২০২১ সাল, এই বছরটি পৃথিবীর অনেক প্রান্তে ব্যাপক পরিবর্তন এনেছে এবং তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন সংকটে নিমজ্জিত মধ্যপ্রাচ্য অবশেষে নিজেদের মধ্যে বিদ্যমান আঞ্চলিক সমস্যা থেকে বেরিয়ে আসার চেষ্টা করছে। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে সম্পর্কোন্নয়নের জন্য বহুদিনের কূটনৈতিক প্রচেষ্টা অবশেষে সুফল বয়ে আনতে শুরু করল। এক সময়কার মধ্যপ্রাচ্যের সংঘাত ও সংঘর্ষের কেন্দ্রবিন্দু ইরাক এখন মধ্যপ্রাচ্যের অনেক পুরোনো প্রতিদ্বন্দ্বী সৌদি আরব এবং ইরানের মধ্যে শান্তি আলোচনার মধ্যস্ততা করছে।
মহামারিকালীন অর্থনৈতিক বিপর্যয় এবং ডোনাল্ড ট্রাম্পের চার বছরের বৈশ্বিক জগাখিচুড়ির কূটনৈতিক ব্যবস্থার বেড়াজালে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর উপলব্ধি হলো যে, যেভাবে এই অঞ্চলে রাজনীতি আবর্তিত হচ্ছে তা আর এভাবে বছরের পর বছর চলতে দেওয়া যায় না।
গত বছরের শেষের দিকে মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোর মধ্যে কূটনৈতিক হাওয়া সজোরে বইতে শুরু করেছে। একই সময়ে এই অঞ্চলে আরেকটি ভূ-রাজনৈতিক একটি বিভেদ রেখা স্পষ্ট হচ্ছে। মধ্যপ্রাচ্য এখন দুই শক্তিশালী দেশ যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের জন্য নতুন করে রাজনৈতিক এবং অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে যুদ্ধক্ষেত্র হয়ে উঠছে। যদিও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলো নিজেদের দুই পরাশক্তির টানাটানি থেকে দূরে রাখার আপ্রাণ চেষ্টা করে আসছে।
মধ্যপ্রাচ্য নিয়ে চীন ও যুক্তরাষ্ট্রের এই টানাটানি এবং দেশগুলোর নেতাদের শ্যাম রাখি না কুল রাখি এই অবস্থা সাম্প্রতিক এক আরব আমিরাতের উচ্চপদস্থ নেতার কথাবার্তা উঠে আসছে।
সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকারের কূটনৈতিকবিষয়ক উপদেষ্টা আনোয়ার গারগেস বলেন, ‘মধ্যপ্রাচ্যকে নিয়ে দুই পরাশক্তির তীব্র লড়াই শীতল যুদ্ধে পরিণত হয়েছে এবং এটা আমাদের উদ্বিগ্ন করছে।
‘আমি মনে করি, এই দুই শক্তির টানাটানিতে আমরা (সংযুক্ত আরব আমিরাত) এবং ছোট দেশগুলো নেতিবাচকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হবে। তাদের এই প্রতিযোগিতায় আমরা ইতিবাচক কোনো প্রভাব ফেলতে পারছি না’ বলছিলেন আনোয়ার গারগেস।
যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আরব আমিরাত দেশটিতে স্থাপিত একটি চীনা স্থাপনা বন্ধ করে দিয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের অভিযোগ হচ্ছে, চীন এই স্থাপনাটি সামরিক ঘাঁটি হিসেবে ব্যবহার করে আসছে।
আনোয়ার গারগেস বলেন, ‘চীনের এই ঘাঁটি বন্ধ করে দিলে ও আরব আমিরাত ঘাঁটিটি নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের বয়ান সম্পূর্ণরূপে বিশ্বাস করেনি। ঘাঁটি বন্ধ করার কারণ হচ্ছে আরব আমিরাত চাচ্ছে না তারা গুরুত্বপূর্ণ কৌশলগত অংশীদার যুক্তরাষ্ট্রকে অসন্তুষ্ট করতে।’
এই ঘটনার পরিপ্রেক্ষিতে, সিএনএনের এক প্রশ্নের জবাবে চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক মুখপাত্র বলেন, ‘আমরা চীনা স্থাপনা বন্ধের ব্যাপারে ওয়াকিবহাল নয়। চীন-যুক্তরাস্ট্র সহযোগিতামূলক সম্পকর্রে মধ্যে যুক্তরাষ্ট্রের নাক গলানো এবং আরক আমিরাতকে ভয় দেখানোর চেষ্টা কঠোরভাবে প্রত্যাখ্যান করছে।’
এক বিবৃতিতে আরব আমিরাত জানায়, ‘চীন এবং আরব আমিরাত নিজেদের সার্বভৌমত্ব অক্ষুণ্ন রেখে স্বাভাবিক এবং ন্যায্য সম্পর্ক রক্ষা করে চলবে। এই সম্পর্ক রক্ষা করতে গিয়ে আমরা তৃতীয় কোনো পক্ষকে লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করি না।’
যুক্তরাষ্ট্র সব সময় মধ্যপ্রাচ্যে তার প্রভাব বিস্তারের খেলায় জয়ী হয় না। যুক্তরাষ্ট্র আবুধাবিকে এফ-৩৫ যুদ্ধবিমান দেওয়ার বিনিময়ে চীনের প্রতিষ্ঠান হুয়াই টেকনোলজিস কোং সঙ্গে সম্পাদিত চুক্তি বাদ দেওয়ার শর্ত আরোপ করে। কিন্তু আবুধাবি করেছে উল্টোটা। দেশটির শাসকরা প্রকারান্তে চীনের পক্ষ নিয়ে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পাদিত কয়েক বিলিয়ন ডলারের সামরিক সরঞ্জাম ক্রয় চুক্তি বাতিল করে।
ওয়াশিংটন অভিযোগ করে আসছে যে, চীনের টেলিযোগাযোগ প্রযুক্তি তার অস্ত্র নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থায় বিঘ্ন ঘটাবে।
মধ্যপ্রাচ্য এখন বিশ্ব শক্তির ক্ষমতা প্রদর্শনের মঞ্চ: পশ্চিমা ঔপনিবেশিক শক্তিগুলো মধ্যপ্রাচ্যর তেলসমৃদ্ধ দেশগুলোকে নিজেদের শক্তি প্রদর্শনের ক্ষেত্র হিসেবে ব্যবহার করার সময় থেকে এই অঞ্চলে গত এক শতাব্দী ধরে ভূরাজনৈতিক ক্ষেত্রে অস্থিরতা বিরাজ করছে।
কিন্তু এই অঞ্চলে ২০১০-এর মতো খুব কমই সহিংসতা দেখা যায়, যখন চারটি ভিন্ন দেশে সিরিয়া, ইয়েমেন, লিবিয়া এবং ইরাক একযোগে যুদ্ধ শুরু হলো। অন্যদিকে ইসরায়েল এবং অধিকৃত ফিলিস্তিনি ভূখণ্ডে দীর্ঘস্থায়ী সহিংসতা ব্যাপকভাবে ছড়িয়ে পড়ল। এসব ঘটনার আলোকে আরব বিশ্বের বিশাল একটি অংশে শুরু হয়ে গেল রক্তস্নাত।
মধ্যপ্রাচ্যে ক্ষমতা সংহত করার প্রক্রিয়া হিসেবে বেইজিং ইতোমধ্যে রিয়াদ এবং তেহরানের সঙ্গে ব্যাপক অর্থনৈতিক অংশীদারত্বমূলক সম্পর্ক স্থাপন করেছে। চীন আরব আমিরাতের সঙ্গে অর্থনৈতিক সম্পর্ক আরো জোরদার করেছে। এই দুই দেশ ইতোমধ্যেই শক্তিশালী ব্যবসায়িক অংশীদার হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। চীন এখন আরব আমিরাতের টেলিযোগাযোগ নেটওয়ার্ক উন্নয়নের মূল অংশীদার।
চীন নিজে যেহেতু মানবাধিকার লঙ্ঘনের অভিযোগে অভিযুক্ত সংগত কারণে বেইজিং, মধ্যপ্রাচ্যের মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিষয়ে নীরব থাকছে। কৌশলগত কারণে চীন মধ্যপ্রাচ্যর বিভিন্ন সংঘাত থেকে নিজেকে দূরেই রেখেছে বলা যায়। চীনের বাস্তবায়ধীন বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভের অন্যতম অপরিহার্য অংশীদার হচ্ছে মধ্যপ্রাচ্য। মধ্যপ্রাচ্য দিয়ে চীন এই বিশাল অবকাঠামোগত প্রকল্পকে কাজে লাগিয়ে চীন পূর্ব এশিয়াকে ইউরোপের সঙ্গে সংযুক্ত করতে চাচ্ছে।
মধ্যপ্রাচ্যে টাকা বিনিয়োগ করতে হবে যুক্তরাষ্ট্রকে: মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোকে চীনের প্রভাব বলয় থেকে দূরে রাখতে হলে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রচুর বিনিয়োগ করতে হবে। মধ্যপ্রাচ্যে যুক্তরাষ্ট্রের প্রধান দুর্বলতা হলো যে, ওয়াশিংটন বেইজিংয়ের দেওয়া আকর্ষণীয় চুক্তির বিকল্প কিছু ওয়াশিংটন দিতে পারছে না। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র হয়ত হুয়াওয়ে সঙ্গে করা চুক্তি থেকে বেরিয়ে আসতে সংযুক্ত আরব আমিরাতকে বাধ্য করার চেষ্টা করতে পারে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের হাতে এই চুক্তির বিকল্প কিছুই নেই।
২০২০ সালে লেবাননের আর্থিক সংকটের শুরুতে, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র লেবাননের ক্ষয়িষ্ণু অবকাঠামোতে চীনের বিনিয়োগ না নিতে বৈরুতকে চাপ দিয়েছিল। বৈরুতে নিযুক্ত মার্কিন রাষ্ট্রদূত ডরোথি চীনের এই অর্থ সাহায্যকে ‘ঋণ ফাঁদ’ বলে অভিহিত করে এর বিপদ সম্পর্কে সতর্কবার্তা জারি করেছিলেন। প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী হাসান দিয়াবের সরকার যুক্তরাষ্ট্রের চাপের কাছে নতি স্বীকার করতে বাধ্য হয়েছিলেন।
থিংকট্যাংক চ্যাথাম হাউসের সহযোগী ফেলো টিন হিনানে এল কাদি বলেছেন, ‘২০১৩ সালে বেল্ট অ্যান্ড রোড ইনিশিয়েটিভ শুরু হওয়ার পর থেকে সাম্প্রতিক বছরগুলোয় যুক্তরাষ্ট্রের চাপ তীব্র হয়েছে।’ সূত্র : সিএনএন।
মন্তব্য