আগামী সপ্তাহে রাশিয়া এবং উত্তর আটলান্টিক ট্রিটি অরগানাইজেশনের (ন্যাটো) সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে নতুন বাঁক নেওয়ার সম্ভাবনা দেখছেন বিশ্লেষকরা। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর এশিয়া ও ইউরোপ জুড়ে বিস্তৃত বিশাল দেশটির সঙ্গে ন্যাটোর সম্পর্কোন্নয়নে এটি হতে পারে গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ। ইউক্রেন সীমান্তে রুশ সামরিক বাহিনী মোতায়েনের প্রেক্ষাপটে এই বৈঠকটিকে পশ্চিমা দেশগুলোও অত্যন্ত গুরুত্ব দিচ্ছে।
ইউক্রেন সীমান্ত সংকট নিয়ে আলোচনা করতে আগামী বুধবার ন্যাটোর ৩০টি সদস্য রাষ্ট্রের প্রতিনিধিরা বেলজিয়ামের রাজধানী ব্রাসেলসে রাশিয়ান ফেডারেশনের প্রতিনিধির সঙ্গে বৈঠকে বসতে যাচ্ছেন। একই ইস্যুতে আলোচনার জন্য আজ (সোমবার) সুইজারল্যান্ডের জেনেভাতেও যুক্তরাষ্ট্র ও রুশ কূটনীতিকরা আরেকটি বৈঠকে বসছেন।
এ বিষয়ে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্লিঙ্কেন বলেছেন, আমাদের সামনে ‘দুটি পথ’ খোলা রয়েছে। এরমধ্যে একটি হচ্ছে ‘কূটনীতি এবং উত্তেজনা নিরসন।’বৈঠকের আগে এরইমধ্যে এই উপায়টি যুক্তরাষ্ট্র এবং আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় মস্কোর সামনে পেশ করেছে।
প্রসঙ্গত: রাশিয়ার সম্ভাব্য ইউক্রেন আক্রমণের আশঙ্কার মধ্যেই গত ডিসেম্বরে সুইডেনের রাজধানী স্টকহোমে রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে ব্লিঙ্কেন বৈঠকে মিলিত হন।
২০১৪ সালে ইউক্রেনের অন্তর্গত ক্রিমিয়া উপদ্বীপ আক্রমণের পর রাশিয়ার সঙ্গে পশ্চিমাদের সম্পর্ক তলানিতে নামতে নামতে শীতল যুদ্ধের পর্যায়ে চলে যায়।
প্রসঙ্গত: ন্যাটো-রাশিয়া কাউন্সিল প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল ২০০২ সালে নিজেদের মধ্যে সম্পর্কোন্নয়ন করার জন্য। কিন্তু গত দুই বছর এ কাউন্সিলের কোনো বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়নি।
ব্লিঙ্কেন গত শুক্রবার বলেছিলেন মার্কিন, ইউরোপীয় এবং রুশ কর্মকর্তাদের মধ্যে আগামী সপ্তাহের কূটনৈতিক আলোচনায় অগ্রগতি হতে পারে। তবে তার আগাম সতর্কতা, এ আলোচনা হতে হবে পারস্পরিক, যেখানে রাশিয়াকে ইউক্রেনের প্রতি আগ্রাসন প্রশমন করতে হবে।
ন্যাটোর একাধিক কর্মকর্তা সিএনএনকে বলেছেন যে রাশিয়ার আলোচনায় বসতে চাওয়া একটি বড় ছাড় এবং মনে হচ্ছে পশ্চিমা ও ন্যাটোদের এই কূটনৈতিক প্রচেষ্টা দেশ দুটির মধ্যে উত্তেজনা প্রশমনে সহায়তা করতে পারে।
কর্মকর্তারা আরো বলেন, অতিরিক্ত আক্রমণাত্মক ক্রেমলিন সম্ভবত ভালো মন-মানসিকতা নিয়ে বৈঠকে আসছে না। প্রসঙ্গত গত মাসেই ইউক্রেন সীমান্তে উত্তেজনা প্রশমন করার জন্য দুটি খসড়া চুক্তির রূপরেখা প্রকাশ করেছে মস্কো। এই দাবিগুলোর মধ্যে রয়েছে-পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর সৈন্য মোতায়েন নব্বুই দশকের সীমানায় আনতে হবে।
এই দাবির অর্থ হলো রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলো ন্যাটো দ্বারা কম সুরক্ষিত থাকবে। এই দাবি ছাড়াও রাশিয়া এই নিশ্চয়তা চায় যে, ন্যাটো তার পূর্ব সীমান্তে আর তাদের প্রভাব বাড়াবে না। তবে দাবিটিকে অগ্রহণযোগ্য বলেছে ন্যাটো।
ন্যাটোর কর্মকর্তারা এ বিষয়ে জানান, বুধবারের বৈঠকে রাশিয়ার বিরুদ্ধে সদস্য দেশগুলোর ঐক্যবদ্ধ ও শক্তিশালী অবস্থান নেওয়ার একটি সুযোগ এসেছে। তবে তারা হুঁশিয়ারি দিয়েও বলেছেন, ছাড় না দিয়ে রাশিয়া যদি ইউক্রেনে উত্তেজনা বাড়াতে থাকে, তা হলে দেশটিকে চরম অর্থনৈতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হতে হবে। ২০১৪ সালে ন্যাটো যেসব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা নেয়নি, এবার নেওয়া হবে।
কনফ্লিক্ট স্টাডিজ রিসার্চ সেন্টারের গবেষক পাসি ইরোনেন বলেছেন, ক্রেমলিনের কাছে সামরিক পরাজয় বিশ্ব পরিস্থিতিকে আরো বেশি বিপজ্জনক করে তুলবে এবং ক্রেমলিনকে আরো বেশি আক্রমণাত্মক কাজ করতে উৎসাহিত করবে।
পশ্চিমা দেশগুলোর কর্মকর্তা এবং বিশ্লেষকদের মত বিশ্লেষণ করে পাসি ইরোনেন আরো বলেন, এখন এটা দৃশ্যমান যে, সাম্প্রতিক বছরগুলোর তুলনায় রাশিয়াকে অনেক কম ভয় পায় ন্যাটোভুক্ত পূর্ব ইউরোপের দেশগুলো। বিদেশের মাটিতে রাশিয়ার জনগণের ওপর বিষ প্রয়োগ, হত্যা, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষদের নৃশংস দমন, গ্রেপ্তার, বাইরের দেশের নির্বাচনে হস্তক্ষেপ এবং রাশিয়ার সঙ্গে ক্রিমিয়ার অধিভুক্তি সবই পুতিনকে একজন শক্তিশালী নেতা হিসেবে চিত্রিত করেছে। তার এই ভাবমূর্তির কারণে তাকে ভয় পাওয়া উচিত বলে মনে করেন তিনি।
ইরোনেন বলেন, ‘পুতিন একজন বয়সের ভারে ন্যুব্জ স্বৈরাচার, তিনি তার শাসনের উত্তরাধিকার খোঁজা নিয়েই মগ্ন, আর এটা সোভিয়েত ইউনিয়নেরই ব্যর্থতা।’রাশিয়ার অর্থনীতি কোভিড-১৯ এর কারণে বিধ্বস্ত এবং এর হাইড্রো কার্বন অর্থনীতি রপ্তানির ভবিষ্যতও অন্ধকার দেখাচ্ছে।’রাশিয়াকে শাস্তি দেওয়ার আগে নতুন কোনো নিষেধাজ্ঞা কার্যকর করাটা পশ্চিমাদের জন্য কিছুটা কঠিন। পশ্চিমারা যদি একজোট হতে পারে তাহলেই কেবল পুতিনের জন্য হুমকি হতে পারে।
লিথুয়ানিয়ার প্রাক্তন প্রতিরক্ষামন্ত্রী রাসা জুকনেভিচিয়েনে বলেন, ‘আমাদের একতাবদ্ধ হতে হবে এবং ভয় পাওয়ার কোনো কারণ নেই। পুতিন ভয় পায়, আমরা নই। তিনি (পুতিন) তার নিজের জনগণকে ভয় পান, গণতান্ত্রিক নির্বাচনকে ভয় পান।’ জুকনেভিচিয়েনের বিশ্বাস, ন্যাটোতে ইউক্রেনের যোগদানকে ত্বরান্বিত করার এখনই সময়।
লিথুয়ানিয়ার এই সাবেক নেতা মনে করেন, ‘ইউরোপ হিটলার এবং স্ট্যালিন যুগের বিভক্তির সময়ে ফিরে যেতে পারে না। ক্রেমলিন নয়, ইউক্রেনের জনগণকে সিদ্ধান্ত নিতে হবে, ইউক্রেনের ভবিষ্যৎ কী হবে। ইউক্রেনের সাফল্যই হবে ক্রেমলিনের বিরুদ্ধে সর্বোত্তম প্রত্যুত্তর। আর রাশিয়াও এটি সবচেয়ে বেশি ভয় পায়।
তবে শেষ অবধি কূটনীতিকদের ধারণা, ব্রাসেলসে অনুষ্ঠেয় আগামী সপ্তাহের আলোচনা উত্তেজনাপূর্ণ হবে। তবে ইউক্রেন সংকটের সমাধানে হয়তো আরো সময় লাগতে পারে। সূত্র: সিএনএন
মন্তব্য