-->
শিরোনাম

চীন কি গরিব দেশকে ঋণের জালে জড়াচ্ছে

নিজস্ব প্রতিবেদক
চীন কি গরিব দেশকে ঋণের জালে জড়াচ্ছে

দরিদ্র দেশগুলোতে চীনের ঋণ দেওয়ার পদ্ধতি সারা বিশ্বে সমালোচনার সম্মুখীন হচ্ছে। কারণ ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে চীনের বিভিন্ন চাপে পড়ছে গ্রহীতা দেশগুলো।

চীন এই অভিযোগ প্রত্যাখ্যান করে বলছে, পশ্চিমা দেশগুলো চীনের ভাবমূর্তি বহির্বিশ্বের কাছে নষ্ট কারার জন্য এসব কথা বলে বেড়াচ্ছে। দেশটি বলছে, বিশ্বে একটাও দেশ নেই- যারা চীনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে ‘কথিত ঋণের’ ফাঁদে পড়েছে।

চীনের ঋণ নিয়ে আমরা কতটুকু জানি?

চীন বিশ্বের বৃহত্তম একক ঋণদাতা দেশগুলোর মধ্যে একটি। গত এক দশকে চীন নিম্ন ও মধ্যম আয়ের দেশগুলোতে ঋণের পরিমাণ তিনগুণ বাড়িয়েছে এবং ২০২০ সালের শেষ নাগাদ ১৭০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছেছে। কিন্তু চীনের সামগ্রিক প্রতিশ্রুত ঋণের পরিমাণ এই ১৭০ বিলিয়ন ডলালের চেয়ে বেশি।

যুক্তরাষ্ট্রের উইলিয়াম অ্যান্ড মেরি ইউনিভার্সিটির গবেষণা সংস্থা এইডডেটা বলছে, উন্নয়নশীল দেশগুলোতে চীনের দেওয়া ঋণের অর্ধেকই সরকারি পরিসংখ্যানে পাওয়া যায় না।

এইডডেটার তথ্য অনুসারে বিশ্বের ৪০টিরও বেশি নিম্ন এবং মধ্যম আয়ের দেশে তাদের বার্ষিক জিডিপির ১০ ভাগ চীনের ঋণের ওপর নির্ভরশীল এবং এসব ঋণ গোপন রাখা হয়। জিবুতি, লাওস, জাম্বিয়া এবং কিরগিজস্তানের বার্ষিক জিডিপির অন্তত ২০ শতাংশের সমপরিমাণ ঋণ রয়েছে চীনের কাছে।

এসব ঋণের বেশিরভাগই রাস্তা, রেলপথ, বন্দর এবং খনি ও জ্বালানি শিল্পের মতো বড় অবকাঠামো প্রকল্পের বিনিয়োগ করা হয়েছে। এসব বড় প্রকল্প প্রেসিডেন্ট শি জিনপিংয়ের বেল্ট অ্যান্ড রোড প্রকল্পের অধীনে বাস্তবায়ন করা হচ্ছে।

ঋণ ফাঁদ কি এবং কি তার আলামত

বিবিসির সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে ব্রিটিশ গোয়েন্দা সংস্থা এমআই-৬-এর প্রধান রিচার্ড মুর বলেছেন, চীন অন্য দেশের ওপর প্রভাব বিস্তারের জন্য এই ‘ঋণের ফাঁদ’ ব্যবহার করে।

এই ‘ঋণ ফাঁদের’ পক্ষে জোরালো যুক্তি হল, চীন প্রথমে বিভিন্ন দেশকে অর্থ দেয় এবং সেই ঋণ পরিশোধে ব্যর্থ হলে ঋণ গ্রহীতা দেশের গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনাগুলো দখল করে নেয়। যদিও বেইজিং এই অভিযোগ অস্বীকার করে আসছে।

চীনের সমালোচকরা ‘ঋণ ফাঁদের’ একটি ঘটনা প্রায়ই সামনে আনেন। তা হলো চীনের অর্থায়নে শ্রীলঙ্কার হাম্বানটোটায় একটি বিশাল বন্দর প্রকল্প। শ্রীলঙ্কা অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হয়ে চীনের কাছে ৯৯ বছরের জন্য বন্দরটি লিজ দিতে বাধ্য হয়।

যুক্তরাজ্যভিত্তিক থিংক ট্যাংক চ্যাথাম হাউস এই বন্দর প্রকল্প বিশ্লেষণ করেছে। তাদের প্রশ্ন, এই প্রকল্প আদৌ চীনের ঋণ ফাঁদ কিনা? কারণ স্থানীয় রাজনীতিবিদরা চুক্তিটি করেন। চীন আনুষ্ঠানিকভাবে কখনই বন্দরের মালিকানা দাবি করেনি।

চ্যাথাম হাউস আরো বলেছে, শ্রীলঙ্কার সামগ্রিক ঋণের একটি বড় অংশ চীনের বাইরে থেকে নেওয়া এবং এখন পর্যন্ত এমন কোনো প্রমাণ পাওয়া যায়নি যে, এই বন্দর থেকে চীন সামরিক ক্ষেত্রে কোনো বিশেষ সুবিধা পেয়েছে।

তা সত্ত্বেও, বিগত এক দশকে শ্রীলঙ্কায় চীনের অর্থনৈতিক সম্পৃক্ততা বেড়েছে, যা এই অঞ্চলে তার রাজনৈতিক উচ্চাকাঙ্ক্ষাকে চরিতার্থ করতে সাহায্য করবে। বিশ্বের অন্যান্য জায়গায় চীনের ঋণ বিতর্কিত প্রমাণিত হয়েছে এবং চুক্তির শর্তাবলি অনুযায়ী চীনকে সংশ্লিষ্ট দেশের গুরুত্বপূর্ণ সম্পদের ওপর কর্তৃত্ব দিতে পারে।

শত শত চীনা ঋণ প্রকল্প পরীক্ষা করে এইডডেটা এবং অন্যান্য গবেষণা সংস্থা এমন কোনো প্রমাণ পায়নি যে, ঋণ গ্রহীতা দেশ অর্থ পরিশোধে ব্যর্থ হওয়ার পর চীনের রাষ্ট্রীয় ঋণদাতা প্রাতষ্ঠানগুলো তাদের গুরূত্বপূর্ণ সম্পদ দখল করেছে।

ঋণ প্রদানে চীন ও অন্যান্য দেশের পার্থক্য

চীন তার বৈদেশিক ঋণের তথ্য প্রকাশ করে না এবং বেশিরভাগ চুক্তির ক্ষেত্রে ঋণ গ্রহীতার সঙ্গে চুক্তির শর্তাবলি প্রকাশ না করার শর্ত থাকে। চীনের দাবি, আন্তর্জাতিক ঋণ চুক্তির ক্ষেত্রে গোপনীয়তা রক্ষা করা একটি সাধারণ বিষয়।

লন্ডনের কুইন মেরি ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক লি জোনস বলেছেন, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যিক ঋণের ক্ষেত্রে গোপনীয়তা চুক্তি খুবই সাধারণ একটি ব্যাপার। চীনের উন্নয়ন অর্থায়নের বেশিরভাগই মূলত বাণিজ্যিক কার্যক্রম কেন্দ্রিক।

বেশিরভাগ শিল্পোন্নত দেশগুলো তাদের ঋণ কার্যক্রমের তথ্য শেয়ার করে প্যারিস ক্লাবের মাধ্যমে। চীন এই ক্লাবে যোগদান না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। তবে বিশ্বব্যাংকের তথ্য উপাত্ত বিশ্লেষণ করে দেখা যায়, চীনের ঋণ প্রবৃদ্ধি অন্যান্য দেশের তুলনায় দ্রুত বৃদ্ধি পাচ্ছে।

চীনা ঋণ কি পরিশোধ করা কঠিন

চীন সচারচর পশ্চিমা সরকারগুরোর তুলনায় উচ্চ সুদে ঋণ দেয়। চীন ঋণ দেয় প্রায় ৪ শতাংশের কাছাকাছি সুদে, যা বাণিজ্যিক হারের কাছাকাছি। বিশ্বব্যাংক, ফ্রান্স এবং জার্মানি যে সুদে ঋণ দেয় চীন তার চেয়ে প্রায় চার গুণ বেশি সুদে দেয়।

উন্নয়নশীল দেশগুলোকে দেওয়া চীনের ঋণ পরিশোধের সময়কাল সাধারণত ১০ বছরেরও সময় কম। যেখানে অন্যান্য ঋণ দাতাদের কনসেশনাল ঋণের মেয়াদ থাকে প্রায় ২৮ বছর।

জি-২০ ভুক্ত দেশগুলোর জোট একটি উদ্যোগ নিয়েছে। তারা দরিদ্র দেশগুলোকে মহামারির প্রভাব মোকাবিলায় সহায়তার জন্য ঋণ দেবে। চীন এই গ্রুপে যোগ দিয়েছে এবং বলেছে, তারা এই পরিকল্পনায় অংশ নেওয়া যে কোনো দেশের ঋণ পরিশোধে সর্বোচ্চ পরিমাণ অবদান রেখেছে।

বিশ্বব্যাংক বলছে, ২০২০ সালের মে মাস থেকে এই পরিকল্পনার আওতায় জি-২০ ভুক্ত দেশগুলো মোট ১০.৩ বিলিয়ন ডলারের বেশি ঋণ দিয়েছে।

সূত্র: বিবিসি।

মন্তব্য

Beta version