‘আফগানিস্তানে মানবিক সংকটের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র’

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
‘আফগানিস্তানে মানবিক সংকটের জন্য দায়ী যুক্তরাষ্ট্র’

কাবুলের পতনের পাঁচ মাসেরও বেশি সময় পার হলেও তালেবান সরকারের অধীনে আফগান অর্থনীতি এখন পতনের দ্বারপ্রান্তে। অর্থনৈতিক দৈন্যদশার মধ্যে লক্ষ লক্ষ আফগান চরম দারিদ্র্য বা অনাহারের ঝুঁকিতে আছে।

আফগানিস্তানের এসব সংকটের মূলে রয়েছে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক দেশটিকে হঠাৎ করে ত্রাণ সহায়তা বন্ধ করা এবং ফেডারেল রিজার্ভে রক্ষিত আফগানিস্তানের ৯.৪ বিলিয়ন ডলার আটকে দেওয়া, যা দেশটির অর্থনৈতিক সংকটকে আরো তীব্র করেছে।

জাতিসংঘের মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের মতে, আফগানিস্তানে চলমান মানবিক সংকট সুদূর প্রসারি এবং ‘আফগানিস্তানে কার্যত প্রতিটি পুরুষ, মহিলা এবং শিশু তীব্র দারিদ্র্যতার সম্মুখীন হতে পারে’।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় আফগানিস্তানে ব্যাপক বিনিয়োগ এবং দেশটির পুনর্গঠনের জন্য একটি সমন্বিত প্রচেষ্টা গ্রহণ না করলে দেশটিতে মানবিক সংকট তীব্র হবে।

জাতিসংঘের মহাসচিব গুতেরেস গত সপ্তাহে আফগানিস্তানের জন্য তহবিল জোগাড় করার কর্মসূচি চলাকালে সাংবাদিকদের সাথে আলাপকালে বলেন, আফগান জনগণকে দেশের অভ্যন্তরে এবং উজবেকিস্তান ও পাকিস্তানের মতো সীমান্তবর্তী দেশগুলির শরণার্থী শিবিরে অবস্থানরত আফগানদের সহায়তার জন্য ৫ বিলিয়ন ডলারেরও বেশি অর্থ সহায়তা দরকার।

৫ বিলিয়ন ডলারের এ তহবিল জাতিসংঘ কর্তৃক একক একটি দেশের জন্য সর্বকালের বৃহত্তম তহবিল সংগ্রহের আবেদন।

আফগানিস্তান ইতোমধ্যে দীর্র্ঘমেয়াদী যুদ্ধ ও কোভিডের কারণে বিপর্যস্ত এবং তার ওপর নতুন করে সংকট দেখা দিয়েছে বৈদেশিক মুদ্রার অভাব। মুদ্রা বাজারে ডলার সংকট থাকায় দেশটির আমদানিকারকরা পণ্য আমদানিতে হিমশিম খাচ্ছে।

একদিকে খাদ্যের মজুদ কমে আসতেছে আবার অন্যদিকে ব্যবসায়ীরা দোকানে নতুন করে পণ্য তুলতে পারছে না। খাদ্যপণ্যের দাম বাড়ার সাথে সাথে লোকজন ব্যাংক থেকে তাদের জমানো সঞ্চয় উঠাতে শুরু করলে তারল্য সংকট আরো তীব্র হয়।

২০২১ সালে আগস্টে কাবুলের পতনের আগে, আফগান অর্থনীতি বিদেশি সাহায্যের ওপর নির্ভরশীল ছিল। তালেবানদের ক্ষমতা দখলের পর নগদ অর্থের প্রবাহ বন্ধ হয়ে যায়। বেকারত্ব ব্যাপক হারে বেড়ে যায় এবং নগদ টাকার সংকটের কারণে লোকজন ব্যাংক থেকে মাসে ১০০ ডলারের বেশি তুলতে পারছে না।

মরার উপর খারার ঘা হয়ে এসেছে আগস্ট মাসে যুক্তরাষ্ট্র কর্তৃক আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংকের রিজার্ভের বেশিরভাগ যা ৯.৪ বিলিয়ন ডলার আটকে দেওয়া। এ ঘটনার পরে আফগানিস্তান কার্যত বৈদেশিক ব্যাংক থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। আবার অন্যদিকে আফগানিস্তানের কেন্দ্রীয় ব্যাংক বিদেশে রক্ষিত রিজার্ভ থেকে টাকা উত্তোলন করতে পারছে না।

একদিকে বৈদেশিক সাহায্য বন্ধ অন্যদিকে রিজার্ভ আটকে দেওয়ার কারণে আফগানিস্তানের বেশিভাগ অঞ্চলের লোকজন এখন চরম দারিদ্র্য এবং অনাহারের সম্মুখীন। ডিসেম্বরে, বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি বলে, ৯৮ শতাংশ আফগান পর্যাপ্ত পরিমাণে খেতে পারছে না।

গুতেরেস এ মাসে সতর্ক করে বলেছেন যে, ‘আমরা আফগান জনগণকে রক্ষার জন্য একটি প্রতিকূল সময়ের সাথে যুদ্ধ করছি’।

আফগানিস্তানের অর্থনৈতিক পতন মানে তালেবানের কিছু সদস্যসহ বিশাল সংখ্যক আফগান খাবার কেনার সামর্থ্য হারাবে। হঠাৎ করে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহারের পর দোভাষী, ত্রাণ সহায়তাকর্মী, প্রসিকিউটর, অধ্যাপক এবং সাংবাদিক হিসেবে কাজ করা অনেক আফগান হঠাৎ করে তাদের চাকরি ও আয় হারিয়ে ফেলেছে।

তাদের অনেককে আবার তালেবানের ভয়ে আত্মগোপনে যেতে বাধ্য হয়েছে। আফগানিস্তানের বেশিরভাগ লোকের পক্ষে মৌলিক জিনিসপত্র যেমন- কম্বল, খাদ্য, জ্বালানি এবং ওষুধ জোগাড় করা অসম্ভব হয়ে পড়েছে।

শীতের মাসে চলমান বরফশীতল পরিবেশ, আফগান পরিবারগুলোকে খাদ্য ক্রয় এবং উষ্ণ রাখতে জ্বালানি ক্রয়-এ দুইয়ের মধ্যে যেকোনো একটা কিনতে পারবে।

জাতিসংঘের শরণার্থী বিষয়ক হাইকমিশনার অফিসের মুখপাত্র বাবর বালোচ বলেন, ‘আমরা যেখানেই যাই, হাজার হাজার লোক সাহায্যের জন্য দাঁড়িয়ে থাকে’। এ সাহায্য প্রার্থীদের অনেকেই হয় চাকরি হারিয়েছে না হয় তাদের কোনো সঞ্চয় নেই।’

বাবর বালোচ বলেন, ‘ল্ফাণ সহায়তা প্রার্থীদের অনেকেরই জীবন-জীবিকা ভেঙে পড়েছে। যারা ত্রাণের জন্য আমাদের মানবিক সহায়তা কেন্দ্রে আসছে তাদের অনেকেই আমাদের ত্রাণ সহায়তা তালিকায় তাদের নাম নেই, কিন্তু তারা এসে বিতরণ সাইটের বাইরে অপেক্ষা করছে আর বলছে, 'আমরা কি ত্রাণ পাব না?'

‘আফগানিস্তানে সরকার ব্যবস্থা ভেঙে পড়েছে, চাকরিতে বেতন নেই এবং অর্থনীতি শূন্যের কোঠায় চলে গেছে,’ বলছেন শাহওয়ালি খান যিনি একজন কাবুল শহরের দোকানদার। শাহওয়ালি খান আরো বলেন, ‘একদিকে মানুষের ক্রয়ক্ষমতা নেই আবার অন্যদিকে আমরা বিক্রিও করতে পারি না’।

যুক্তরাষ্ট্রের আফগান নীতি মানবিক সংকটকে আরো তীব্র করেছে

গত বছর দেশটি থেকে যুক্তরাষ্ট্রের সেনা প্রত্যাহার এবং তালেবানের কেন্দ্রীয় সরকার দখলের সাথে আফগানিস্তানের বর্তমান সমস্যাগুলো ঘনিষ্টভাবে জড়িত।

এ ঘটনাগুলোর পরমপরায় যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা এবং আকস্মিক আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মানবিক সহায়তা বন্ধ আফগানিস্তানের অর্থনীতিকে ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে নিয়ে যাচ্ছে এবং চলমান সঙ্কট দিন দিন গভীরতম হচ্ছে।

যুক্তরাষ্ট্র এবং জাতিসংঘ আফগানিস্তানে মানবিক সহায়তা কমসূচি পরিচালনার জন্য কিছু ছাড় দিয়েছে। ট্রেজারি ডিপার্টমেন্টের অফিস অব ফরেন অ্যাসেট কন্ট্রোল, আফগানিস্তানে কিছু ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের ওপর আর্থিক বিধিনিষেধ ছাড়াই আফগানিস্তানে মিশন পরিচালনা করার অনুমতি দেওয়া হয়েছে।

মানবিক ত্রাণ সহায়তা পরিচালনার জন্য কংগ্রেসনাল প্রগ্রেসিভ ককাসের ৪০ জনেরও বেশি সদস্য গত মাসে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের কাছে একটি চিঠি পাঠিয়েছেন। এ চিঠিতে তারা আফগানিস্তানের আটকে রাখা মুদ্রার রিজার্ভগুলো অবমুক্ত করার আহ্বান জানান।

কংগ্রেসনাল প্রগ্রেসিভ ককাসের এ সদস্যরা মনে করেন, আটকে রাখা এই অর্থের মালিক দেশটির কেন্দ্রীয় ব্যাংক ও আফগান জনগণ।

ইন্টারন্যাশনাল ক্রাইসিস গ্রুপের এশিয়া প্রোগ্রামের ডিরেক্টর লরেল মিলার বলেন, ‘আফগানিস্তানে সরকারি খাত পুনরুদ্ধার করতে এবং অর্থনীতির অবধারিত পতন বন্ধ করতে হলে সাধারণের ব্যবসার ওপর থেকে বিধিনিষেধ তুলে নিতে হবে’।

সামগ্রিক পরিস্থিতি পর্যালোচনা করে মনে হচ্ছে আফগানিস্তানে মানবিক সাহায়তা শিঘ্রই আসছে না। জাতিসংঘের ফিন্যান্সিয়াল ট্র্যাকিং সার্ভিসের তথ্যানুসারে, আফগানিস্তানকে এ চরম দুর্যোগ থেকে রক্ষা করার জন্য ৪.৪ বিলিয়ন ডলার প্রয়োজন। কিন্তু এখন পর্যন্ত অর্থ সহায়তার ব্যবস্থা করা হয়েছে মাত্র ২৯ মিলিয়ন ডলারেরও কম।

দেশটির চলমান অর্থনৈতিক সংকট নিরসনের জন্য তালেবান সরকারের প্রতিনিধিরা এ সপ্তাহে নরওয়ে, ব্রিটেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, ইতালি, ফ্রান্স এবং জার্মানিসহ পশ্চিমা দেশগুলোর সাথে মানবিক সহায়তার বিষয়ে আলোচনায় বসছে।

এ আলোচনাকে তালেবান শাসনের বৈধতা হিসাবে দেখা উচিত নয় বলে মন্তব্য করে নরওয়ের পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যানিকেন হুইটফেল্ড সম্প্রতি এএফপিকে বলেন, ‘তবে আমাদের অবশ্যই দেশটির যথাযথ কর্তৃপক্ষের সাথে কথা বলতে হবে। আমরা রাজনৈতিক পরিস্থিতিকে আরো খারাপ মানবিক বিপর্যয়ের দিকে নিয়ে যেতে দিতে পারি না।’

জাতিসংঘের জরুরী ত্রাণ সমন্বয়কারী মার্টিন গ্রিফিথস গত সপ্তাহে বলেছিলেন যে, আফগান অর্থনীতি পুনরুদ্ধার করতে না পারলে এবং মানুষের জন্য অর্থ সরবরাহ করা শুরু করতে না পারলে সংকট আরো খারাপ হবে।

‘এ বছর ৫ বিলিয়ন ডলার ত্রাণ সহায়তা ব্যবস্থা করা না গেলে আমরা পরের বছর ১০ বিলিয়ন ডলার চাইব’, গ্রিফিথস বলেন।

সূত্র: আল জাজিরা ও ভক্স নিউজ

মন্তব্য