-->

ইউক্রেন বাজিতে হার সবার

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ইউক্রেন বাজিতে হার সবার
সীমান্তে সতর্ক অবস্থায় ইউক্রেনের সেনারা।

ইউক্রেনকে কেন্দ্র করে যুক্তরাষ্ট্র ও রাশিয়ার মধ্যে মনস্তাত্ত্বিক দ্বন্দ্ব দিন দিন বাড়ছে। এর একটি গ্রহণযোগ্য ও শান্তিপূর্ণ সমাধান খুবই জরুরি। তা না হলে এ সংকটের প্রভাব পড়বে সারা বিশ্বে। বর্তমানে পশ্চিমা বিশ্বের নেতৃত্বে রয়েছেন যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন।

তারা বার বার রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে এ অচলাবস্থা নিরসন ও নতুন করে যাতে স্নায়ুযুদ্ধের আবির্ভাব না হয়, তার জন্য আলোচনায় বসার আহ্বান জানিয়ে যাচ্ছে। আলোচনা যদি ফলপ্রসূ না হয়, তাহলে পরিস্থিতি হবে খুবই ভয়াবহ।

উভয় পক্ষের নিজ নিজ অবস্থানে অনড় থাকা দেখে মনে হচ্ছে এর সহজ সমাধান হয়তো অসম্ভব। কারণ এর সঙ্গে রাজনীতি ও মর্যাদার প্রশ্ন গভীরভাবে জড়িত এবং উভয়পক্ষ ইউক্রেন ইস্যুকে একটি বাজির পর্যায়ে নিয়ে গেছে।

করোনা মহামারির কারণে পূর্ব ইউরোপের অবস্থা ভয়াবহ আকার ধারণ করেছে। সেখানে মূল্যস্ফীতি চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে। সঙ্গে রয়েছে অভ্যন্তরীণ রাজনৈতিক সংকট।

 

 

এদিকে বাইডেনও ইতোমধ্যে ঘোষণা দিয়েছে, ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত নয়- এমন কোনো দেশে তারা সৈন্য পাঠাবে না। আসল কথা হলো, সোভিয়েত ইউনিয়েনের পতনের পর ইউক্রেন ইস্যুতে উত্তেজনা চরম পর্যায়ে পৌঁছেছে পরমাণু শক্তিধর বিশ্বের এ দুই পরাশক্তির মধ্যে।

ইউক্রেনে রাশিয়ার যেকোনো ধরনের আগ্রাসন দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পর ইউরোপে বড় ধরনের সংঘর্ষ সৃষ্টি করতে পারে। এ যুদ্ধ পশ্চিমা বিশ্ব কীভাবে নেবে, সেটাও দেখার বিষয়। এ ঝুঁকি থেকে বাদ পড়বে না যুক্তরাষ্ট্রের জনগণও। বিশ্বব্যাপী যুক্তরাষ্ট্রের আধিপত্য বজায়ের যে লড়াই, তাতে কঠিন পরিস্থিতিতে পড়বে নিজেরাও। সংঘাতে জ্বালানি সংকট দেখা দেবে, মূল্যও বৃদ্ধি পাবে।

যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্থনি ব্লিঙ্কেন গত শুক্রবার জেনেভায় রাশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভের সঙ্গে বৈঠকে ইউক্রেন ইস্যু আলোচনার মাধ্যমে সমাধানের চেষ্টার কথা বলেন।

তবে ইউক্রেনকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত না করতে পুতিনের শর্ত না মানার ক্ষেত্রে অটল ছিল যুক্তরাষ্ট্র। ব্লিঙ্কেন বলেন, রাশিয়ার এমন কোনো পদক্ষেপ নেওয়া উচিত নয়, যা বিশ্বে ক্ষোভোর উদ্রেক সৃষ্টি করবে। যদি ভুল কোনো পথে যায়, তাহলে মস্কোকে নজিরবিহীন নিষেধাজ্ঞার সম্মুখীন হতে হবে।

এদিকে কিয়েভ সরকার বলছে, ইউক্রেন সীমান্তে রাশিয়া বিপুলসংখ্যক সেনা মোতয়েন করেছে, তারা যেকোনো সময় পুরোদমে আক্রমণ শুরু করতে পারে।

রাশিয়া ইউক্রেন সীমান্তে ১ লাখের বেশি সৈন্য মোতায়েন করেছে। ধারণা করা হচ্ছে, এরাই বিশ্বে কে বেশি শক্তিশালী, তা নির্ধারণের বড় নিয়ামক। মূল কথা হলো এর মধ্য দিয়ে পুতিন প্রতিপক্ষকে নিজেদের সক্ষমতা জানান দিতে চান।

কোনো কোনো রাজনৈতিক বিশ্লেষকের মতে, সৈন্য মোতায়েনের ঘটনা পুরোটাই পুতিনের ভাঁওতাবাজি। একটা ভীতকর পরিবেশ সৃষ্টি করে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সমঝোতার মাধ্যমে রুশ নেতা নিজেদের পূর্বের অবস্থান ফিরে পেতে এসব করছে।

অনেকের মতে, ইউক্রেনে ছোট-খাটো আক্রমণ চালিয়ে নিজ দেশে পুতিন তার জনপ্রিয়তা বাড়ানোর চেষ্টায় আছে। ইউরোপের অভ্যন্তরীণ বিভক্তি এবং যুক্তরাষ্ট্রের দুর্বলতা সম্পর্কে পুতিন সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল হয়েই এ খেলা খেলেছে। পশ্চিমা বিশ্বকে নাকাল করাটাই যদি পুতিনে মূল উদ্দেশ্য হয়, তাহলে এটাই উপযুক্ত সময়।

পুতিনের কাছে ইউক্রেন কেন এত গুরুত্বপূর্ণ

সবার আগে আমাদের জানতে হবে ইউক্রেন কেন রুশ নেতার কাছে এত বেশি গুরুত্বপূর্ণ। সাবেক এই কেজিবি কর্মকর্তা চোখের সামনে দেখেছে সোভিয়েত ইউনিয়নের ঐতিহাসিক বিপর্যয়।

তার মতে, ন্যাটোয় ইউক্রেনের অন্তর্ভুক্তি রুশ সভ্যতার বড় ধরনের অপমান। তাই তিনি ইউক্রেনকে ন্যাটোয় যুক্ত না করার জন্য বাইডেনের প্রতি আকুতি জানিয়েছেন।

এছাড়া সাবেক ওয়ারস প্যাক্ট রাজ্য; যেমন- পোল্যান্ড ও রুমানিয়া থেকে পশ্চিমা বাহিনী ও অস্ত্রশস্ত্র প্রত্যাহার করে নেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।

পুতিনের মতে, এসবই রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকিস্বরূপ। গত এক দশক বা তারও বেশি সময় আগ থেকে পুতিন রাশিয়ান বলয় তৈরির চেষ্টা করে যাচ্ছেন- যাতে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নে ফিরে যাওয়া যায়।

সাবেক সোভিয়েতের একটা অংশ হচ্ছে ইউক্রেন। এরই ধারাবাহিতকায় রাশিয়া ২০১৪ সালে ইউক্রেনের ক্রিমিয়া দ্বীপ দখল করে নেয়। সম্প্রতি বেলারুশ ও কাজাখস্তানে রাজনৈতিক সহিংসতা দমনেও গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছে পুতিন প্রশাসন।

সোভিয়েত ইউনিয়ন ভেঙে সৃষ্টি হওয়া নতুন রাষ্ট্রগুলোয়, বিশেষ করে ইউক্রেনে পশ্চিমা ধাঁচের গণতন্ত্রের চর্চা কোনোভাবেই পুতিনের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব না। অন্যদিকে পুতিনের দীর্ঘ শাসন ও দমন-পীড়নে ক্লান্ত হয়ে পড়া রাশিয়ানদের জন্য ইউক্রেন হতে পারে নতুন আশার প্রতীক।

সম্প্রতি এক সংবাদ সম্মেলনে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট বাইডেন বলেন, রাশিয়ার বিরুদ্ধে ভুল কোনো পদেক্ষপ বড় ধরনের বিপদ ডেকে আনতে পারে। মনে রাখতে হবে, রাশিয়া যতক্ষণ পর্যন্ত অনুপ্রবেশের মতো কোনো ঘটনা না ঘটায় ততক্ষণ পর্যন্ত আমরা তাদের ওপর পূর্ণাঙ্গ নিষেধাজ্ঞা আরোপ করতে পারি না।

পুতিন কী চান, সে সম্পর্কেও বাইডেনের সুস্পষ্ট ধারণা রয়েছে। বাইডেন বলেন, রুশ নেতা ইতিহাসের পুনরাবৃত্তির জন্য আপ্রাণ চেষ্টা করে যাচ্ছে। মনে রাখতে হবে, বার্লিন দেয়াল ভেঙে গেছে, সাম্রাজ্যও আর নেই। সোভিয়েত ইউনিয়নও ভেঙে টুকরা টুকরো হয়ে গেছে।

তারপরও পুতিনের মনে কী চলছে, তা আমাদের ভাবতে হবে। এখনো রাশিয়ায় ৮ বার সময় পরিবর্তন হয়, তুন্দ্রা অঞ্চলে যে আগুন জ্বলছে, তা আর কখনো স্বাভাবিক নিয়মে নিভবে না। তেল ও গ্যাস সমৃদ্ধ রাশিয়া চীন ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে নিজেদের হারানো অবস্থান ফিরে পাওয়ার চেষ্টা করছে।

আবার এমনও হতে পারে, রাশিয়ার হারানো গৌরব পুনরুদ্ধার ও পশ্চিমা বিশ্বের, বিশেষ করে যুক্তরাষ্ট্রের মর্যাদা ক্ষুণ্ন করাই পুতিনের মূল লক্ষ্য। ইউক্রেন এখানে একটা উপলক্ষ্য মাত্র।

হতে পারে যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যবর্তী নির্বাচনে হস্তক্ষেপের চেষ্টা। কারণ ২০১৬ সালের মার্কিন নির্বাচনে রাশিয়া রিপাবলিকান ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানিয়েছিল, যা যুক্তরাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ রাজনীতিকে ব্যাপক চাপের মধ্যে ফেলে।

রাশিয়ার সমর্থিত প্রেসিডেন্ট ট্রাম্প বরাবরই মস্কোর প্রতি নতজানু ছিল। এই ট্রাম্পের সমর্থকরাই ২০২১ সালে যুক্তরাষ্ট্রের ক্যাপিটাল ভবনে হামলা চালায়। এটা যুক্তরাষ্ট্রের গণতন্ত্রের ওপর মারাত্মক নেতিবাচক প্রভাব ফেলে এবং ধারণা করা হয়, এক্ষেত্রে রাশিয়া তার উদ্দেশ্য চরিতার্থ করতে সমর্থ হয়েছে।

ট্রাম্পের অগণতান্ত্রিক আচরণ যুক্তরাষ্ট্রের বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনকে ঘরে-বাইরে বিব্রতকর পরিস্থিতির মুখে ফেলেছে- এতটা হয়তো রাশিয়াও আশা করেনি।

কৌশলী বাইডেন

পুতিনের অনমনীয় ভাব বাইডেনকে ইউক্রেন সংকট বুঝতে সাহায্য করেছে। তিনি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে পশ্চিমা বিশ্বকে একত্রিত করার চেষ্টা করে গেছেন, যেখানে পুতিন বরাবরই ভাঙন ধরানোর চেষ্টা করে গেছেন।

রাশিয়ায় ওপর অর্থনেতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের যে প্রস্তাব এসেছে, তা মস্কোকে পশ্চিমা বিশ্ব থেকে বিচ্ছিন্ন করবে। বাইডেনের কথার ভিত্তিতে বলা যায়, রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফল মারাত্মক হবে। এতে হয়তো রাশিয়াকে কোণঠাসা করা যাবে।

কিন্তু মনে রাখতে হবে- পশ্চিমা বিশ্বের অবস্থা আগের মতো নেই। কয়েকদিন আগে ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ ইউরোপীয় দেশগুলোকে একত্রিত হওয়ার আহ্বান জানিয়ে পুতিনকে দমাতে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছেদ করতে বলেছেন যুক্তরাষ্ট্রকে।

রাশিয়ার ওপর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপের ফল ভোগ করতে হবে অন্য দেশগুলোকেও। কারণ অনেক উন্নত দেশের সঙ্গে রাশিয়ার বাণিজ্যিক সম্পর্ক রয়েছে। পুতিনকে দমনের জন্য বাইডেন মনে মনে হয়তো ঝুঁকিপূর্ণ কোনো খেলার ছক কষছেন।

একদিকে ইউক্রেনে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ এড়ানোর চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, অন্যদিকে কিয়েভ সরকারকে অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করছে। এটা অনেকটা ১৯৮০-এর দশকে সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের সৈন্যদের বিতাড়িত করতে আফগান মুজাহিদদের অস্ত্র দিয়ে সহযোগিতা করার মতো।

আপনি চাইলেই ইউক্রেন আক্রমণ বা দখল করতে পারেন। কিন্তু কতদিন দখলে রাখবেন- এক, তিন, পাঁচ বা ১০ বছর। এটাকে দখলে রেখে কী পাবেন, কী করবেন। এতে শুধুই সময়ের অপচয় হবে। অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে মারাত্মক এবং এটাই হচ্ছে বাস্তবতা।

ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করে পুতিনের কর্দমাক্ত জলাভূমিতে পড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। এটাকে কেন্দ্র করে নিজ দেশে রাজনৈতিক ও সামরিক দিক থেকে বড় ধরনের ধাক্কা খেতে পারে। অনেক রুশ সৈন্য যুদ্ধক্ষেত্র ছেড়ে বাড়ি ফিরে আসতে পারে।

আবার এমনও হতে পারে, পুতিন সেখানে গোয়েন্দা কার্যক্রম বাড়িয়ে দেবে বা খুবই সীমিত আকারে একটি বিশেষ ও অনিয়মিত বাহিনী দ্বারা ইউক্রেনে অনুপ্রবেশ করাবে।

ইউক্রেন সংকটে যুক্তরাষ্ট্রের মনোভাবের সবেচেয়ে উল্লেখযোগ্য দিক হলো আক্রমণাত্মক বক্তব্য ও রাশিয়ার গোয়েন্দা প্রতিবেদন ফাঁসের ঘটনা, যা খুবই উদ্বেগজনক।

পরিস্থিতি যেদিকে ধাবিত হচ্ছে, তাতে এটা বিশ্বাস করা মুশকিল- রুশ প্রশাসন ইউক্রেন সংকটকে একটা রাজনৈতিক সমাধানের পথে নিয়ে যেতে চায়। রাশিয়ার ট্যাঙ্ক যদি সীমান্ত অতিক্রম করে, তাতে অবাক হওয়ার কিছু নেই।

ইউরোপীয় দেশগুলো নিষেধাজ্ঞা আরোপের যে হুমকি দিয়েছে ওয়াশিংটন সেটাকে আরো জোরদার করতে পারে। ফলে যেটা হবে, ইউরোপের পশ্চিমাঞ্চলে রাশিয়া থেকে গ্যাস নেওয়ার জন্য নর্ড স্ট্রিম-২ পাইপলান নির্মাণ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে জার্মানির দীর্ঘদিন ধরে চলা বিতণ্ডা নতুন করে সামনে চলে আসবে।

বার্লিনের নতুন সরকার হুঁশিয়ারি দিয়ে বলছে, রাশিয়া যদি ইউক্রেনে আক্রমণ করে, তাহলে তারা গ্যাসলাইন বন্ধ করে দিবে। যাই হোক, বাইডেনের গত বুধবারের ভাষণে এটাই মনে হচ্ছে তারা ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার সঙ্গে সংঘাতের পথে যাচ্ছে। বাইডেনের এ ধরনের কৌশল হয়তো পুতিনের ওপর চাপ বাড়াবে। কিন্তু সত্যিকার অর্থে এটা একটা বড় ধরনের বাজি।

সিএনএন অবলম্বনে।

মন্তব্য

Beta version