-->
শিরোনাম

রাশিয়া কেন ন্যাটোকে বিশ্বাস করে না : টাইমের বিশ্লেষণ

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
রাশিয়া কেন ন্যাটোকে বিশ্বাস
করে না : টাইমের বিশ্লেষণ

১৯৪৯ সালে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা এবং ১০টি পশ্চিম ইউরোপীয় দেশ যখন উত্তর আটলান্টিক চুক্তি (ন্যাটো) সংস্থা গঠনের জন্য একত্রিত হয়েছিল তখন তাদের একটি স্পষ্ট লক্ষ্য ছিল রাশিয়া ঠেকাও।

ন্যাটোর প্রথম সেক্রেটারি জেনারেল লর্ড হেস্টিংস লিওনেল ইসমে ন্যাটো গঠনের পরিপ্রেক্ষিত বর্ণনা করেছেন এইভাবে ‘সোভিয়েত ইউনিয়নকে দূরে রাখুন, আমেরিকাকে ঢুকতে দিন জার্মানির পতন হোক’। যুক্তরাষ্ট্র নেতৃত্বাধীন সামরিক জোট ন্যাটো গঠনের উদ্দেশ্য ছিল দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের ধ্বংসস্তূপ থেকে ইউরোপকে পুনর্গঠন করা এবং ইউরোপে সোভিয়েত ইউনিয়নের আগ্রাসন মোকাবিলা করা।

কিন্তু সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর ন্যাটোর অস্তিত্ব আর প্রাসঙ্গিক নয়। প্রকৃতপক্ষে ১৯৯০ সালে শীতল যুদ্ধ যখন সমাপ্তির দিকে সোভিয়েত প্রেসিডেন্ট মিখাইল গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়নকে ন্যাটোতে যোগদানের প্রস্তাব করেন।

গর্বাচেভ যখন তৎকালীন মার্কিন পররাষ্ট্রমন্ত্রী জেমস বেকারের সঙ্গে জার্মানির পুনর্মিলনের আলোচনা করছিলেন তখন তিনি বেকারকে বলেছিলেন ‘আপনি বলেছিলেন যে, ন্যাটোর গঠন আমাদের (সোভিয়েত ইউনিয়ন) উদ্দেশ্য করে নয়’। গর্বাচেভ সোভিয়েত ইউনিয়ন এবং পূর্ব ইউরোপের কমিউনিস্ট দেশগুলোর সঙ্গে ওয়ারশ চুক্তির কথা উল্লেখ করে বলেন ‘এটি কেবল একটি নিরাপত্তা কাঠামো যা এই নতুন বাস্তবতার সঙ্গে জড়িত তাই আমরা (সোভিয়েত ইউনিয়ন) ন্যাটোতে যোগদানের প্রস্তাব করছি।’

বেকার গর্বাচেভের এই প্রস্তাবকে ‘স্বপ্ন’ আখ্যা দিয়ে প্রত্যাখ্যান করে দেয়। পরে যদিও এই দাবি বেশ কয়েকবার উঠেছে। যে রাশিয়াকে মোকাবিলা করার জন্য ন্যাটোর সৃষ্টি তা গত বৃহস্পতিবার ৭০ বছরে পদার্পণ করেছে এবং সেই থেকেই ন্যাটোতে অনেক রদবদল হয়েছে।

স্নায়ুযুদ্ধের অবসান এবং সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের তিন দশক পরও ন্যাটোর অস্তিত্ব থাকার কার্যকারণ এখনো বিদ্যমান। প্রতিষ্ঠাবার্ষিকী উপলক্ষে ন্যাটোর পররাষ্ট্রমন্ত্রীরা যখন ওয়াশিংটনে মিলিত হচ্ছে তখন এই সামরিক জোটের অস্তিত্বের প্রশ্ন সামনে আসছে।

শীতল যুদ্ধের পর রাশিয়া ও ন্যাটোর মধ্যে কী ঘটেছিল : ১৯৯১ সালে রাশিয়ার প্রথম প্রেসিডেন্ট বরিস ইয়েলতসিন, গর্বাচেভের প্রস্তাবের পুনরাবৃত্তি করে ন্যাটোকে চিঠি লিখেছিলেন। তিনি পশ্চিমা জোট ন্যাটোতে যোগদানের জন্য হাঙ্গেরির মতো সাবেক ওয়ারশ চুক্তির অধীন দেশগুলোর ইচ্ছার পুনরাবৃত্তি করে ন্যাটোর সদস্যপদকে রাশিয়ার ‘দীর্ঘমেয়াদি রাজনৈতিক লক্ষ্য’ বলে অভিহিত করেন।

সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর, ন্যাটো তার উদ্দেশ্য পুনর্নির্ধারণ করতে শুরু করে। ন্যাটোর মন্টিনিগ্রোর সাবেক রাষ্ট্রদূত ভেস্কো গার্সেভিক বলেন, ‘সোভিয়েতের পতনের স্থিতিশীল ইউরোপ নিশ্চয়ত করতে ন্যাটো কমিউনিস্ট শাসিত প্রজাতন্ত্রগুলোকে গণতান্ত্রীকরণ করা শুরু করল। ন্যাটোতে যোগদানের পর বেশিরভাগ দেশ ইউরোপিয়ন ইউনিয়নের সদস্য হলো। ন্যাটো এখন আর ‘শুধু নিরাপত্তার সহযোগী নয়’বরং একটা রাজনৈতিক সংগঠন। আর এই কারণেই জোটটি এত বছর ধরে টিকে আছে’ বলে মনে করেন গার্সেভিক।

১৯৯৪ সালে, রাশিয়া আনুষ্ঠানিকভাবে ন্যাটোর সঙ্গে শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে চুক্তি স্বাক্ষর করে। এই চুক্তির অন্যতম উদ্দেশ্য হচ্ছে ন্যাটোর সঙ্গে ইউরোপীয় দেশ এবং সাবেক সোভিয়েতভুক্ত দেশগুলোর মধ্যে আস্থার পরিবেশ তৈরি করা। ১৯৯৪ সালের জানুয়ারিতে স্বাক্ষরিত চুক্তির কথা উল্লেখ করে প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন বলেন, ‘এই চুক্তি এক সময় রাশিয়াকে ন্যাটোর সদস্য করার দিকে নিয়ে যাবে’।

প্রেসিডেন্ট পুতিন ২০১৭ সালে চলচ্চিত্র নির্মাতা অলিভার স্টোনকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেছিলেন তিনি ২০০০ সালে ক্লিনটনের মস্কো সফরের সময় রাশিয়ার ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়ে আলোচনা করেছিলেন। ২০০০ সালের শুরুর দিকের পুতিনের সঙ্গে সাক্ষাতের কথা উল্লেখ করে ডেনমার্কের সাবেক প্রধানমন্ত্রী আন্ডারস ফগ রাসমুসেন বলেছিলেন ‘আমি ধারণা পেয়েছিলাম যে রাশিয়া পশ্চিমাপন্থি এবং ট্রান্সআটলান্টিক জোটে যোগদানের জন্য উন্মুখ হয়ে আছে।’

শীতল যুদ্ধের অবসানের পর থেকে ১৩টি দেশ ন্যাটোতে যোগ দিয়েছে। তার মধ্যে আছে চেক প্রজাতন্ত্র, হাঙ্গেরি, পোল্যান্ড, বুলগেরিয়া, এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুয়ানিয়া, রোমানিয়া, সেøাভাকিয়া এবং সেøাভেনিয়া, আলবেনিয়া, ক্রোয়েশিয়া এবং মন্টিনিগ্রো।

রাশিয়া কেন ন্যাটোর সদস্য নয় : ন্যাটোতে রাশিয়ার যোগদানের ইঙ্গিত দেওয়ার পরও ইউরোপ আর রাশিয়া নিয়ে তাহলে এত উত্তেজনা কেন থাকবে। ২০০৯ থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত ন্যাটো মহাসচিবের দায়িত্ব পালন করা সাবেক ডেনিশ প্রধানমন্ত্রী রাসমুসেন বলেছেন, ‘রাশিয়া যদি গণতন্ত্র ও মানবাধিকার সমুন্নত রাখে তাহলে ন্যাটো রাশিয়ার সদস্যপদ গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনা করবে।’

রাসমুসেন বলেন, ‘আমরা মস্কোর সঙ্গে শক্তিশালী সহযোগিতামূলক সম্পর্ক গড়ে তোলার চেষ্টা রেছি।’ ২০০২ রাশিয়া-ন্যাটো কাউন্সিলের উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, ‘এই কাউন্সিল হচ্ছে ১৯৯৭ প্রণিত আইনের ধারাবাহিকতা। এই কাউন্সিলের কারেন ন্যাটো ও ইউরোপের মধ্যে উন্নয়ন, ঐকমত্য এবং যৌথ-সিদ্ধান্ত গ্রহণের ক্ষেত্র হিসেবে কাজ করেছে। আমরা আফগানিস্তানে সন্ত্রাসবাদ, মাদক দমন এবং জলদস্যুতা দমনে এক অন্যকে সহযোগিতা করেছি।’

‘ন্যাটোর কাছে রাশিয়া বারবার একটি অনুরোধ করেছে তা হলো রাশিয়ার পূর্ব প্রতিবেশী দেশগুলো যাতে ন্যাটোর সদস্য না হয়। ন্যাটো বরাবরই এই দাবি প্রত্যাখ্যান করে এসেছে’ বলছেন রাসমুসেন।

রাশিয়ার দাবি প্রত্যাখ্যান করে ২০০৮ সালের এপ্রিলে অনুষ্ঠিত বুখারেস্ট শীর্ষ সম্মেলনে ন্যাটো জর্জিয়া এবং ইউক্রেনকে সদস্যপদ দেওয়ার ঘোষণা দেয়। এই ঘোষণার প্রতিক্রিয়ায় ২০০৮ সালের আগস্ট মাসে রাশিয়া দক্ষিণ ওসেটিয়া এবং আবখাজিয়ার বিচ্ছিনতাবাদী রক্ষার নামে জর্জিয়ায় আক্রমণ শুরু করে এবং তা পাঁচ দিন স্থায়ী হয়। নিহত হয় ৮ শতাধিক মানুষ।

দক্ষিণ ওসেটিয়া এবং আবখাজিয়া স্বাধীনতা ঘোষণা করলে রাশিয়া এবং গুটিকয়েক দেশ এই দেশগুলোকে স্বীকৃতি দিয়েছে। রাসমুসেন বলেছেন, ‘আমরা বুখারেস্ট থেকে ভুল সংকেত পাঠিয়েছিলাম।’

পুতিন ন্যাটোর পরীক্ষা নেওয়া অনেক আগে থেকে চালিয়ে যাচ্ছে। ইউক্রেনের সম্ভাব্য ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্তির প্রতিক্রিয়ায় পুতিন ২০১৪ সালে, ক্রিমিয়াকে ইউক্রেন থেকে আলাদা করে রাশিয়ার সঙ্গে সংযুক্ত করে নেয়। রাশিয়া ইউক্রেন সংঘাতে ১৩ হাজারেরও বেশি লোক হতাহতের শিকার হয়েছেন।

সাবেক ক্রেমলিন উপদেষ্টা সের্গেই কারাগানভ টাইমকে বলেছেন, ইতিহাস অন্যরকম হতে পারত। রাশিয়াকে ন্যাটোতে অন্তর্ভুক্ত না করা ছিল ‘রাজনৈতিক ইতিহাসের সবচেয়ে মারাত্মক ভুলগুলোর একটি’।

ন্যাটো নিয়ে রাশিয়ার ভাবনা কি : ‘২০১৪ সালে রাশিয়ার ক্রিমিয়া দখলের পর থেকে ন্যাটো এবং রাশিয়ার মধ্যে উত্তেজনার পারদ আকাশচুম্বী। বাল্টিকসহ রাশিয়ার সীমান্তবর্তী দেশগুলো সবসময় রাশিয়ার ভয়ে ভীত থাকে। যদি এই দেশগুলো ন্যাটোতে যোগ না দিয়ে ‘নিরপেক্ষ’ থাকত তাহলে তাদের রাশিয়ার ভয়ে থাকা লাগত না’ বলছেন কারাগানভ।

২০১৪ সাল থেকে রাশিয়া এবং ন্যাটোর সম্পর্ক শীতল যুদ্ধের সময়ে ফিরে এসেছে। রাশিয়া থেকে আগত হুমকি অনেক বেশি জটিল, বলেছেন সাবেক ন্যাটোর মহাসচিব রাসমুসেন। রাসমুসেনের মতে, রাশিয়া এখন ‘ভূ-রাজনৈতিক স্পয়লার’ হয়ে উঠেছে যা গণতান্ত্রিক সমাজের আস্থা, বিশ^াস এবং স্থিতিশীলতাকে ক্ষুণ্ন করতে চায়।

রাশিয়ার যুদ্ধের ভাব এবং নিয়মিত সামরিক মহড়া পোল্যান্ড ও তার প্রতিবেশী বাল্টিক দেশগুলোতে ভয় পাইয়ে আসছে। এমনকি যে দেশগুলো ভৌগোলিকভাবে রাশিয়া থেকে অনেক দূরে, যেমন বলকান, তারাও রাশিয়ার ভয়ে তটস্ত থাকে।

এখন আর মস্কোর ন্যাটোতে যোগ দেওয়ার কোনো কারণ নেই বলছেন রাসমুসেন।  ক্রিমিয়া দখলের পরপরই রাশিয়ান পার্লামেন্টের এক ভাষণে পুতিন বলেছিলেন, ‘কমিউনিজমের পতনের পর ন্যাটোর পূর্বদিকে সম্প্রসারণের কারণে রাশিয়া অপমানিত হয়েছিল। তারা আমাদের সঙ্গে অনেকবার মিথ্যার আশ্রয় নিয়েছে এবং রাশিয়াকে না জানিয়ে সিদ্ধান্ত নিত’।

২০১৯ সালেও কি ন্যাটোর কার্যকারিতা আছে? : রাসমুসেনের মতে, ‘ন্যাটোর প্রয়োজন কখনোই বেশি ছিল না।’ ন্যাটোর সদস্যভুক্ত দেশগুলো রুশ হুমকি মোকাবিলায় কৌশলগত ঐক্য দেখিয়ে আসছে। ২০১৪ সাল থেকে হুমকি মোকাবিলায় ন্যাটো জোটের সর্বদা ‘প্রস্তুতির’ কারণে পূর্ব ইউরোপে প্রায় ৪ হাজার অতিরিক্ত সৈন্য মোতায়েন করে রাখতে হচ্ছে।

ক্রিমিয়া অধিগ্রহণরে প্রতিবাদে রাশিয়ার বিরুদ্ধে অর্থনৈতিক নিয়েধাজ্ঞা দিলেও অস্ট্রিয়া, ইতালি, হাঙ্গেরি এবং অন্যান্য সদস্য রাষ্ট্রের নিয়মিত সমালোচনা করে আসছে।

রাসমুসেনের মতে, ‘রাশিয়ার চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় ন্যাটো কখনোই একমত হতে পারেনি। শুধুমাত্র কয়েকটি ন্যাটোভুক্ত দেশ ইউক্রেনের সশস্ত্র বাহিনীকে সামরিক সাহায্য প্রদানের সাহস করেছিল। তার মধ্যে আছে, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, পোল্যান্ড, সেøাভাকিয়া, বাল্টিকস এবং যুক্তরাজ্য। এই দেশগুলো ইউক্রেনকে সাহায্য করেছে স্বেচ্ছাসেবী হিসেবে, ন্যাটোর অংশ হিসেবে নয়। হাঙ্গেরি ন্যাটো এবং ইউক্রেনের সঙ্গে প্রাতিষ্ঠানিক সম্পর্ক অনেকাংশই সংকুচিত করেছে।

রাশিয়া ক্রিমিয়া দখল করার পর, জার্মানি এবং ফ্রান্সসহ কিছু বড় ইউরোপীয় দেশের প্রতিক্রিয়া দেখে আমি অবাক হয়েছি’ রাসমুসেন বলেন। রাসমুসেন মনে করেন, ‘১৯৯০ সালে জার্মানির একত্রীকরণ মেনে নেওয়ায় রাশিয়ার প্রতি ঐতিহাসিক কৃতজ্ঞতা থেকেই জার্মানি চুপ ছিল। অন্যদিকে ফ্রান্স মনে করে ‘এই অঞ্চলে একটি বড় দেশ হিসেবে রাশিয়ার স্বার্থকে সম্মান করা উচিত।’

ন্যাটোর ইতিহাসে প্রথমবারের মতো কোনো মার্কিন প্রেসিডেন্ট এই নিরাপত্তা জোটের অস্তিত্ব নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন। ডোনাল্ড ট্রাম্প ন্যাটোর প্রতি ওয়াশিংটনের দায়বদ্ধতা নিয়ে প্রশ্ন তুলে ন্যাটোকে অচল বলে মন্তব্য করেছেন।

টাইম থেকে অনূদিত।

মন্তব্য

Beta version