logo
আপডেট : ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ ১৩:০৬
অন্তর্বর্তী সরকারের ছয়মাস কারো মুখে হাসি নেই
এম. সাইফুল ইসলাম

অন্তর্বর্তী সরকারের ছয়মাস
কারো মুখে হাসি নেই

নানা সঙ্কট আর চ্যালেঞ্জে গতকাল শুক্রবার ছয়মাস পূর্র্ণ করল অন্তর্বর্তী সরকার। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর গঠিত এ সরকারের বেশ কয়েকটি পদক্ষেপ ইতিবাচক হলেও বিপরীতে ব্যর্থতার পাল্লাও কম নয় বলে মনে করছেন বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষ। খোদ জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী থেকে শুরু করে কারো মুখে হাসি নেই। সরকারের অবস্থানও তাদের কাছে পরিষ্কার নয়। তারা বলছেন, নানা সেক্টরের দাবি আদায়ের নামে অর্থনীতিতে স্থিতিশীলতা ফিরিয়ে আনার চেষ্টা, কূটনৈতিক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা ছিল আলোচনায়। আর রাষ্ট্রের বিভিন্ন সেক্টরের সংস্কার কাজ এগিয়ে নেওয়ার চেষ্টা যদি বাস্তবায়ন সম্ভব হয় তাহলে সেটিও মাইলফলক হতে পারে। তবে, দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণ, গত ১৫ বছরে অনিময়, দুর্নীতির সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে কার্যকর ব্যবস্থা না নেওয়া, প্রশাসনের বিভিন্ন স্তরে এখনো আওয়ামী লীগের সুবিধাভোগীরা বহাল থাকা এবং আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি না হওয়ায় ব্যাপক ক্ষোভ রয়েছে জনসাধারণের মাঝে। যেকারণে একটি নির্বাচিত সরকারের দাবি ক্রমেই জোরালো হয়ে উঠছে।

বিশ্লেষকরা বলছেন, বিগত প্রায় ১৫ বছরে গণতন্ত্রহীনতা, অপশাসন ও দুর্নীতিতে দেশে যে নাজুক অবস্থা বিরাজ করছে তা উত্তরণে ছয় মাস আসলে বেশি সময় নয়। তবে, সরকারের অবস্থান ঘোলাটে। তাদের চিন্তা চেতনায় কোনো ‘ডায়নামিজম’ নেই। তারা বলছেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন মানুষ সরকার প্রধান এটি একটি ইতিবাচক দিক। তবে, তার সরকারের গৃহীত বেশিরভাগ পদক্ষেপকে তারা ফলপ্রসূ মনে করছেন না।

জানা গেছে, ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানের ফলাফলে শেষ পর্যন্ত ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট ক্ষমতাচ্যুত হন আওয়ামী লীগ সরকার। ওইদিন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ক্ষমতা ছেড়ে ভারতে চলে যান। এরপর ৮ আগস্ট নোবেলজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে গঠিত হয় অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। সেই হিসেবে গতকাল সরকারের ছয় মাস পূর্ণ হয়েছে। ছয় মাসে সরকারের কর্মকাণ্ড কী ছিল বা তাদের পদক্ষেপ কতটুকু কাজে এসেছে তা নিয়ে এখন চলছে চুলচেরা বিশ্লেষণ।

বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, সরকার গঠনের পর থেকে একটার পর একটা বিশেষ পরিস্থিতি সৃষ্টি হতে থাকে। প্রথমত এ সরকার গঠনের পর সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জে পড়ে পুলিশকে নিয়ে। কারণ, জুলাই বিল্পবের পর মনোবল ভেঙে যাওয়া পুলিশ বেশ কয়েকদিন কর্মস্থলে অনুপস্থিত ছিল। ফলে, আইনশৃঙ্খলা একেবারে ভেঙে পড়ে। তখন সরকার সেনাবাহিনীকে বিশেষ দায়িত্ব দিয়ে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করলেও তাতে পুরোপুরি সফলতা আসেনি। এরপর প্রতিদিন কোনো না কোনো সেক্টরের নানা দাবিতে আন্দোলন শুরু হয়। সবচেয়ে বেশি আলোচনায় আসে আনসারদের আন্দোলন। তারা দাবি আদায়ের নামে সচিবালয়ে হামলা ও ভাঙচুর চালায়। এছাড়া ব্যাটারিচালিত অটোরিকশা চালকরা লাগাতার রাস্তা অবরোধ করে আন্দোলন করে আলোচনায় আসে। মূলত এসব আন্দোলনের পেছনে ছিল ‘আওয়ামী লীগের’ অপতৎপরতা। এছাড়া প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়ের সামনেও প্রতিদিন কোনো না কোনো আন্দোলন শুরু হয়; যা সরকার জুলাই বিপ্লবে অংশগ্রহণকারী ছাত্র-জনতাকে সঙ্গে নিয়ে বেশ ঠান্ডা মাথায় পরিস্থিতি মোকাবিলা করে।

এছাড়াও ইসকনের বহিষ্কৃত নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাসকে গ্রেপ্তারের ঘটনায় পার্শ্ববর্তী রাষ্ট্র ভারত বেশ প্রতিক্রিয়াশীল হয়। যার জের ধরে ভারতে বাংলাদেশের উপ-হাইকমিশনে ভাঙচুর ও হামলা চালানো হয়। এরপর থেকে সীমান্তেও উত্তেজনা শুরু হতে থাকে। এসব বিষয়ে বাংলাদেশও কড়া প্রতিক্রিয়া জানায়। এছাড়াও নির্বাচন ও সংস্কার প্রশ্নেও দেশের রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে বেশ আলোচনা তৈরি হতে শুরু করে। নির্বাচনের রোডম্যাপ প্রশ্নেও চাপ বাড়তে থাকে। নির্বাচনের আগে সংস্কার নিয়েও রাজনৈতিক দলগুলো দ্বিধাবিভক্ত হয়ে পড়ে। বিশেষ করে বড় রাজনৈতিক দল বিএনপি দ্রুত নির্বাচনের কথা বললেও জামায়াতসহ কয়েকটি ইসলামী দল সংস্কারের পরে নির্বাচনের কথা বলতে থাকে। এছাড়া রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যু নিয়ে রাজনৈতিক টানাপড়েন সৃষ্টি হয়। সাংবিধানিক শূন্যতার কথা ভেবে বিএনপি যার বিরোধিতা করে। শেষ পর্যন্ত সে আলোচনা থেমে যায়।

তবে, নানা আলোচনা থাকলেও রাষ্ট্রে বিভিন্ন কাঠামো সংস্কারের গঠিত ১১টি কমিশন ইতিবাচক আলোচনায় আসে। ন্যূনতম সংস্কার বাস্তবায়ন করতে পারলেও সেটি সরকারে ইতিবাচক পদক্ষেপ হিসেবে মাইলফলক সৃষ্টি করতে পারে।

ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনার পতনের পর একটি ভঙ্গুর অর্থনৈতিক পরিস্থিতির মধ্যে দায়িত্ব নেয় ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তর্বর্তী সরকার। দায়িত্ব গ্রহণের পর গত ৬ মাসে অর্থনীতি পুনরুদ্ধারের নানা উদ্যোগ নিয়েছে সরকার। এতে ব্যাংক খাতে শৃঙ্খলা ফিরেছে, থেমেছে রিজার্ভে পতন। কিন্তু দুশ্চিন্তা বাড়াচ্ছে রাজস্ব আয়ে ঘাটতি, বিদেশি বিনিয়োগে স্থবিরতা ও কর্মসংস্থান সৃষ্টি না হওয়া। শিল্পের মূলধনি যন্ত্রপাতির আমদানি কমে যাওয়ায় উৎপাদন খাতেও স্থবিরতা চলছে। সব মিলিয়ে কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পার হয়েছে বর্তমান সরকারের ছয় মাস।

বেসরকারি গবেষণা প্রতিষ্ঠান সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) বিশেষ ফেলো অর্থনীতিবিদ ড. মোস্তাফিজুর রহমান মনে করেন, বৈশ্বিক অস্থিরতা ও দেশীয় সংকটের চাপ কাটিয়ে এখনো উঠতে পারেনি অর্থনীতি। রপ্তানি প্রবৃদ্ধির ধারা অব্যাহত থাকলেও উচ্চ মূল্যস্ফীতি এখনো নিয়ন্ত্রণের বাইরে।

প্রবাসী আয় রিজার্ভে কিছুটা স্থিতিশীলতা এনেছে, তবে রাজস্ব ঘাটতি বড় উদ্বেগের কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। বৈদেশিক ঋণ প্রত্যাশিত হারে আসছে না, অথচ সুদ পরিশোধের ব্যয় বেড়েছে। এতে নিয়মিত সরকারি কার্যক্রম ও উন্নয়ন প্রকল্প বাস্তবায়ন ব্যাহত হচ্ছে। ব্যাংক খাতে কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন এসেছে, তবে তারল্যসংকট ও বিনিয়োগ অনিশ্চয়তা কাটেনি।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও রাজনীতি বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক ড. দিলারা চৌধুরী দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, বর্তমান সরকারের প্রধান উপদেষ্টার ড. মুহাম্মদ ইউনূসের মতো একজন মানুষ সরকারে এসেছে এটিই আমাদের জন্যে একটা বড় পাওয়া। তার কারণে বিশেষ করে ইন্ডিয়া অনেক কিছু চাইলেও এখানে করতে পারছে না। পশ্চিমারা তাকে বাদ দিয়ে কিছু ভাবছে না। তবে, সরকারের মধ্যে কোনো রকম ‘ডায়নামিজম নেই’। তিনি বলেন, আমার ঘরে আগুন লেগেছে সেটি না নিভিয়ে আলোচনা কেন? সরকার কোনোভাবেই কার্যকর পদক্ষেপ নিতে পারছে না। বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষের অবস্থা তুলে ধরে তিনি বলেন, মানুষ আশা করেছিল একটা বিপ্লবী সরকার পাবেন। কিন্তু বাস্তবে হয়েছে তার বিপরীত। ধীরগতি সম্পন্ন। সংস্কার কমিশন গঠন করেছে। তারা বারবার টাইমক্ষেপণ করছেন। নির্বাচন কবে সেটি মানুষ জানতে চায়। সরকারের সেদিকে মনোযোগ নেই। আসলে তারা কী করতে চায় সেটি স্পষ্ট নয়।

বিএনপির ভাইস-চেয়ারম্যান শামসুজ্জামান দুদু দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারের কোনো কিছুতেই নিয়ন্ত্রণ নেই। টালমাটাল অবস্থা। তাদের কোনো সফলতা আমি দেখি না। যত দ্রুত সম্ভব একটি নির্বাচন দিয়ে বিদায় নিতে পারাটা তাদের জন্য মঙ্গল বলেও মনে করেন এই বিএনপি নেতা।

জামায়াতে ইসলামীর সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল মাওলানা আব্দুল হালিম এ বিষয়ে বলেছেন, আওয়ামী লীগ দেশকে যে অবস্থায় রেখে গেছে সেখান থেকে একদিনে কেউ ভালো করতে পারবে না। সরকার চেষ্টা করেছে। অনেকে ক্ষত্রে সফল আবার কিছু ক্ষেত্রে তারা চেষ্টা করেও পারেনি। একেবারেই ব্যর্থ সেটি আমি মনে করি না।

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সমন্বয়ক আব্দুল কাদের দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, সরকারের মধ্যে বিপ্লবী ভাব কম। চয় মাসেও আওয়ামী লীগের দোসরদের কোনো ব্যবস্থা নিতে পারেনি সরকার। প্রশাসন অনেক ক্ষেত্রে নড়বড়ে। তারপরও দেশে স্থিতিশীলতা বজায় রাখা ও ভারতীয় আধিপত্যবাদের বিরুদ্ধে লড়াইয়ে সরকার শক্ত অবস্থানে রয়েছে।

যুক্তফোরামের কেবিনেট প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সমন্বয়ক সরদার শামস আল-মামুন (চাষি মামুন) দৈনিক ভোরের আকাশকে বলেন, আসলে সরকারের সফলতা বা ব্যর্থতা বলার আগে আমাদের বুঝতে হবেÑ এটা বিপ্লবী সরকার নয়। শুরুতেই গলদ অর্থাৎ সরকার গঠন প্রক্রিয়ায় ভুল ছিল। শুরুতেই তারা নিরপেক্ষতা হারিয়েছে। সবাইকে নিয়ে একটি জাতীয় সরকার গঠন করতে পারলে অনেক কিছু করা সম্ভব ছিল। এই সরকার সংস্কার কমিশন থেকে শুরু করে; যা কিছু করার চেষ্টা করছে সেটি জাতীয় সরকার ছাড়া পুরোপুরি বাস্তবায়ন সম্ভব নয়। সরকারের সফলতা তেমন নেয় বলেও দাবি এই বিশ্লেষকের। তিনি বলেন, তাদের ব্যর্থতার কারণে জাতীয় নির্বাচনের দাবি জোরালো হচ্ছে।

 

ভোরের আকাশ/মি