logo
আপডেট : ৩১ জানুয়ারি, ২০২৫ ১৬:৪৫
মানিকগঞ্জে
বন্ধ হচ্ছে না পঁচা গাদ দিয়ে সন্দেশ তৈরির কারখানা
মানিকগঞ্জ প্রতিনিধি

বন্ধ হচ্ছে না পঁচা গাদ দিয়ে সন্দেশ তৈরির কারখানা

মানিকগঞ্জের দৌলতপুরে মিষ্টির পঁচা গাদ থেকে শিশু খাদ্য সন্দেশ তৈরির কারখানা ফের চালু হয়েছে। তিনজন অসাধু ব্যবসায়ী একাধিক কারখানায় এসব সন্দেশ তৈরি করছেন। আরেক অসাধু ব্যবসায়ী কারখানায় সন্দেশ তৈরি না করলেও বিভিন্ন স্থান থেকে মিষ্টির পঁচা গাদ সংগ্রহ করে তা অন্য একটি কারখানায় সরবরাহ করছেন। এ ছাড়া, কয়েকজন ব্যবসায়ী তাদের কারখানা সাভার, গাজীপুরসহ বিভিন্ন স্থানে সরিয়ে নিয়েছেন।

গত বছরের ৫ নভেম্বর, মিষ্টির পঁচা গাদ দিয়ে সন্দেশ তৈরির একাধিক সদস্য ও ৯টি কারখানার সন্ধান পাওয়া যায়। পরদিন, ৬ নভেম্বর, জেলা প্রশাসনের ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান পরিচালনা করে। সেনাবাহিনীর সহায়তায় পরিচালিত ওই অভিযানে চারটি কারখানার মালিককে এক লাখ টাকা করে মোট চার লাখ টাকা জরিমানা করা হয়। একই সঙ্গে বিপুল পরিমাণ মিষ্টির পঁচা গাদ ও সন্দেশ তৈরির সরঞ্জাম ধ্বংস করা হয়।

সন্দেশ তৈরির এসব কারখানা দৌলতপুর উপজেলার ধামশ্বর ইউনিয়নের নাটুয়াবাড়ী গ্রামে গড়ে তোলা হয়েছিল। ওই গ্রামের মানুষের প্রধান পেশা এটি। দীর্ঘদিন ধরে দেশের বিভিন্ন জায়গায় কারখানা স্থাপন করে তারা সন্দেশ তৈরি করে আসছিল। পরে এসব সন্দেশ বিভিন্ন আকর্ষণীয় নামে প্যাকেটজাত করে সারা দেশে পাইকারি বিক্রি করা হতো। এর মধ্যে নাটোরের ‘কাঁচাগোল্লা’ অন্যতম।

অবৈধ কারখানাগুলো আবারও সক্রিয়

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, নাটুয়াবাড়ীতে এখন শুভ রাজ, আলম খান ও রাজিব নামে তিন ব্যক্তি সন্দেশ তৈরির কারখানা চালু রেখেছেন। প্রতিদিন তাদের কারখানায় বিপুল পরিমাণ সন্দেশ তৈরি হচ্ছে। এদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি সন্দেশ উৎপাদন করছেন শুভ রাজ। তার কারখানায় মিষ্টির পঁচা গাদ সরবরাহ করছেন আব্দুর রউফ। আর রাজিব ও আলম খান নিজেরাই বিভিন্ন মিষ্টির দোকান থেকে পঁচা গাদ সংগ্রহ করেন।

আলম খান নতুন এই ব্যবসায় যুক্ত হয়েছেন। এবারই প্রথম তিনি সন্দেশ তৈরির কারখানা চালু করেছেন। তিনি কলিয়া ইউনিয়ন যুবদলের সভাপতি প্রার্থী। স্থানীয়রা জানান, আলম খানের বড় ভাই নূর খান ও শুভ রাজের হাত ধরে এ গ্রামে মিষ্টির পঁচা গাদ থেকে সন্দেশ তৈরির যাত্রা শুরু হয়। এরপর ধীরে ধীরে সন্দেশ তৈরির ব্যবসায়ী ও কারখানার সংখ্যা বেড়ে যায়।

নূর খানের একটি বড় কারখানা সিলেটে এবং শুভ রাজের কারখানা গাজীপুরের কালিয়াকৈরে অবস্থিত। স্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক ক্ষতিকর এসব সন্দেশ তৈরি করে তারা এখন কোটিপতি বনে গেছেন। নিজেদের জন্য গড়ে তুলেছেন বিলাসবহুল বাড়ি। এছাড়া, এলাকার মসজিদ, মাদ্রাসা, ওয়াজ মাহফিল, বাৎসরিক ওরস এবং মেলায় মোটা অঙ্কের অনুদান দেন তারা।

প্রশাসনের প্রতিক্রিয়া

এ বিষয়ে দৌলতপুর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) নাহিয়ান নুরেন বলেন, “গত বছরের নভেম্বরে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছিল। এরপর আমরা আরও একবার অভিযানে গিয়েছিলাম। তখন তারা আমাদের ঘিরে ধরেছিল এবং একপর্যায়ে প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে আর কারখানা চালাবে না। তবে নতুন করে কারখানা চালু করা হলে খোঁজ নিয়ে সেনাবাহিনীর সহায়তায় আবারও অভিযান চালানো হবে।”

ঘিওরেও পঁচা গাদ দিয়ে সন্দেশ তৈরি

অপরদিকে, ঘিওর উপজেলার নারচি এলাকায় মিষ্টির পঁচা গাদ থেকে সন্দেশ তৈরির আরও একটি কারখানার সন্ধান পাওয়া গেছে। কারখানাটি নারচি গ্রামের রিকশা স্ট্যান্ডের পাশে স্থাপন করা হয়েছে। মওলা মিয়া ও মনির হোসেন নামের দুই ব্যক্তি এটি পরিচালনা করছেন। তারা পিতা-পুত্র। কয়েক মাস ধরে তারা এখানে কারখানাটি চালু করেছেন। এর আগে, কুস্তা গ্রামে তারা এই কারখানা পরিচালনা করতেন।

সরেজমিনে দেখা যায়, নারচি রিকশা স্ট্যান্ডের উত্তর পাশ দিয়ে একটি রাস্তা দৌলতপুর উপজেলার বিষ্ণপুরের দিকে চলে গেছে, আর দক্ষিণ পাশের রাস্তা নারচি গ্রামে গেছে। স্থানীয়রা এই এলাকাকে ‘ছোট রঘুনাথপুর’ নামেও চেনেন। রিকশা স্ট্যান্ড লাগোয়া টিনের একটি লম্বা ছাপড়া ঘরের পশ্চিম পাশের দোকানটি ভাড়া নিয়ে সন্দেশ তৈরির কারখানা চালাচ্ছেন মওলা মিয়া।

ছাপড়ার পেছনে কারখানাটি গড়ে তোলা হয়েছে। দোকানের ভেতরে ও কারখানার পাশে ছোট-বড় একাধিক ড্রামে বিভিন্ন মিষ্টির দোকান থেকে সংগ্রহ করা পঁচা গাদ রাখা হয়েছে। পাশেই রয়েছে চুলা জ্বালানোর লাকড়ি। কারখানার প্রবেশপথটি টিনের ঝাপ দিয়ে আটকানো, বাইরে থেকে বোঝার উপায় নেই যে ভিতরে সন্দেশ তৈরির কারখানা রয়েছে। তবে স্থানীয়রা বিষয়টি সম্পর্কে সচেতন।

কারখানায় গিয়ে দেখা যায়, মওলা মিয়া চুলায় মিষ্টির পঁচা গাদ জ্বালাচ্ছেন। পাশেই এক শ্রমিক বড় দুটি ড্রামে রাখা গাদ ছেঁকে নিচ্ছেন। ছাপড়ার ভেতরে এক শ্রমিক সন্দেশ তৈরি করছেন, আরেকজন সেগুলো প্যাকেট করছেন। পাশে মিষ্টির গাদ রাখা ড্রামগুলো চেটে খাচ্ছে একটি কুকুর!

ভেজাল সন্দেশের সরবরাহ চক্র

মওলা মিয়া বলেন, “কি করে খামু? শিখছি এই কাজ। পেট তো চালাতে হবে।”

তার ছেলে মনির জানান, জেলার বিভিন্ন মিষ্টির দোকান থেকে পঁচা গাদ সংগ্রহ করেন তিনি। গাদ সংগ্রহের জন্য একটি নির্দিষ্ট সময়সূচি মেনে চলা হয়। প্রতিটি দোকান থেকে প্রতি ১০ দিন অন্তর মিষ্টির গাদ সংগ্রহ করা হয়। এক ড্রাম গাদের দাম ১,৫০০ থেকে ২,০০০ টাকা, যেখানে প্রতি ড্রামে ৬০ কেজি গাদ থাকে। অর্থাৎ, প্রতি কেজি গাদের খরচ পড়ে ৩৫ টাকার মতো।

মনির আরও জানান, গাজীপুর, ফরিদপুর, উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জেলা ও খুলনা এলাকায় তারা এসব সন্দেশ সরবরাহ করেন। বিভিন্ন কুরিয়ারের মাধ্যমে সন্দেশ পাঠানো হয় এবং লেনদেন করা হয় বিকাশ ও নগদের মাধ্যমে।

প্রশাসনের পদক্ষেপ

বিষয়টি নিয়ে ঘিওর উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা আসমা সুলতানা নাসরীনের মোবাইল ফোনে একাধিকবার কল করা হলেও তিনি রিসিভ করেননি।

তবে মানিকগঞ্জের জেলা প্রশাসক ড. মানোয়ার হোসেন মোল্লা বলেন, “ভেজাল সন্দেশ তৈরির কারখানার বিরুদ্ধে দ্রুত অভিযান চালিয়ে আইনি ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।”