logo
আপডেট : ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ১১:১৩
পান্ডুলিপিতে পুলিশিং কেন করতে হবে
নিজস্ব প্রতিবেদক

পান্ডুলিপিতে পুলিশিং কেন করতে হবে

পৃথিবীর ইতিহাসে কোনো দেশের পুলিশ এরকম মন্তব্য করেছে কি না, জানি না! বাংলাদেশের পুলিশ সেই বিস্ময়কর মন্তব্য করলেন, বই প্রকাশের আগেই পাণ্ডুলিপি যাচাই করুক বাংলা একাডেমি। গত শুক্রবার ঢাকার সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে এবারের বইমেলার নিরাপত্তা পরিস্থিতি পর্যবেক্ষণ শেষে ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) কমিশনার শেখ মো. সাজ্জাত আলী সাংবাদিকদের কাছে এই মন্তব্য করেন। তার মন্তব্য শুনে দেশের কবি-সাহিত্যিকরা সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে লিখছেন, তার এই মন্তব্য কি দুঃখজনক, না কি হাস্যকর বুঝতে পারছি না। অনেকে লিখছেন, তাহলে কি আওয়ামী লীগ আমলের পুলিশই এখনো রয়ে গেল!

গত শনিবার সংবাদমাধ্যমে প্রাপ্ত খবরে জানা যায়, অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে- এমন বিষয়বস্তু (কনটেন্ট) ঠেকাতে মেলায় বই প্রকাশের আগেই পাণ্ডুলিপি যাচাই করতে বাংলা একাডেমিকে বলেছে পুলিশ। ঢাকা মহানগর পুলিশ (ডিএমপি) চাইছে, ২০২৬ সালের একুশে বইমেলা থেকে এই ব্যবস্থা চালু করা হোক।

পুলিশের উদ্দেশ্য হয়তো সৎ; কিন্তু এখানে সমস্যা অনেক। এক. বইমেলার তিন-চার মাস আগে থেকে শুরু করে মেলার মাসজুড়েই বই প্রকাশ হয়। প্রায় ৪ হাজার বইয়ের রিভিউ করা বাংলা একাডেমির পক্ষে প্রায় অসম্ভব। দুই. অস্থিতিশীল পরিস্থিতি তৈরি করতে পারে এমন মানদণ্ড কীসের ভিত্তিতে নির্ধারিত হবে? ধর্ম-রাজনীতি, দর্শন-ইতিহাস, বিজ্ঞান- যে কোনো বিষয়ই বিতর্ক সৃষ্টি করতে পারে। জ্ঞানের আলোচনা মানেই বিতার্কিক। প্রকৃত জ্ঞান সব সময়ই নতুন চিন্তাকে উসকে দেয়, তাতে কোনো বিশেষ মহলের অপ্রিয় হতেই পারে- তাকে কীভাবে প্রতিহত করা সম্ভব? তাহলে কি লেখক কেবল প্রেমের উপন্যাস লিখবেন? ধর্মীয় কাহিনি লিখবেন? রাজনীতি-ইতিহাস-দর্শন যে কোনো বিষয় নিয়েই লেখক নতুন চিন্তার আগুন জ্বালাতে পারেন। বই মানেই চিন্তার বিস্ফোরণ। সেটাকে কোনো যুক্তিতে ঠেকানো মানে নদীর স্রোত বাঁধ দিয়ে আটকানো।

এমনিতেই আমাদের সমাজ পশ্চাদপদ। নতুন চিন্তার কোনো দিকনির্দেশনা আমাদের সমাজে নেই। প্রতিটি বইমেলাতেই অজস্র বই প্রকাশিত হয় পূর্ববর্তী চিন্তার চর্বিতচর্বন রূপে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার আমলে আমাদের কবি-সাহিত্যিকরা প্রাণ খুলে লিখতে পারতেন না। লেখার জন্য আমাদের দেশের অনেক লেখককে জেল খাটতে হয়েছে, জীবন দিতে হয়েছে। লেখকরা আশা করেছিলেন, ফ্যাসিস্ট সরকার বিদায় হওয়ার পর এ অবস্থার পরিবর্তন হবে; কিন্তু পুলিশের মন্তব্য শুনে অনেক লেখক বলছেন, তাহলে কি আগের ব্যবস্থাই এখনো বহাল রয়ে গেছে?

লেখকদের কাজ সত্য অনুসন্ধান এবং আপন কাজে লেখকমাত্রই স্বাধীন। পৃথিবীর কোনো আইন তাকে বেঁধে রাখতে পারে না। তাহলে সমাজ-সভ্যতা আজকের পর্যায়ে উন্নীত হতো না। আজকের এই সভ্যতা গড়ে ওঠার পেছনে অনেক লেখকের রক্ত ঝরেছে। বাংলাদেশের পুলিশ কি বাংলাদেশকে সেই পশ্চাৎপদতার দিকেই আটকে রাখতে চায়? পুলিশ যে মন্তব্যটা করেছে তা শুধু দুঃখজনক বা হাস্যকর নয়, তা অত্যন্ত ঔদ্ধত্যপূর্ণ। কোনো দেশের পুলিশই বই প্রকাশ নিয়ে এমন মন্তব্য করতে পারেন না।

যদি সত্যিই অস্থিতিশীল পরিস্থিতির সৃষ্টি হয়, তাহলে পুলিশ কী করবে? পুলিশ সেই অস্থিতিশীল পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণ করবে। লেখকের নিরাপত্তা দেবেন। মাথাব্যথা করবে বলে মাথা কেটে ফেলার পরামর্শ দেয়া পুলিশের কাজ নয়। আমরা আশা করব, বাংলাদেশের পুলিশ তাদের মন্তব্যে আরও কাণ্ডজ্ঞানের পরিচয় দেবেন। সরকারেও উচিত পুলিশের এই আগ বাড়িয়ে অহেতুক পরামর্শ দেয়ার বিষয়ে সাবধান করা। বাংলা একাডেমি একটা স্বায়ত্তশাসিত প্রতিষ্ঠান, বাংলা একাডেমিকে পরামর্শ দেয়া পুলিশের কাজ নয়।