-->
শিরোনাম
আল জাজিরার বিশ্লেষণ

যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধিতে ইরানের অর্থনীতি

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও প্রবৃদ্ধিতে ইরানের অর্থনীতি

অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ এবং পণ্ডিতরা যখন সম্ভাব্য ইউক্রেন হামলার প্রতিক্রিয়ায় রাশিয়ার বিরুদ্ধে দ্রুত এবং গুরুতর অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞার কথা ভাবছেন তখন কিন্তু আরেকটি দেশ অনেক আগে থেকেই যুক্তরাষ্ট্রের এই নিষেধাজ্ঞার ভিতর দিয়ে যাচ্ছে। এবং এই দেশটি হচ্ছে ইরান। ইরান এখন তাদের ওপর যুক্তরাষ্ট্র কি শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নিচ্ছে তা নিয়ে আর ভাবে না।

সেন্টার ফর নিউ আমেরিকান সিকিউরিটির (সিএনএএস) তথ্য অনুযায়ী, বারাক ওবামার প্রশাসন প্রায় ৬৫৫টি ইরানি প্রতিষ্ঠান এবং ব্যক্তির বিরুদ্ধে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছিল। কিন্তু ইরানের বিরুদ্ধে সবচেয়ে ভয়ংকর শাস্তিমূলক পদক্ষেপ ছিল ২০১৮ সালে যখন সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের প্রশাসন যুক্তরাষ্ট্র ও বিশ্বশক্তির সাথে করা ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে একতরফাভাবে প্রত্যাহার করে নেয়া। শুধুই তা নয়, ইরানের অর্থনীতিকে ধ্বংস করার জন্য ট্রাম্প প্রশাসন দেশটির ব্যাংকিং ব্যবস্থাকে সোসাইটি ফর ওয়ার্ল্ডওয়াইড ইন্টারব্যাংক ফিন্যান্সিয়াল টেলিকমিউনিকেশন (সুইফট) থেকে নিষিদ্ধ করে।

ট্রাম্প প্রশাসনের এই পদক্ষেপগুলোর কারণ হচ্ছে ইরানকে সর্বোচ্চ চাপ দিয়ে নতুন পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তি করা। ট্রাম্পের এই সর্বোচ্চ চাপ নীতির উদ্দেশ্য হচ্ছে ইরানের অর্থনীতিকে পঙ্গু করে তেহরানকে পারমাণবিক আলোচনার টেবিলে ফিরে আনতে বাধ্য করা।

২০২০ সালে ওয়াশিংটন ইরানের ব্যাংকগুলোর বিরুদ্ধে আবারও নতুন করে নিষেধাজ্ঞা আরোপ করলে ইরানের আর্থিকখাত কার্যত বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়ে। ওই একই বছর প্যারিসভিত্তিক বৈশ্বিক অর্থ পর্যবেক্ষণকারী সংস্থা, ফিন্যান্সিয়াল অ্যাকশন টাস্ক ফোর্স (এফএটিএফ) ইরানকে কালো তালিকাভুক্ত করে।

ট্রাম্প প্রশাসন ইরানের অর্থনীতিকে লক্ষ্যবস্তু করে দেশটির ওপর ৯৬০ টিরও বেশি অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে। সিএনএএসের মতে, কোভিড-১৯ এর সংক্রমণের কারণে ইরানের স্বাস্থ্যসেবা ব্যবস্থা যখন ভেঙ্গে পড়েছে তখন বিশ্ব নেতারা মানবিক কারণে এই সাময়িকভাবে নিষেধাজ্ঞাগুলো শিথিল করার আহ্বান করেন।

বারাক ওবামা ও ট্রাম্পের সময় আরোপিত নিষেধাজ্ঞা বর্তমান জো বাইডেন প্রশাসনের সময়ও চলমান আছে। অবস্থা এমন দাঁড়িয়েছে যে, ইরানের অর্থনীতির এমন কোনো খাত নেই যার বিরুদ্ধে ওয়াশিংটন শাস্তিমূলক ব্যবস্থা নেয়নি। এই নিষেধাজ্ঞার ফলে ইরানে পর পর দুইবছর মন্দা দেখা দেয় এবং জনগণের দৈনন্দিন জীবনের ওপর গভীর প্রভাব ফেলে।

ইরানের পরিসংখ্যান ব্যুরোর তথ্য অনুসারে, দেশটির বার্ষিক মুদ্রাস্ফীতি ৪২ শতাংশের ওপরে গিয়ে ঠেকেছে। ইরানের জাতীয় মুদ্রা রিয়াল গত তিনবছরে তার মূল্য অর্ধেকেরও বেশি হারিয়েছে। ইউএস এনার্জি ইনফরমেশন অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের তথ্য মতে, ২০১৭ সালে ইরান যেখানে প্রতিদিন প্রায় ২.৫ মিলিয়ন ব্যারেল তেল রপ্তানি করত ২০২০ সালে এই রপ্তানি নেমে এসে ০.৪ মিলিয়ন ব্যারেলে। যদিও গতবছর তেল রপ্তানিতে ইরান কিছুটা পুনরুদ্ধার করতে পেরেছে।

ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খোমেনি রোববার ব্যবসায়ী ও নির্মাতাদের উদ্দেশ্যে দেওয়া বক্তৃতায় বলেছেন, গত এক দশকে অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি, মুদ্রাস্ফীতি এবং বিদেশি বিনিয়োগের তথ্য সন্তোষজনক নয়।

যুক্তরাষ্ট্রের এত নিষেধাজ্ঞা সত্ত্বেও ইরানের অর্থনীতি কিন্তু পুরোপুরি ভেঙে পড়েনি। ২০২১ সাল থেকে ইরানে আবারো অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি হতে শুরু করল। এই প্রবৃদ্ধির মূলে রয়েছে গতবছর আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য সহজ করা, কোভিড-১৯ বিধিনিষেধ উঠিয়ে দেওয়া এবং আন্তর্জাতিক বাজারে তেলের দাম বাড়া।

ইরানের অর্থনীতি অনেক বেশি সহনশীল ও বৈচিত্র্যপূর্ণ হওয়াই ২০২০-২১ সালে ২.৪ শতাংশ হারে প্রবৃদ্ধি হয়েছে। বিশ্বব্যাংক ২০২১-২২ সালে ৩.১ শতাংশ হারে বৃদ্ধির আভাস দিয়েছে।

প্রতিরোধ অর্থনীতি ইরানের ইব্রাহিম রাইসির প্রশাসন যথেষ্ট উচ্চাভিলাষী ৮ শতাংশ প্রবৃদ্ধির লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করেছেন। রক্ষণশীল এই রাষ্ট্রপতি তার অর্থনৈতিক লক্ষ্য অর্জন করতে প্রতিরোধ অর্থনীতির ধারণাকে সামনে রেখে। তার এই অর্থনৈতিক লক্ষ্যের মূলে রয়েছে অর্থনৈতিকভাবে স্বয়ংসম্পূর্ণতা অর্জন করা, আঞ্চলিক প্রতিবেশী দেশ যেমন-চীন ও রাশিয়ার সাথে বাণিজ্য সম্পর্ক বাড়ানো।

বিজান খাজেহপুর, ইউরেশিয়ান নেকসাস পার্টনারস (ইউনেপা) এর ব্যবস্থাপনা অংশীদার মনে করেন, ইরানের ব্যাংকগুলো কালো তালিকাভুক্ত হওয়ার কারণে ইরানের আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের সম্ভাবনা সীমিত হয়ে এসেছে।

খাজেহপুর আল জাজিরাকে আরো বলেন, যদি ব্যাংকের ওপর বিধিনিষেধ বহাল থাকে তবে আর্থিক লেনদেনের ক্ষেত্রে খরচ বাড়বে এবং আমদানি ও রপ্তানিও ব্যয়বহুল হবে। এইসব ব্যবস্থার ফলে ইরানের বাজারে ব্যবসা ও কোম্পানিগুলোর লেনদেন করা আরো সীমিত হয়ে পড়বে।

খাজেহপুর মনে করেন, এতসব সমস্যা নিয়ে ইরানের অর্থনীতি বেশি আগাবে না। তিনি আরো বলেন, ইরানের অর্থনীতিকে ঠেকসই করতে হলে প্রয়োজন অবকাঠামো খাতে প্রচুর বিনিয়োগ এবং তা সম্ভব হবে যদি ইরানের ওপর নিষেধাজ্ঞা উঠে যাবে।

চীন ও রাশিয়া

ইরানের আয়ের সিংহভাগ আসবে তেল রপ্তানি থেকে এবং চীন ইরানি তেলের শীর্ষ ক্রেতা। নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরান তেল রপ্তানির তথ্য গোপন রাখে। ইরান তেল ব্যবসা করে মূলত মালয়েশিয়া, ওমান এবং সংযুক্ত আরব আমিরাতের নামে।

যদিও গতবছরের জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে চীন ঘোষণা করেছে যে, তারা যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে ২০২০ সালের ডিসেম্বরের পর থেকে ইরান থেকে প্রথম অপরিশোধিত তেল আমদানি করে আসছে।তেলের বাজার এখনও ইরানের অনুকূলে আছে কারণ গত সপ্তাহে তেলের দাম সাতবছরের মধ্যে সবচেয়ে বেশি। ইউক্রেন নিয়ে রাশিয়া এবং পশ্চিমের মধ্যে উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণে তেলের দাম বৃদ্ধি পাচ্ছে। সাবেক প্রেসিডেস্ট হাসান রুহানি প্রশাসনের তুলনায় বর্তমানে ইরানের তেল রপ্তানি ৪০ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে ।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হোসেইন আমির আব্দুল্লাহিয়ান চীনের জিয়াংসু সফরের সময় সাংবাদিকদের বলেছিলেন যে ২০২০ সালে স্বাক্ষরিত ২৫ বছরের চীন-ইরান সহযোগিতা চুক্তি বাস্তবায়ন পর্যায়ে প্রবেশ করেছে। যদিও তিনি কি বাস্তবায়ন করছে, কিভাবে বাস্তবায়ন করছে এর বিস্তারিত কিছুই জানাননি।

অন্যদিকে ইরানের প্রেসিডেন্ট রাইসি ক্রেমলিন সফরে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের সাথে সাক্ষাৎ করেন এবং দুই নেতা সম্পর্ক আরো ঘনিষ্ট করার প্রত্যয় ব্যক্ত করেছেন।

খুবই আশাবাদী হওয়ার মতো কিছু কি আছে

জ্বালানি বিষয়ক সাংবাদিক এবং বিশ্লেষক হামিদ্রেজা শোকাউহির মতে, চীন এবং রাশিয়ার সাথে ইরানের উষ্ণ সম্পর্ক যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে সৃষ্ট ক্ষতি পুরোপুরিভাবে সারিয়ে তুলতে পারবে না। ইউক্রেন ইস্যুতে আমরা রাশিয়া এবং যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে প্রতিদ্বন্দ্বিতা দেখছি অন্যদিকে চীন-যুক্তরাষ্টের প্রতিদ্বন্দি¦তা স্বাভাবিকভাবেই কিছু প্রভাব ফেলবে, তবে ইরানের ওপর আরোপিত যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার প্রভাব কমানোর জন্য এই দেশগুলোর ক্ষমতার ওপর নির্ভর করা যাবে না বলছেন হামিদ্রেজা শোকাউহির।

শোকাউহির মতে, জ¦ালানি খাতে ইরান তেল বিক্রির জন্য শুধুমাত্র চীনের ওপর নির্ভর করতে পারে এবং জ¦ালানি প্রকল্পগুলোর উন্নয়ন এবং বিনিয়োগের জন্য রাশিয়ার ওপর নির্ভরতা বাড়বে। কিন্তু যুক্তরাষ্ট্রের নিষেধাজ্ঞার কারণে ইরানের জ¦ালানি খাতে বিনিয়োগ এবং তেল রপ্তানি এই সম্ভাবনাকে সীমিত করে আনতে পারে।

গত সপ্তাহে, ইরানের অর্থমন্ত্রী এহসান খানদুজি ঘোষণা করেছেন যে রাশিয়া রাইসির সফরে হরমোজগানে সিরিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রে রাশিয়া নতুন করে বিনিয়োগ করতে সম্মত হয়েছে।

প্রতিবেশী এবং ভিয়েনা আলোচনা

ইউএনইপিএ এর খাজেহপুরের মতে, আঞ্চলিক প্রতিবেশীদের সাথে ইরানের বাণিজ্য দেশটির অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে অবদান রাখলেও এই ব্যবস্থায় সীমাবদ্ধতা রয়েছে। তবে অভিজ্ঞতার আলোকে দেখা যায় যে কোনো কোম্পানিগুলো রপ্তানি বাজারে প্রবেশ করলে হউক না তা আঞ্চলিক বাজার কিস্তু পরে ওই কোম্পানিগুলো আন্তর্জাতিক বাজারে নিজের একটা অবস্থান করে নেয়।

অনেকেই হয়ত মনে করতে পারে যে, আঞ্চলিক বাজারে ইরানের এই রপ্তানি আন্তর্জাতিক বাজারে প্রবেশের ক্ষেত্র হতে পারে, বলছিলেন খাজেহপুর।

খাজেহপুর এবং শোকাউহি উভয়েই মনে করেন, ইরান যদি তার অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে চাই, তাহলে অস্ট্রিয়ার রাজধানীতে চলমান পারমাণবিক অস্ত্র আলোচনা সফল করতে হবে।

শোকাউহি মনে করেন, ইরানের জনগণ এবং ব্যবসায়ী সম্প্রদায় খুব করে চাচ্ছে সকল পক্ষ পারমাণবিক অস্ত্র চুক্তি নিয়ে সমাধানে আসুক। তা হবে ইরানের অর্থনীতির জন্য আশার আলো। যদি কোনো চুক্তি না হয়, নিষেধাজ্ঞার মতো কঠোর পরিস্থিতিতে আমি ইরানের অর্থনীতির জন্য ভাল কিছু কল্পনা করতে পারছি না

আল জাজিরা থেকে অনূদিত

মন্তব্য

Beta version