-->
শিরোনাম

পাকিস্তান ও আফগান তালেবান বন্ধুত্বে ফাঁটল!

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
পাকিস্তান ও আফগান তালেবান বন্ধুত্বে ফাঁটল!

গত বছরের আগস্টে তালেবানের আফগানিস্তানের রাজধানী কাবুল দখলের ঘটনায় ইসলামাদে অসংখ্য মানুষকে উল্লাস করতে দেখা যায়। পশ্চিমা সমর্থিত আফগান সরকার উৎখাতের ঘটনাকে প্রতিবেশী দুই দেশের মধ্যে সম্পর্ক পুনঃস্থাপনের সুযোগ হিসেবে ভাবতে শুরু করে অনেকেই। কিন্তু সাম্প্রতিক মাসগুলোতে দেশ দুটির কার্যক্রম দেখে মনে হচ্ছে তাদের সম্পর্কে ফাটল ধরেছে বা বন্ধুত্ব আর আগের মতো নেই। সীমানা নির্ধারণ নিয়ে দুই দেশের মধ্যে উত্তেজনা ক্রমে বাড়ছে। এছাড়া তালেবান সমর্থিত তেহরিক-ই-তালেবান পাকিস্তানও (টিটিপি) উত্তেজনা বৃদ্ধির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে। এই ইস্যুগুলোর যদি শিগগিরই সমাধান না হয় তাহলে তা দুই দেশের সম্পর্কে প্রভাব ফেলবে। এতে পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তাই শুধু নয় আঞ্চলিক স্থিতিশীলতা মারাত্মক ক্ষতিগ্রস্ত হবে।

আশরাফ গানি আফগানিস্তানের প্রেসিডেন্ট হিসেবে ক্ষমতায় আরোহণের পর পাকিস্তানের সঙ্গে সম্পর্ক প্রায় তলানিতে এসে ঠেকে। তালিবান সরকার গঠনের পর আন্তর্জাতিক পরিমণ্ডলে ইসলামাবাদ ছিল তাদের প্রধান সমর্থক। আফগানিস্তানে তালিবান সরকারকে স্বীকৃতি দিতে আর্থিক সহায়তা প্রদান করতে আন্তর্জাতিক মহলের প্রতি আহ্বান জানিয়ে আসছে পাকিস্তান। সীমান্ত উত্তেজনা : গত বছরের সেপ্টেম্বরের শুরুতে তালেবান যখন সরকার গঠন করছিল তখন পাকিস্তানের সাবেক গোয়েন্দা প্রধান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফাইজ হামিদ কাবুল সফরে যান। আফগান ও পাকিস্তান সূত্র মতে, হামিদ অন্তর্বর্তী মন্ত্রিপরিষদ গঠনে নিজস্ব মতের প্রতিফলন ঘটাতে সক্ষম হন। তার হস্তক্ষেপে মোল্লা ঘানি বারাদার প্রধানমন্ত্রী হতে পারেননি। হাক্কানি নেটওয়ার্কের পাকিস্তানপন্থি ব্যক্তিদের নিয়ে সরকার গঠন করা হয়। বিশিষ্ট তালেবান নেতা বারাদার ২০১০ সাল থেকে ২০১৮ সাল পর্যন্ত পাকিস্তানের জেলে ছিল। এজন্য তিনি পাকিস্তানকে শত্রু রাষ্ট্র মনে করেন' এমনটাই ধারণা ইসলামাবাদের। এ রকম একজন ব্যক্তি আফগান সরকারের প্রধান হলে কখনোই পাকিস্তানকে বন্ধু ভাবতে পারবে না। হাক্কানি নেটওয়ার্ক আফগান সরকারের বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বে রয়েছে। স্বরাষ্ট্র, যোগাযোগ, শিক্ষা-শরনার্থী-পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় তাদের নিয়ন্ত্রণে। তাদের ইসলামাবাদ ঘেঁষা বলেই মনে করা হয়।

সরকার গঠন প্রক্রিয়াকে প্রভাবিত করার ঘটনা কাবুলে পাকিস্তানের প্রভাব-প্রতিপত্তিকেই তুলে ধরে। এটা কাবুল সরকারের কারো কারো মধ্যে ক্ষোভের সঞ্চার করেছে। গত বছরের ডিসেম্বরের শেষদিকে এবং জানুয়ারির শুরুতে পাকিস্তানকে সীমান্তে বেড়া নির্মাণে আফগান সীমান্তরক্ষীদের বাঁধা দেওয়ার ঘটনায় সেটি স্পষ্ট হয়েছিল। ডুরান্ড লাইন অনুযায়ী দুই দেশ বিভক্ত হলেও সীমান্তের কিছু এলাকা এখনো অমীমাংসিত। যদি বেড়া নির্মাণ করা হয় তাহলে সীমান্তের দুই পাশে থাকা একটি জাতিগোষ্ঠী বিচ্ছিন্ন হয়ে যাবে।

আফগান তথ্যমন্ত্রী ও সরকারের প্রধান মুখপাত্র জাবিউল্লাহ মুজাহিদ পশতু সম্প্রদায়ের প্রতিনিধিত্ব করা পশতুভাষী একটি ইউটিউব চ্যানেলে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, আফগানিস্তানের বৃহত্তম একটি জাতিগোষ্ঠীর বসবাস এখানে এবং তারা পাকিস্তানেও দ্বিতীয় বৃহত্তম জাতিগোষ্ঠী। এ বিষয়ে পাকিস্তান সেনাবাহিনীর মুখপাত্র মেজর জেনারেল বাবর ইফতেখার এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, এটি নির্মাণ করতে গিয়ে আমাদের সেনাদের রক্ত ঝড়েছে। আমরা শান্তি প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে এই বেড়া হচ্ছে। এর নির্মাণ যথাস্থানেই সম্পন্ন হবে।

১৮৯৩ সালে ব্রিটিশ ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মরটিমার ডুরান্ড ও আফগান শাসক আমির আবদুল রহমান দুই দেশের মধ্যে এই সীমান্ত লাইন নির্ধারণ করেন। এটিই ডুরান্ড লাইন হিসেবে পরিচিত। ১৯৪৭ সালে পাকিস্তান সৃষ্টির পর এই ডুরান্ড লাইন নিয়ে আপত্তি জানিয়ে আসছে ইসলামাবাদ। শুধু তাই নয়, সীমান্তে পশতু উপজাতি অধ্যুষিত কিছু এলাকা পাকিস্তানের অন্তর্ভুক্তির ঘটনাও কাবুলকে চ্যালেঞ্জের মুখে ফেলেছে।

সাম্প্রতিক বছর অর্থাৎ আফগানিস্তানের সাবেক দুই প্রেসিডেন্ট হামিদ কারজাই এবং আশরাফ ঘানির শাসনামলেও ডুরান্ড লাইন নিয়ে সমস্যায় পড়তে হয়েছে। এই ইস্যুতে তালেবান সরকারও পূর্বসূরিদের পথে হাঁটছে। অন্যদিকে সীমান্ত ইস্যুতে পাকিস্তানকে কোনো ধরনের ছাড় দিতে পারে এমন কোন লক্ষণ দেখা যাচ্ছে না।

সাম্প্রতিক সময়ে নতুন করে দেখা দেওয়া এই বিবাদ নিরসনে উভয়পক্ষই ব্যর্থ হয়েছে। জানুয়ারির শেষ দিকে পাকিস্তানের ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার (পাকিস্তানের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা) মঈদ ইউসুফ কাবুলে যান। তিনি কেবল দ্বিপক্ষীয় সমন্বয় প্রক্রিয়া অর্থাৎ, দুই দেশের মধ্যে পণ্য পরিবহণ ও বাণিজ্য সহজতর করার বিষয়ে আলোচনা করেই ফিরে যান। সীমান্তে বেড়া নির্মাণের বিষয়টি অমীমাংসিতই রয়ে গেছে।

টিটিপিকে সমর্থন : কাবুল ও ইসলামাবাদের মধ্যে বিরোধের অন্যতম কারণ হয়ে হলো টিটিপি। সশস্ত্র এই গোষ্ঠী আফগান তালেবানের হয়ে যুক্তরাষ্ট্র ও তার সমর্থিত সরকারের বিরুদ্ধে বছরের পর বছর ধরে যুদ্ধ করে গেছে। তাদের মধ্যে বন্ধন বেশ শক্ত। গত বছরের ১৫ আগস্ট কাবুল দখলের পর আফগান জেলে বন্দি শত শত টিটিপি কর্মীকে ছেড়ে দেয় তালিবান। এর মধ্যে টিটিপির বেশ কয়েকজন বিশিষ্ট নেতাও রয়েছেন। বেশিরভাগ টিটিপি নেতা ও কর্মী আফগানপন্থি।

২০০৭ সালে টিটিপি গঠন হয়। এরপর থেকেই পাকিস্তানে বেশকয়েকটি রক্তক্ষয়ী সহিংসতার ঘটনা ঘটায় টিটিপি। নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক নাগরিক- উভয়কেই তারা হামলার লক্ষ্যবস্তুতে পরিণত করে। পাকিস্তান সরকারের মতে, আল-কায়েদা ও তাদের সহযোগী কিছু গোষ্ঠীকে নিয়ে টিটিপি সেদেশের ৮০ হাজারেরও বেশি মানুষকে হত্যা করেছে। তাদের কারণে ১৫০ বিলিয়নের বেশি ডলার পরিমাণ আর্থিক ক্ষতি হয়েছে। ২০১৪ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনী টিটিপির বিরুদ্ধে বড় ধরনের অভিযান শুরু করে। সেনাবাহিনীর বাধার মুখ টিকতে না পেরে টিটিপির অনেক নেতাকর্মী আফগানিস্তানে পালিয়ে যান। এরপর বেশ কিছুদিন পরিস্থিতি মোটামুটি শান্ত থাকে। কিন্তু গত কয়েক বছর ধরে টিটিপির হামলা-সহিংসতার ঘটনা উল্লেখযোগ্যভাবে বেড়েছে। ২০২১ সাল তালেবান কাবুলের দিকে অগ্রসর হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই টিটিপি পাকিস্তানে হামলা জোড়দার করে। তারা পাকিস্তানে চায়না দূতাবাস ও কর্মীদের লক্ষ্য করে অন্তত দুটি হামলা চালায়। এ ঘটনা ইসলমাবাদ ও চীনের মধ্যেকার দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সম্পর্ককে অস্থির করে তোলে। এসব কর্মকাণ্ড প্রমাণ করে, আফগান তালেবানের বিজয়ে টিটিপিই সবেচেয়ে বেশি লাভবান হয়েছে।

তালেবানের কাবুল দখলের আগে, পাকিস্তান বারবার বলার চেষ্টা করেছে, আফগানিস্তানে টিটিপি যুক্তরাষ্ট্র ও তার মিত্রদের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ উসকে দিচ্ছে। নভেম্বরে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী আফগান তালেবান সরকার মিলে সশস্ত্র গ্রুপের সঙ্গে একটি অস্ত্র বিরতি করে' যার মেয়াদ ছিল খুবই অল্প সময়। ডিসেম্বরেই টিটিপি নিরাপত্তা বাহিনী ও বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা শুরু করে।

টিটিপির প্রতি সমর্থন অব্যাহত রেখে মধ্যস্থতাকারী হিসেবে আফগান তালেবান কোনো উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে পারবে না। পাকিস্তানে যদি সহিংস ঘটনা বাড়তে থাকে তাহলে তা কাবুল-ইসলামাবাদ সম্পর্কে বিরূপ প্রভাব ফেলবে।

মন্তব্য

Beta version