনের পর বলছি সেইরকম নয়। আর বিষয়টিতে ইসলামী দলগুলোর আগ্রহও বেড়েছে। জোট করতে গেলে কিছু মতপার্থক্য থাকে। কে কতটুকু ছাড় দিবে সেটার একটা বিষয় থাকে। সবমিলিয়ে তো একটা ঐক্য। ইসলামী দলগুলোর ঐক্যের ব্যাপারে ইতিবাচক ভাবে এগোচ্ছে বলেও মনে করেন তিনি। আর জামায়াত আমিরের চরমোনাই সফর নিয়ে তিনি বলেন, যেহেতু আমাদের আমির বরিশাল গিয়েছিলেন তাই তিনি চরমোনাই সফর করেছেন। চরমোনাই পীরের সঙ্গে বৈঠকের ব্যাপারে তিনি বলেন, একসঙ্গে বসলে তো আসলে অনেক বিষয় আলোচনা হয়।
বিষয়টি নিয়ে কথা হয় বাংলাদেশ খেলাফত মজলিসের আমির ও হেফাজতের ইসলামের শীর্ষ নেতা মাওলানা মামুনুল হকের সঙ্গে। তিনি দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, ইসলামী দলগুলোর বৃহৎ ঐক্যের ব্যাপারে আমরা কাজ করছি। আমাদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা ও বোঝাপড়া আমাদের মধ্যে দিনদিন ঘনিষ্ঠ হচ্ছে। দেশের মানুষ ইসলামী আন্দোলনের বিভিন্ন মত ও পথের নেতাদেরকে এককাতারে দেখতে চাওয়ার তাদের যে আকাক্সক্ষা পূরণ হবে বলে আমি মনে করছি।
ইসলামী আন্দোলনের মহাসচিব অধ্যক্ষ হাফেজ মাওলানা ইউনুছ আহমাদ বলেন, ঐক্য নিয়ে আলোচনা চলমান। এর লক্ষ্য হলো ইসলামী শক্তিগুলোকে এক জায়গায় আনা। এ নিয়ে সাধারণ মানুষেরও একটা আগ্রহ আছে। কারণ তারা তো বিভিন্ন দলের ভূমিকা দেখছেন, অনেকটা হতাশ হয়েছেন। সাধারণ মানুষের চাওয়া আছে, ইসলামী শক্তি এক কাতারে আসলে তারা ভালো থাকবেন। জামায়াত ইসলামী আকিদাগত সমস্যার বিষয়ে তিনি বলেন, কোন কোন কওমি উলামা দলটির বিষয়ে আপত্তি থাকলেও আসলে একেবারে বিচ্ছিন্ন থাকা ভালো কথা নয়। আমরা একের অপরের সঙ্গে যোগাযোগ রক্ষা করে চলছি।
তিনি বলেন, বুধবার দুই শীর্ষ নেতার বৈঠককে সাধারণ মানুষ ইতিবাচক ভাবে নিয়েছে। যেহেতু নির্বাচন নিয়ে আলোচনা চলছে তাই ঐক্যর গতিও বাড়বে এটাই স্বাভাবিক। তিনি আরো বলেন, শুধু জামায়াত ইসলামী ঐক্যের চেষ্টা করে যাচ্ছে বিষয়টি এ রকম নয়। এ প্রক্রিয়ায় অনেকেই আগে থেকে জড়িত।