logo
আপডেট : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ১০:৫১
নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে
নিখিল মানখিন

নিরপেক্ষতা প্রশ্নের মুখে

অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকে বারবার আলোচনায় উঠে এসেছেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সম্মেলন এবং কূটনৈতিক তৎপরতায় নিজের দক্ষতা ও যোগ্যতা মেলে ধরে বাংলাদেশকে বিশ্বের উচ্চ শিখরে বসিয়েছেন তিনি। এবার ‘ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন’ শীর্ষক নতুন এক ইস্যুতে তার বক্তব্য ঘিরে চলছে জোর আলোচনা। রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, সরকার ও সমন্বয়কদের মধ্যে গভীর সখ্যতা ও বোঝাপড়া থাকার বিষয়টি বিভিন্ন সময় নানাভাবে উঠে এসেছে। এখন যে অন্তর্বর্তী সরকার, সেটি ছাত্র আন্দোলনের হাত ধরে এসেছে। সরকারের উপদেষ্টামণ্ডলীতে তাদের তিনজন আছেন। স্বাভাবিকভাবেই স্বার্থের দ্বন্দ্বে ক্ষমতায় থেকে ছাত্রদের দল তৈরির এই উদ্যোগ নিয়ে প্রধান উপদেষ্টার পূর্ব অবগত থাকা এবং সমর্থনের বিষয়টি নানাভাবে প্রকাশ পেয়েছে। তাই এক্ষেত্রে অন্তর্বর্তী সরকার বিশেষ করে প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্য নিয়ে প্রশ্ন তুলছেন অনেকে।

রাজনৈতিক বিশ্লেষক এবং বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা বলছেন, ছাত্ররা যে কিংস পার্টি গড়তে যাচ্ছে তাতে ড. ইউনূসের সমর্থন রয়েছে, এটি তার বক্তব্যে প্রমাণিত হয়েছে। প্রধান উপদেষ্টা ড. ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকারের নিরপেক্ষতাকে এতে করে আরও প্রশ্নবিদ্ধ করেছে। রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল গঠিত হলে জনগণ হতাশ হবে। ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন করতে সুযোগ করে দেওয়ার ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা রাখেন না। প্রটোকল দেবেন, তাদের পুলিশ প্রটেকশন দেবেন, তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেবেন? কি সুযোগ দেবেন? রাজনীতি করলে বেরিয়ে আসবেন। জনগণ যাদের সমর্থন দেবে, তারা ক্ষমতায় যাবেন এবং তাদের মতো করে দেশ গড়বেন। কেউ তো বাধা দেয়নি। সবাই স্বাগত জানিয়েছে। কিন্তু এক্ষেত্রে প্রধান উপদেষ্টার সমর্থনসূচক বক্তব্য দেওয়ার কোনো সুযোগ নেই বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা।

ব্রিটিশ সংবাদমাধ্যম ফিনান্সিয়াল টাইমসকে প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘একটি সম্ভাবনা হলো, ছাত্ররা নিজেরাই একটি দল গঠন করবে। শুরুতে যখন তারা উপদেষ্টা পরিষদ গঠন করছে, তখন আমি তিনজন ছাত্রকে আমার উপদেষ্টা পরিষদে নিয়েছিলাম। আমি বলেছিলাম, যদি তারা দেশকে ‘প্রাণ’ দিতে পারে, তাহলে তারা উপদেষ্টা পরিষদে বসতে পারে এবং প্রাণ দেওয়ার জন্য কী করছে, সে বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিতে পারে। তারা ভালো কাজ করছে। পুরো জাতি তাদেরকে চেনে। তারা যা করতে চায়, সে বিষয়ে তাদেরকে একটা সুযোগ দিই।’

তিনি আরও বলেন, ‘রক্ত দিয়ে তারা যেগুলো অর্জন করেছে, সেগুলো তাদেরকে রক্ষা করতে হবে। অন্যথায় সেগুলো সেই সব ব্যক্তি নিয়ে যাবে, যারা বিগত প্রশাসন ও অন্যান্যের মতো সব কিছুর পুনরাবৃত্তি করার সুযোগ খুঁজছে। এটাই বাংলাদেশে আমাদের রাজনৈতিক পরিবেশ। সুতরাং তারা এটা রক্ষা করার চেষ্টা করছে। তাই আমি বলবো, ছাত্রদের স্বচ্ছ অভিপ্রায় থাকবে। তাদের ব্যাপারে যা বোঝার তা সবাই বুঝে গেছে।’

ছাত্রদের রাজনৈতি দল গঠন সম্পর্কে অধ্যাপক ইউনূস এই প্রথম কথা বললেও দল গঠনের প্রক্রিয়া ছাত্ররা আরো অনেক আগেই শুরু করেছে। ছাত্রদের মধ্য থেকে দুই উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম ও আসিফ মাহমুদের পদত্যাগের কথা শোনা যাচ্ছে নতুন দলে যোগ দেওয়ার জন্য। তবে এ ধরনের কোনো সিদ্ধান্ত তারা এখনো নেননি বলে ইতোমধ্যে জানিয়েছেন উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম।

ফেব্রুয়ারির মধ্যেই ছাত্রদের নতুন রাজনৈতিক দলের আত্মপ্রকাশের কথা আছে। নতুন দল গঠনে কাজ করছে দুইটি সংগঠন- বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন এবং জাতীয় নাগরিক কমিটি। এখান থেকেই তারা নতুন রাজনৈতিক দলে যোগ দেবেন। জাতীয় নাগরিক কমিটি এ পর্যন্ত ৩২৮টি থানা কমিটি করেছে। তারা ওয়ার্ড কমিটির কাজও করেছেন। সব থানা কমিটি করার পর জেলা কমিটি করা হবে। তারপর জাতীয় কমিটি।

ছাত্রদের দল গঠনের বিষয়ে ড. ইউনূসের বক্তব্য সম্পর্কে জাতীয় নাগরিক কমিটির যুগ্ম আহ্বায়ক মনিরা শারমিন বলেন, ‘প্রধান উপদেষ্টা ছাত্রদের রাজনৈতিক দলের ব্যাপারে ওনার মতো করে বলেছেন। উনি ছাত্রদের নতুন দল করা, তরুণদের নতুন দল করার কথা বলেছেন। স্বাভাবিকভাবেই এটা আমাদের উৎসাহিত করছে। এটা আমাদের ভালোই লেগেছে। উনি তো সবসময়ই তরুণদের উৎসাহিত করে আসছেন। ছাত্রদের রাজনৈতিক দল করার ক্ষেত্রে বড় রাজনৈতিক দলগুলোর একটা কার্পণ্য আছে। ওনার (ড. ইউনূস) থেকে আমরা সেটা দেখতে পাইনি। সেটা আমাদের সতিই ভালো লাগছে।’

সমালোচনায় দলের নেতারা

রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় রাজনৈতিক দল গঠিত হলে জনগণ হতাশ হবে বলে মন্তব্য করেছেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। তিনি বলেন, বিএনপি নতুন রাজনৈতিক দল গঠনকে স্বাগত জানায়। তবে রাষ্ট্রীয় পৃষ্ঠপোষকতায় দল গঠন করতে গিয়ে সরকার ও প্রশাসনের সহযোগিতা নিলে জনগণ হতাশ হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘অন্য রাজনৈতিক দলের প্রতি তাদের আচরণ কিংবা বক্তব্য, মন্তব্য যদি ঝগড়াসুলভ কিংবা প্রতিহিংসামূলক হয় সেটিও জনগণের কাছে হবে অনাকাক্সিক্ষত।’

তরুণরা প্রশ্নবিদ্ধ পথে না গিয়ে, স্বচ্ছ পথে সামনের দিকে এগিয়ে যাবে বলে আশা প্রকাশ করেন বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান। গত ২৫ জানুয়ারি বিকেলে রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশন মিলনায়তনে আয়োজিত জাতীয় শিক্ষক দিবস ও শিক্ষক সমাবেশে ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এ মন্তব্য করেন।

ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন করতে সুযোগ করে দেওয়ার ক্ষমতা অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস রাখেন না বলে মন্তব্য করেছেন নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না। বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস সুযোগ করে দেয়ার ক্ষমতা রাখেন যদি তিনি ক্ষমতাকে অপব্যবহার করেন। তা ছাড়া কী সুযোগ করে দেবেন বলেও প্রশ্ন রাখেন মান্না।

তিনি বলেন, প্রটোকল দেবেন, তাদের পুলিশ প্রটেকশন দেবেন, তাদের অন্যান্য সুযোগ-সুবিধা দেবেন? কি সুযোগ দেবেন? রাজনীতি করলে বেরিয়ে আসবেন। জনগণ যাদের সমর্থন দেবে, তারা ক্ষমতায় যাবেন এবং তাদের মতো করে দেশ গড়বেন। কেউ তো বাধা দেয়নি। সবাই স্বাগত জানিয়েছে।

মান্না আরও বলেন, ছাত্ররা মিলেই দল করবে, ছাত্রদের তো একটাই গ্রুপ না। আরও অনেক ছাত্র সংগঠন আছে। তাদের দল যদি তারা গড়ে তুলতে চায়? তাদেরকেও তিনি সুযোগ দেবেন? এটা বলে ড. মুহাম্মদ ইউনূস মহা একটা ভুল কাজ করেছেন, আমি মনে করি। উনি ক্ষমতায় থেকে, ক্ষমতার সর্বোচ্চ শিখরে থেকে, এটা বলতে পারেন না- আমি তাদের সুযোগ করে দিতে চাই। তাহলে তো ক্ষমতায় থেকে ক্ষমতায় যারা আছেন তাদের সুযোগ করে দেবেন। এটা ঠিক হয় নাই। আমি মনে করি, তাদের যদি ভেতরে ভেতরে থাকে যে কিংস পার্টি করে তারা দেশ বদলাবেন, ওই ভাবে দেশ বদলাবে না।

বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাউদ্দিন আহমেদ বলেন, ‘তাদের ব্যাপারে যা বোঝার তা সবাই বুঝে গেছে। উপদেষ্টা বলেন, আর জাতীয় নাগরিক কমিটি বা বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন- তারা সবাই এক। রসুনের গোড়া সব এক জায়গায়।’

তিনি আরও বলেন, ‘তারা রাজনৈতিক দল গঠন করলে তো কারুর আপত্তি থাকার কথা নয়। আমরাও স্বাগত জানাই। কিন্তু সেটা যদি কিংস পার্টি হয়, তাহলে তো গ্রহণযোগ্য হবে না। সরকারে থেকে, সরকারের সুবিধা নিয়ে রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে তো প্রশ্ন উঠেছে। আর প্রধান উপদেষ্টা ছাত্রদের রাজনৈতিক দল গঠন নিয়ে সর্বশেষ যা বলেছেন, তাতে তো বৈষম্য তৈরি হয়েছে। তিনি তো একক কোনো গোষ্ঠী বা দলের নন। তিনি তো সবার। আগে তিনি বলেছেন, ছাত্ররা তাকে ক্ষমতায় বসিয়েছে। ছাত্রদের আন্দোলনে সবার অংশগ্রহণ আছে। তিনি তো একক কাউকে কৃতিত্ব দিতে পারেন না। আমরা তখন মনে করেছিলাম, তিনি আবেগে বলেছেন। কিন্তু এখন দেখছি তিনি তা মিন করছেন। তিনি বৈষম্য সৃষ্টি করছেন।’

২৪-এর আন্দোলন একটা গোষ্ঠী চুরি করেছে অভিযোগ করে গণঅধিকার পরিষদের সাধারণ সম্পাদক রাশেদ খান বলেছেন, এই কাজে সহায়তা করেছেন অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। রাশেদ বলেন, ‘ছাত্ররা এখন কিংস পার্টি গঠন করছে, ড. ইউনূস সেই দলের ব্র্যান্ড অ্যাম্বাসেডর।’

গত ২ জানুয়ারি ‘বাংলাদেশের পার্বত্য চট্টগ্রাম সমস্যা : উত্তরণে রাজনৈতিক ভাবনা’ শিরোনামে জাতীয় প্রেস ক্লাবে আয়োজিত এক আলোচনা সভায় তিনি এই মন্তব্য করেন।