-->
শিরোনাম
অভ্যুত্থানের এক বছর

মিয়ানমারে গণতন্ত্র আজও কারাগারে

মোমেনা আক্তার পপি
মিয়ানমারে গণতন্ত্র আজও কারাগারে

গণতন্ত্র ও কারাগার-মিয়ানমারের সঙ্গে এ দুটি শব্দ অঙ্গাঙ্গিভাবে জড়িত। দশকের পর দশক ধরে দেশটিতে সামরিক শাসন চলছে। মাঝেমধ্যে দেশটিতে গণতন্ত্র উঁকি দেওয়ার চেষ্টা করে।

কিন্তু জান্তার বন্দুকের সামনে তা আর মাথাচাড়া দিয়ে উঠতে পারে না। গত বছরের ১ ফেব্রুয়ারি দেশটিতে ফের সামরিক অভ্যুত্থান হয় এবং গণতান্ত্রিক নেত্রী হিসেবে পরিচিত অং সান সুচি ফের আটক হয়।

এরপর থেকে কারাগারেই রয়েছেন তিনি। সুচি আর কখনো মুক্তি পাবেন কি না সে সম্পর্কে কেউ কোনো ধারণা দিতে পারছে না। কারণ জান্তা সরকারের করা কয়েকটি মামলায় সুচির বেশ কয়েক বছরের জেল হয়েছে।

আন্তর্জাতিক চাপের মুখে দেড় দশক ধরে গৃহবন্দি সুচিকে ২০১০ সালে জান্তা সরকার মুক্তি দিতে বাধ্য হয়। তার মুক্তির বিষয়টি বিভিন্ন শর্তসাপেক্ষে হলেও দেশটির মানুষ আবারো আশায় বুক বাঁধে।

স্বপ্ন দেখতে শুরু করে গণতান্ত্রিক সরকারের। এরই অংশ হিসেবে সুচি জান্তার সঙ্গে সমঝোতার মাধ্যমে ক্ষমতা ভাগাভাগি করেও রোহিঙ্গা ইস্যুতে নিশ্চুপ থাকে। কিন্তু তারপরও শেষ রক্ষা হয়নি তার।

দেশটিতে নতুন করে সেনা অভ্যুত্থান মেনে নেয়নি সাধারণ মানুষ। অভ্যুত্থানের বিরোধিতায় রাস্তায় নেমে আসেন তারা। সারা দেশে ছড়িয়ে পড়ে জান্তাবিরোধী আন্দোলন। জান্তা সরকার সমাবেশে গুলি চালিয়ে, হত্যা, গুম, আটক ও ইন্টারনেট সংযোগ বিচ্ছিন্ন করে দিয়েও আন্দোলনকে দমাতে পারছে না।

জাতিসংঘের হিসাবে, মিয়ানমারে জান্তা সরকারের হাতে এ পর্যন্ত অন্তত দেড় হাজার বিক্ষোভকারী প্রাণ হারিয়েছেন। তবে ধারণা করা হয়, হামলা-সহিংসতায় নিহতের প্রকৃত সংখ্যা আরো অনেক বেশি।

জান্তা সরকারের বিরুদ্ধে আওয়াজ তোলায় মিয়ানমারে অন্তত ১১ হাজার ৭৮৭ জনকে আটক করা হয়। এরমধ্যে ৮ হাজার ৭৯২ জন এখনো বন্দি।

এ ছাড়া বন্দি অবস্থায় মারা গেছেন অন্তত ২৯০ জন। বেশির ভাগেরই মৃত্যুর কারণ ব্যাপক নির্যাতন। কিন্তু তাতেও কোনো লাভ হয়নি। উপরন্তু দেশটির বিচ্ছিন্নতাবাদী দলগুলো এক জোট হয়ে সেনাবাহিনীর বিরুদ্ধে লড়ছে।

সব মিলিয়ে চতুর্মুখী চাপে রয়েছে জান্তা সরকার। দেশটিতে অন্তত ২০টি সংখ্যালঘু গোষ্ঠীর সশস্ত্র ইউনিট রয়েছে।

আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের মতে, চার বছর আগে রাখাইনে রোহিঙ্গাদের ওপর বর্বর নির্যাতন চালানো সেনাদের বিচার না করার কারণেই মিয়ানমারে এমন সংকট তৈরি হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনার মিশেল ব্যাচেলেটের মতে, এ ধরনের ঘটনায় দায়মুক্তি দিতে থাকলে দেশটিতে কোনো দিনই স্থিতিশীলতা আসবে না। দেশটিতে যতদিন দায়মুক্তি রয়েছে, তত দিন স্থিতিশীলতা শুধু কল্পকাহিনি হয়েই থাকবে। সমস্যা সমাধানে সামরিক বাহিনীর জবাবদিহিতা অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশটির জনগণও তাই চাইছে।

তিনি আরো বলেন, মিয়ানমার সংকট সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রচেষ্টায় ঘাটতি রয়েছে। এ পর্যন্ত যেটুকু ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে তা অকার্যকর। দেশটিতে গণতন্ত্র পুনঃপ্রতিষ্ঠা ও জনগণের ওপর দমন-পীড়ন বন্ধে জান্তা সরকারের ওপর চাপ বাড়াতে বিশ্বনেতাদের এগিয়ে আসতে হবে।

মিয়ানমারে সামরিক বহিনী ক্ষমতা দখলের এক বছরের মধ্যে দেশটির সঙ্গে পশ্চিমাদের দূরত্ব বেড়েছে। আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় থেকে দেশটি একপ্রকার বিচ্ছিন্ন রয়েছে। এর মধ্যে মিয়ানমারের ওপর একাধিক অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা দিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন।

ইন্টারন্যাশনাল লেবার অর্গারাইজেশন (আইএলও) বলছে, করোনা মহামারি ও সামরিক অভ্যুত্থানের কারণে গত বছর দেশটিতে চাকরি হারিয়েছেন ১৬ লাখ মানুষ। অভ্যুত্থানের কারণে কৃষি, অবকাঠামো, তৈরি পোশাক, ট্যুরিজম ও সেবাখাত সবচেয়ে বেশি ক্ষতিগ্রস্ত হয়।

এতে ২৭ থেকে ৩১ শতাংশ চাকরির ক্ষেত্র কমে। মিয়ানমারে নিযুক্ত আইএলওর কর্মকর্তা ডংলিন লি বলেন, অভ্যুত্থান ও মহামারিতে লাখ লাখ শ্রমিক ভয়াবহ পরিস্থিতির মধ্যে পড়েছে। দেশটির শ্রমবাজার পরিস্থিতি ক্রমশ খারাপের দিকে যাচ্ছে। এ অবস্থা চলতে থাকলে মিয়ানমারজুড়ে দরিদ্র্যতা ও অনিরাপত্তা আরো বাড়বে বলে তিনি আশঙ্কা প্রকাশ করেন।

জাতিসংঘের হিসাবে চলমান সশস্ত্র সংঘাত, সহিংসতা ও অনিরাপত্তার কারণে সবচেয়ে বেশি নেতিবাচক প্রভাব পড়েছে কৃষকের ওপর। বেড়েছে বাস্তুচ্যুতের সংখ্যা, কমেছে জীবিকা। কাজের সময় ও চাকরি কমে যাওয়ায় অসামঞ্জস্যভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে নারীরা। গার্মেন্টস, পর্যটনসহ সেবাখাতে চাকরি হারানোদের অধিকাংশই নারী।

সুচি স্টেট কাউন্সিলর থাকা অবস্থায় ২০১৭ সালের আগস্টের শেষ সপ্তাহে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে দেশটির সেনাবাহিনী অভিযান চালায়। তারা রোহিঙ্গা অধ্যুষিত গ্রামগুলোতে আগুন লাগিয়ে দেয়। নির্বিচারে হত্যা, ধর্ষণ, নির্যাতন চালায় রোহিঙ্গাদের ওপর। সেনাবাহিনীর নির্যাতনের হাত থেকে বাঁচতে সাড়ে সাত লাখ রোহিঙ্গা পালিয়ে প্রতিবেশী বাংলাদেশে আশ্রয় নেয়।

মিয়ানমার সেনাবাহিনীর এ ঘটনায় সারা বিশ্বে নিন্দার ঝড় ওঠে। জাতিসংঘ এ ঘটনাকে জাতিগত নিধন হিসেবে বর্ণনা করে। কিন্তু কোনো কিছুতেই কর্ণপাত করেনি মিয়ানমার সরকার।

উপরন্তু রাখাইনে গণহত্যা নিয়ে গাম্বিয়ার করা মামলায় আন্তর্জাতিক আদালতে মিয়ানমারের হয়ে উপস্থিত ছিলেন সুচি। সেনাবাহিনীর কর্মকাণ্ডের পক্ষে সাফাই গেয়েও নিজেকে রক্ষা করতে পারেননি ৭৬ বছর বয়সি নোবেলজয়ী এ নেত্রী।

২০২০ সালে অনুষ্ঠিত নির্বাচনে সুচির দল আবারো বিপুল ভোটে জয় লাভ করে। সরকার গঠনের মাত্র কয়েকদিন আগেই জালিয়াতির অভিযোগ এনে নির্বাচনের ফল অস্বীকার করে সামরিক বাহিনী ফের ক্ষমতা দখল করে।

আটক করা হয় সুচিকে। তার বিরুদ্ধে দুর্নীতি ও জালিয়াতির অভিযোগ আনা হয়েছে। তার বিরুদ্ধে মিয়ানমারের আদালতে চলছে বিচার কার্যক্রম। এরই মধ্যে কয়েকটি মামলায় তাকে দেওয়া হয়েছে বিভিন্ন মেয়াদে সাজা।

প্রসঙ্গত, ১৯৯০ সালে মিয়ানমারের সাধারণ নির্বাচনে সুচির দল ন্যাশনাল লিগ ফর ডেমোক্রেসি (এনএলডি) ৮১ শতাংশ আসনে জয়ী হয়। কিন্তু তৎকালীন সামরিক শাসক এ ফল প্রত্যাখ্যান করে সুচির কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরে অস্বীকার করে। এরপর সু চিকে গৃহবন্দি করে রাখে জান্তা সরকার।

১৯৮৯ থেকে ২০১০ সাল- এই ২১ বছরের মধ্যে ১৫ বছর গৃহবন্দি ছিলেন সুচি। এজন্য তিনি বিশ্বের প্রথম সারির রাজনৈতিক বন্দি হিসেবে পরিগণিত হন।

নোবেলজয়ী সুচির দল এনএলডিএ দেশটিতে অনুষ্ঠিত ২০১০ সালের নির্বাচন বয়কট করে। ফলে জান্তা-সমর্থিত সলিডারিটি অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট পার্টিকে (ইউএসডিপি) জয়ী ঘোষণা করা হয়।

২০১২ সালে পিথু হুলটায় (নিম্নকক্ষ হিসেবে পরিচিত) শূন্য হওয়া ৪৫ আসনের উপনির্বাচনে এনএলডি ৪৩ আসনে জয়ী হয়। এই ৪৩ জনের একজন ছিলেন সুচি। ২০১৫ সালের নির্বাচনে সুচির দল বিপুল ভোটে জয়ী হয়।

কিন্তু সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা তার প্রেসিডেন্ট হওয়ার পথে অন্তরায় হয়ে দাঁড়ায়। কারণ হিসেবে দেখানো হয়, সুচির প্রয়াত স্বামী ও সন্তান অন্যদেশের নাগরিক। এরপর সুচির জন্য স্টেট কাউন্সিলর অব মিয়ানমার নামে নতুন একটি পদ সৃষ্টি করা হয় (প্রধানমন্ত্রীর পদমর্যাদাসম্পন্ন)।

বিবিসি, সিএনএন ও আল জাজিরা অবলম্বনে

মন্তব্য

Beta version