logo
আপডেট : ২৬ জানুয়ারি, ২০২৫ ১১:৩৩
সুদের বোঝা যেন আর না বাড়ে
আব্দুর রহিম

সুদের বোঝা যেন আর না বাড়ে

মূল্যস্ফীতির চাপে বহু বছর ধরেই আমরা পিষ্ট হচ্ছি। এ যেন অপ্রতিরোধ্য। কোনোভাবেই এর লাগাম টানা যাচ্ছে না। জিনিসপত্রের উচ্চমূল্যে নিম্ন ও মধ্যম আয়ের মানুষ নাজেহাল। আজ চালের দাম বাড়ে তো, কাল বাড়ে তেলের। অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর মানুষ আশায় বুক বেঁধেছিল এই ভেবে যে এবার পণ্যের দাম কমবে। কেননা, এতদিন যারা চাঁদাবাজি করতো, তারা পালিয়ে গেছে। চাঁদাবাজি না হলে জিনিসপত্রের দামও স্বাভাবিকভাবেই কমে আসার কথা। মানুষ শান্তিতে দুবেলা দুমুঠো খাবার খেতে পারবেন। কিন্তু সেই আশার গুড়ে বালু পড়তে সময় লাগেনি। এই সরকার ক্ষমতায় আসার কয়েক দিনের মধ্যে চাল-ডালের দাম বেড়ে যায়। চালের সেই ঊর্ধ্বগতির মধ্যেই আবারও বেড়েছে এই নিত্যপণ্যের দাম। এরই মধ্যে আবারও শত পণ্যে কর বাড়িয়েছে সরকার। যদিও পরে কিছুটা সরে এসেছে এনবিআর। অর্থাৎ কিছু পণ্যে আগের কর ও শুল্ক থাকছে। কিন্তু অর্থবছরের মাঝপথে এসে কেন শুল্ক-কর বাড়াতে হলো? এই প্রশ্নে উত্তর খুবই সহজ। আর তা হলো- সরকারের রাজস্ব বাড়ানো।

সূত্র বলছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরের প্রথম চার মাসে সরকারের মোট রাজস্বের অর্ধেকের বেশি খরচ হয়েছে শুধু সুদ পরিশোধে। মূলত অতিরিক্ত ঋণ ও সুদহার বেড়ে যাওয়ার কারণেই এমনটা হয়েছে। এ সময়ে সুদ পরিশোধ করা হয়েছে ৫৮ হাজার ৪৯৪ কোটি টাকা; যা আগের বছরের একই সময়ের তুলনায় ৮৪ শতাংশ বেশি। অর্থ মন্ত্রণালয় বলছে, এই ব্যয় সরকারের মোট রাজস্ব ব্যয়ের ৫১ দশমিক পাঁচ শতাংশ। সুদ পরিশোধের মধ্যে ৮৮ দশমিক পাঁচ শতাংশ বা ৫১ হাজার ৭৯১ কোটি টাকা পরিশোধ করা হয় আভ্যন্তরীণ ঋণের বিপরীতে। বাকি ছয় হাজার ৭০২ কোটি টাকা যায় বিদেশি ঋণের সুদ পরিশোধে। ইনস্টিটিউট ফর ইনক্লুসিভ ফাইন্যান্স অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের (আইএনএম) নির্বাহী পরিচালক ও বাংলাদেশ ইনস্টিটিউট অব ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজের (বিআইডিএস) সাবেক মহাপরিচালক মুস্তাফা কে মুজেরির ভাষ্য, ‘সরকার যথাযথ গবেষণা ছাড়াই মেগা প্রকল্পের জন্য প্রচুর ঋণ নেওয়ায় সুদ পরিশোধের হার বেড়েছে।’

তার মতে, যথাযথ সম্ভাব্যতা যাচাই না করে প্রায়ই রাজনৈতিক বিবেচনায় ঋণ নেওয়া হয়েছে। ফলে ব্যাপক দুর্নীতি হয়েছে। এসব ঋণ কার্যকরভাবে বা দক্ষতার সঙ্গে ব্যবহার করা হয়নি। ফলে ঋণ পরিশোধে এসব প্রকল্প থেকে পর্যাপ্ত আয় হচ্ছে না। শেষ পর্যন্ত বোঝা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সম্প্রতি নেওয়া কিছু ঋণ পরিশোধে সময়সীমা কমে যাওয়ায় আর্থিক চাপ আরও বেড়েছে।

সুদ পরিশোধের প্রবণতা বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, ২০০৯-১০ অর্থবছর থেকে ২০১৯-২০ অর্থবছর পর্যন্ত মোট রাজস্ব বাজেটের ২০ শতাংশের কম সুদ পরিশোধে খরচ হতো। ২০০৯-১০ অর্থবছরে মোট রাজস্ব বাজেটের ১৮ দশমিক ৬৫ শতাংশ খরচ হয় সুদ পরিশোধে। শুধুমাত্র ২০২০-২১ অর্থবছরে সুদ পরিশোধে খরচ মোট রাজস্ব বাজেটের ২১ শতাংশে পৌঁছায়। করোনা মহামারির পর সরকার বিদেশ থেকে ভালো পরিমাণে বাজেট সহায়তা পায়। ফলে ঋণের বোঝা বেড়ে গেছে। সেসব ঋণ বিতরণের পরপরই সুদ পরিশোধ শুরু হয়। অন্যদিকে সরকারি খরচ বেড়েছে অনেক। এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে রাজস্ব আদায় হয়নি। ফলে দেশে কর-জিডিপি অনুপাত কম থেকে গেছে। দেশের কর-জিডিপি অনুপাত প্রায় আট শতাংশ। ভারতে ১২ শতাংশ ও নেপালে ১৭ শতাংশ। বাংলাদেশের কর-জিডিপি অনুপাত এশিয়া-প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলের গড় ১৯ শতাংশ ও উন্নয়নশীল দেশগুলোর গড় ২৫ শতাংশের চেয়ে অনেক কম। মুস্তাফা কে মুজেরি বলেন, ‘বিশ্বে খুব কম দেশই আছে যাদের কর-জিডিপি অনুপাত এত কম।’ তা সত্ত্বেও বিগত সরকারগুলো রাজনৈতিক কারণে বাজেটের আকার বাড়ানোর চেষ্টা করেছে। ফলে ব্যাংক ও অন্যান্য স্থানীয় উৎস থেকে বড় আকারের ঋণ নেওয়ার প্রয়োজন দেখা দেয়। ব্যাংকিং খাতে সুদহার বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে সরকারের সুদ পরিশোধের বোঝা অনেক বেড়েছে। এদিকে, গত পাঁচ বছরে ব্যাংকিং খাতে সুদহার প্রায় ৫০০ বেসিস পয়েন্ট বেড়েছে। সরকারের সুদ পরিশোধের বাধ্যবাধকতাকে অস্থিতিশীল পর্যায়ে ঠেলে দিয়েছে। (সূত্র : ডেইলি স্টার)।

২০২৩-২৪ অর্থবছরে সরকারি ঋণ বছরে ১৩ দশমিক তিন শতাংশ বেড়ে রেকর্ড ১৮ লাখ কোটি টাকা হয়। তা দেশের মোট দেশজ উৎপাদনের (জিডিপি) ৩৬ দশমিক তিন শতাংশ। মুজেরির মতে, উচ্চহারে সুদ পরিশোধের কারণে সরকারের আর্থিক পরিসর সীমাবদ্ধ হয়ে পড়েছে।

অপচয় কমানো ও প্রকল্প বাস্তবায়নসহ সরকারি খরচে দুর্নীতি কমিয়ে দেশের রাজস্ব বাড়ানোর সুপারিশ করে এই অর্থনীতিবিদ বলেন, ১০০ টাকা নিয়ে ১০ টাকায় প্রকল্প বাস্তবায়ন করলে বোঝা বেড়ে যাবে। বছরের পর বছর ধরে তা হয়ে আসছে। সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) ফেলো অধ্যাপক মোস্তাফিজুর রহমানের ভাষ্য, ‘ঋণ জমা হয়ে যাওয়ায় সুদ পরিশোধের হার বেড়েছে।’ রাজস্ব-জিডিপির অনুপাত কম থাকায় সরকার ঋণভিত্তিক বার্ষিক উন্নয়ন কর্মসূচি (এডিপি) বাড়িয়েছে। এখন এডিপি প্রায় পুরোটাই ঋণনির্ভর বলে জানান তিনি। প্রত্যক্ষ কর না বাড়া পর্যন্ত এ চাপ কমবে না উল্লেখ করে তিনি বলেন, সুদ পরিশোধ বাড়তে থাকলে অন্যান্য উন্নয়ন খাতে বরাদ্দ কম আসবে। আমরা সরকারকে বারবার বলেছি, ঋণ-জিডিপি অনুপাত তুলনামূলক কম বিবেচনা করে তারা ঋণ নেবে না। তবে তাদের রাজস্ব-ঋণের অনুপাত ও রিজার্ভের পরিমাণ দেখতে হবে। তাছাড়া প্রকল্প খরচ অনেক অনেক বেশি। দেশকে এখন অতিরিক্ত খরচের ওপরও সুদ দিতে হবে। এটা পুঞ্জিভূত চাপ। ঋণ থেকে তৈরি করা প্রকল্পগুলো থেকে যদি পর্যাপ্ত আয় না আসে তাহলে সেগুলো বোঝা হয়ে যায়। এখন তাই হচ্ছে।

ঋণ করে ‘ঘি খাওয়া’ আমাদের দেশে নতুন কিছু নয়। বিলাসি আর চোখ ধাঁধানো প্রকল্পে যখন উন্নয়নের জোয়ার বইয়ে দেওয়া হয়েছে; তখনই বেড়েছে ঋণের বোঝা। এগুলোর মধ্যে ঋণের কিছু প্রকল্প তেমন কাজে আসেনি, আসছে না। উদাহরণ হিসেবে কর্ণফুলী টানেলের কথাই বলা যাক। এই প্রকল্প থেকে যত টাকা আয় হওয়ার কথা ছিল, বাস্তবে তার ধারে কাছেও যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না। অবস্থটা এমন হয়েছে যে এই প্রকল্প থেকে যে আয় আসছে; তা দিয়ে পরিচালন ব্যয়ও মেটানো যাচ্ছে না। কিন্তু এর সুদ পরিশোধ করতেই হচ্ছে। এটা আমাদের অর্থনীতিতে বড় চাপ তৈরি করছে। ভবিষ্যতে প্রকল্প হাতে নেওয়ার আগে ঠান্ডা মাথায় ভাবতে হবে। শুধু নাম ফোটাতে কিংবা পকেট ভারী করার জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া যাবে না।

লেখক : সাংবাদিক