-->

বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ পরিবারের হস্তক্ষেপ চান না থাই শিক্ষার্থীরা

মোমেনা আক্তার পপি
বিশ্ববিদ্যালয়ে রাজ পরিবারের
হস্তক্ষেপ চান না থাই শিক্ষার্থীরা

থাইল্যান্ডের বিশ্ববিদ্যালয়গুলোয় রাজপরিবারের হস্তক্ষেপের বিরুদ্ধে আওয়াজ দিন দিন বাড়ছে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে রাজকীয় নিয়ম-কানুন বা রাজপরিবারে তত্ত্বাবধান আর চান না শিক্ষার্থীরা।

তাদের মতে, সময়ের পরিবর্তন হয়েছে। আমরা আর আগের মতো নেই। আর পুরোনো নিয়ম চাই না। রাজপরিবারের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়া শিক্ষার্থীর সংখ্যা দিন দিন কমছে। তাদের মতে, এই অনুষ্ঠানে যেতে হলে শিক্ষার্থীদের অনেক অর্থ খরচ করতে হয়- যার বেশির ভাগই রাজ কোষাগারে যায়। প্রতিটি সমাবর্তন থেকে রাজপরিবার বিপুল অর্থ আয় করে।

থাইল্যান্ডে রাজতন্ত্রের নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে কথা বললেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীদের আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর মুখোমুখি হতে হয়। কখনো কখনো জেলেও যেতে হয়। এসবের মধ্যেই গোদের ওপর বিষফোঁড়ার মতো তাদের মোকাবিলা করতে হচ্ছে রাজতন্ত্রপন্থি অভিভাবকদের চাপ।

পড়াশোনা শেষ করার প্রায় দুই বছর পর ২৪ বছর বয়সি ক্রাই সাইদি গত ১৪ জানুয়ারি এসেছিলেন নিজ শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান চিয়াং মাই বিশ্ববিদ্যালয়ে। কেবল বন্ধুদের সমর্থন দেওয়া নয়, তার আসার পেছনে কাজ করেছে নিজের রাজনৈতিক অবস্থান ব্যক্ত করা।

গ্র্যাজুয়েশন গাউনের একটি ছবির সঙ্গে কিছু লেখা একটি প্ল্যাকার্ডে নিয়ে তিনি দাঁড়িয়েছিলেন। এতে লেখা ছিল ‘তুমি আমার স্বপ্ন কেড়ে নিয়েছ এবং এটা দিয়েছ।’ রাজপরিবারের সদস্যদের তত্ত্বাবধানে আয়োজিত সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিতে অস্বীকার করা থাই তরুণের সংখ্যা দিন দিন বাড়ছে। তাদেরই একজন হলো ক্রাই।

তিনি বলেন, সমাবর্তন অনুষ্ঠানের সংস্কারের দাবিতে ২০২০ সালে শুরু হওয়া বিক্ষোভ দেশব্যাপী ছড়িয়ে পড়ে। এরপর রাজতন্ত্র ও রাজপরিবার সম্পর্কে আমার আগের ধারণা পাল্টে যায়। অনেক কিছু নতুন করে উপলব্ধি করতে পেরেছি। জানতে পেরেছি, এতে অংশ নেওয়া প্রতিটি শিক্ষার্থীকে কত অর্থ খরচ করতে হয়, আর কী পরিমাণ অর্থ রাজ কোষাগারে যায়।

বিক্ষোভ অংশ নেওয়ার কারণে কয়েকদিন আগে তার দুই বন্ধু গ্রেপ্তার হন। মুচলেকার বিনিময়ে সেদিনই তাদের ছাড়িয়ে আনা হয়। তবে মুচলেকা দিলেই এই নিয়মের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলার দায়ে আটক হওয়া সবাই ছাড়া পাচ্ছেন- এমন নয়। দেশটিতে বছরের পর বছর ধরে কুখ্যাত একটি আইন প্রচলিত রয়েছে। এতে বলা হয়েছে, রাজতন্ত্র বা রাজপরিবারের কোনো সদস্যকে কেউ অপমান করতে পারবেন না। যদি করে তাহলে তার সর্বোচ্চ ১৫ বছর পর্যন্ত কারাদণ্ড হতে পারে।

তারপরও ঝুঁকি নিয়ে আমরা রাজকীয় নিয়ম-কানুনের বিরুদ্ধে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছি- বলেন ক্রাই। মার্চে আমাদের আন্দোলনের নতুন রূপরেখা ঘোষিত হবে। স্নাতকের শিক্ষার্থীদের কিছু দেওয়ার পরিকল্পনা করেছি। তবে কী দেব তা এখনো ঠিক করিনি। হতে পারে তা রাজনীতিসংশ্লিষ্ট কিছু। তরুণ শিল্পী ও বন্ধুদের সুযোগ করে দেওয়া দায়িত্বের মধ্যে পড়ে। সমাবর্তনে অংশ না নিয়ে প্রচলিত নিয়মের বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়ায় বন্ধুরা আমার প্রশংসা করেছেন। তারা বুঝতে পেরেছেন, আমার সঙ্গে তাদের শামিল হওয়া উচিত ছিল।

থাইল্যান্ডের নরেসুয়ান বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রভাষক পল চেম্বারস বলেন, গ্রেপ্তারের ঘটনা আন্দোলনকে আরো বেগবান করেছে। এ ঘটনা কাজে লাগিয়ে আন্দোলনকারীরা বহুসংখ্যক শিক্ষার্থীকে সমাবর্তন বয়কট করাতে সক্ষম হয়েছেন- যা মূলত রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধেই গেছে। ২০১৭ সালে গ্র্যাজুয়েশন সম্পন্ন করা ২৬ বছর বয়সি ফ্রিলেন্স অভিনেত্রী পানিতা হুতাচারর্ন সমাবর্তনে যেতে অস্বীকৃতি জানিয়ে বলেন, ভয়ে অনেক মানুষই হয়তো সমাবর্তনে যাবে। কিন্তু মনে রাখতে হবে এর বিরুদ্ধে অবস্থান নেওয়া মানুষের সংখ্যাও কম নয়। আন্দোলনকারীরা কেবল আইনি ঝামেলার সম্মুখীন হচ্ছে তা নয়, অনেকেই পারিবারিক চাপেও রয়েছেন।

চেম্বারস বলেন, থাইল্যান্ডের রাজতন্ত্র নিয়ে সব বসয়ি মানুষের মধ্যে দিধাবিভক্তি রয়েছে। দেখা যাচ্ছে, রাজন্ত্রের প্রতি অনুরক্তদের বেশিরভাগই বয়স্ক মানুষ। অভিভাবকরা চান, তাদের সন্তানরা প্রচলিত নিয়মে হওয়া সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিক। তাদের মতে, বছরের পর বছর ধরে এ নিয়ম চলে আসছে। রাজপরিবারের তত্ত্বাবধানেই এসব অনুষ্ঠান হয়ে থাকে। তাই এ নিয়ে অভিভাবকদের কোনো আপত্তি নেই। পানিতা বলেন, আমার মা অনেক বেশি সেকেলে। আমি এ বিষয়ে আমার মায়ের সঙ্গে অনেক কথা বলেছি, যুক্তি দ্বারা বোঝানোর চেষ্টা করেছি। কিন্তু তিনি কোনো কিছু বুঝতে নারাজ।

তার মতে, আমি রাজতন্ত্র বিরোধী। আমার মনে হয়েছে, সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়ার অর্থ অযথা সময় নষ্ট করা। আমি একটা বিষয় বুঝতে পারছি না, আমাদের সমাবর্তনের সঙ্গে রাজপরিবারের কি সম্পর্ক। এখানে এখনো কেন তারা সবকিছু? তবে ভাগ্য আমার সহায় হয়েছে। সমাবর্তনে যোগ না দেওয়ার মতো একটা ভালো অজুহাত আমার পরিবারই সৃষ্টি করে দিয়েছে।

সমাবর্তন ও আমার বোনের বিয়ের অনুষ্ঠান একই তারিখে ছিল। ক্রাইয়ের মতো তার বড় বোনও খরচের কথা ভেবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশ নেননি। আমি শুধু আমার পরিবারকে জানিয়েছে, এটা টাকার সঙ্গে সম্পর্কিত। সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দেওয়াটা বেশ ব্যয়বহুল। ছবি তোলার জন্য শিক্ষার্থীদের দেখেছি অনেক টাকা দিয়ে আলোকচিত্রী ঠিক করতে। এছাড়া মেকাপম্যান, চুল ঠিক করে দেওয়া মানুষের খরচের সঙ্গে রয়েছে পোশাক ভাড়ার বিষয়টিও। সমাবর্তন অনুষ্ঠান হলেই রাজপরিবারের লাভ।

সমাবর্তন অনুষ্ঠান নিজেদের তত্ত্বাবধানে রেখে রাজপরিবার বিপুল অর্থ আয় করে। তাই এটা যথাশিগগির বন্ধ হওয়া উচিত বলে মনে করেন চেম্বারস। তিনি আরো বলেন, রাজতন্ত্র যদি শিক্ষার্থীদের এ দাবি না মেনে তাদের দমন করার পথ বেছে নেয় তাহলে হিতে-বিপরীত হতে পারে। শিক্ষার্থীরা আন্দোলনের প্রতি আরো বেশি ঝুঁকে পড়তে পারেন। সাম্প্রতিক বছরগুলোতে সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বয়কটের ঘটনা উল্লেখ্যযোগ্য হারে বেড়েছে।

৩৫ বছর বয়সী ডিজাইনার সিনা বলেন, ১০ বছর আগে আমরা যখন সমাবর্তন অনুষ্ঠান বয়কট করেছিলাম তখন এর সংখ্যা ছিল খুবই কম। ৯০ শতাংশ শিক্ষার্থী অনুষ্ঠানে অংশ নিয়েছেন। সে হিসাবে ক্রাই বলেন, বর্তমানে ৫০ শতাংশের মতো শিক্ষার্থী সমাবর্তন অনুষ্ঠানে যোগ দিচ্ছেন। সিনা বলেন, একটা সময় মানুষ এসব বিষয়ে তেমন অবগত ছিল না। রাজতন্ত্রের বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলত না।

দিন দিন সমাবর্তন অনুষ্ঠানের বিরুদ্ধে আওয়াজ বাড়তে থাকায় রাজপরিবারের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কিছু বড় ব্যবসায়ী বিরোধীদের চাকরি না দেওয়ার দাবি তুলেছে। তারা বলছেন, চাকরি প্রার্থীদের সনদ হিসেবে সমাবর্তন অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণের ছবি জমা দিতে হবে। যারা ছবি দিতে পারবেন না তাদের চাকরি দেওয়া হবে না।

পানিতা বলেন, আমার মতে, এটা একদিকে ভালোই হয়েছে। সমাবর্তনে অংশ না নেওয়া শিক্ষার্থীরা এসব লোকের কাছে আর চাকরির জন্য যাবেন না। তবে আমার মনে হয়না চাকরি না দেওয়ার প্রচারণা খুব বেশি দিন চলবে। তার সঙ্গে একমত পোষণ করে সিনা বলেন, তারা হয়তো জানেন না, সময় পাল্টেছে। মানুষের চিন্তা-ধারার পরিবর্তন হয়েছে। তারা যা বলবেন মানুষ সেই মতো কাজ করবে- এটা আর চলবে না।

উদাহরণ হিসেবে সিনা বলেন, একটা সময় ছিল যখন টিভিতে রাজকীয় কোনো অনুষ্ঠান হলে প্রায় সব মানুষ দাঁড়িয়ে সম্মান জানাত, মনোযোগ দিয়ে তা দেখত। এখন আর তা হয় না। বর্তমানে ১০ শতাংশের মতো মানুষ এমনটা করে। ১০ বছর আগেও যেসব মানুষ দাঁড়াত না, তাদের ওপর নির্যাতন হতে দেখেছি। বর্তমানে এমন ঘটনা চোখে পড়ে না। এখনো যদি কেউ উঠে দাঁড়ায় তাহলে ভাবতে হবে সে একই জায়গায় পড়ে রয়েছে। সময় পাল্টালেও সে নিজেকে পাল্টাতে পারেনি।

সূত্র: দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে।

মন্তব্য

Beta version