সপ্তম শতকে কনস্টান্টিনোপলকে চারপাশ দিয়ে ঘিরে ধরেও তার দখল নিতে ব্যর্থ হয়েছিল আরব সেনাবাহিনী। আরবদের হঠাতে গ্রিকদের অস্ত্রভাণ্ডারে তুরুপের তাস ছিল ‘তরল আগুন’। জল ঢেলেও যে আগুন নেভানো যেত না। বরং জলের সংস্পর্শে আসামাত্রই তা আরো জ্বলে উঠত। এভাবেই শত্রু পক্ষের হামলা থেকে দশকের পর দশক নিজেদের রক্ষা করেছেন বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্যের অধিপতিরা।
‘গ্রিক ফায়ার’ নামেই এই বিধ্বংসী অস্ত্রটি বেশি পরিচিত। তবে অনেকে একে ‘সামুদ্রিক আগুন’ বা ‘তরল আগুনে’র তকমাও দিয়েছেন। মূলত নৌযুদ্ধে ব্যবহৃত এ অস্ত্রটি যে গ্রিকদের পাশাপাশি অন্যান্য সেনাবাহিনীর হাতে ছিল, সে প্রমাণও রয়েছে। তবে অনেকের মতে, ‘গ্রিক ফায়ার’-ই যুদ্ধের ইতিহাসে অন্যতম বিধ্বংসী অস্ত্র।
৬৭২ খ্রিস্টাব্দে এই অস্ত্র দিয়েই শত্রুদের ঘায়েল করেছিলেন গ্রিকরা। নিরাপদ দূরত্ব থেকে শত্রুপক্ষের জাহাজে ‘গ্রিক ফায়ার’ ছুড়ে তা ধ্বংস করে দিতেন তারা। কীভাবে তৈরি করা হয়েছিল এই বিধ্বংসী অস্ত্র? সে রহস্যের সমাধান আজও অধরা। শত্রুপক্ষের হাতে পড়লেও এই অস্ত্রের রহস্য উদ্ধার করতে পারেনি তারা। কোন মিশ্রণে আগুন তরলে পরিণত হতো, আজ পর্যন্ত কারো সে ফর্মুলা জানা নেই। এমনকি যে মেশিনের সাহায্য তরল আগুন ছোড়া হতো, সেটিও তৈরি করতে ব্যর্থ হয়েছিল শত্রুপক্ষ। ইতিহাসবিদেরা জানিয়েছেন, গোপন ফর্মুলার সাহায্যে তৈরি করা একটি মিশ্রণ প্রথমে গরম করে তাতে অতিরিক্ত চাপ সৃষ্টি করা হতো। এর পর ‘সিফন’ নামে একটি টিউবে মিশ্রণটি ভরে ছুড়ে দেওয়া হতো শত্রুপক্ষের জাহাজের দিকে। গোটাটাই করা হতো নিরাপদ দূরত্ব থেকে। এ যেন ড্রাগনের মুখ থেকে আগুনের গোলা ছুড়ে দেওয়া।
সমুদ্রের জলে এটি ছুড়লেও তার শক্তিক্ষয় হতো না। বরং ওই ‘তরল আগুন’ জলের মধ্যে আরো দাউ দাউ করে জ্বলে উঠত। তরল আগুনের মিশ্রণটি যা কিছু স্পর্শ করত, তাতেই সেঁটে যেত। তা সে জাহাজের কাঠ বা ধাতব অংশ হোক অথবা মানবদেহ।
এটি থেকে বাঁচার কি কোনো উপায় ছিল না? তা-ও জানিয়েছেন ইতিহাসবিদেরা। তাদের দাবি, একমাত্র বালির সঙ্গে ভিনিগার এবং বেশ কয়েক দিন আগেকার প্রস্রাব মিশিয়ে তা দিয়ে এই ‘তরল আগুন’ নেভানো সম্ভব ছিল।
‘তরল আগুন’-এর উদ্ভাবক হিসেবে অনেকেই সিরিয়ার হেলিওপোলিসের বাসিন্দা কালিনিকোসের নাম করেন। কথিত রয়েছে যে, সিরিয়া ছেড়ে কনস্টান্টিনোপলে পালিয়ে গিয়েছিলেন এই ইহুদি স্থপতি। তবে তার আশঙ্কা ছিল, আরবরা তার নতুন বসতি শহরকেও দখল করে নিতে পারেন। আরবদের প্রতিহত করার জন্য এই মারণ অস্ত্র তৈরি করেন তিনি। যদিও এ তত্ত¡ নিয়ে দ্বিমত রয়েছে।
অনেকের দাবি, নানা পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর তরল আগুনের ফর্মুলা আবিষ্কার করেন কালিনিকোস। এর পর তা তৎকালীন বাইজেন্টাইন সম্রাটের কাছে তা পাঠিয়ে দেন।
কালিনিকোসের ফর্মুলা মেনে মিশ্রণের সমস্ত উপাদান দিয়ে তরল আগুন তৈরি করে ফেলেন বাইজেন্টাইন আধিকারিকেরা। এর পর মিশ্রণটি ছুড়ে শত্রæদের ঘায়েল করার পদ্ধতিও বার করে ফেলেন। একটি ইঞ্জেকশনের সিরিঞ্জের মতো টিউব বা ‘সিফন’ তৈরি করা হয়। তার ভেতরে ওই মিশ্রণ ভরে শত্রুপক্ষের জাহাজ লক্ষ্য করে ছোড়া শুরু করেন গ্রিক সেনানিরা।
অনেকের দাবি, তরল আগুনের গোলা ছোড়ার পাশাপাশি ধোঁয়া ছাড়তে ছাড়তে বিকট আওয়াজও করত ‘গ্রিক ফায়ার’। সে সময় অনেকটা ড্রাগনের মতো মনে হতো এ অস্ত্রকে। প্রবল বিধ্বংসী হওয়ায় এই অস্ত্রের ফর্মুলা গোপন রেখেছিলেন গ্রিকরা। অনেকের দাবি, কেবলমাত্র কালিনিকোসের পরিবারের সদস্য এবং বাইজেন্টাইন সম্রাটদের উত্তর পুরুষেরা তা জানতেন।
কোন ফর্মুলা বা প্রযুক্তিতে গ্রিক ফায়ার তৈরি হয়েছিল? এক সময় শত্রুপক্ষের দখলে এলেও তা উদ্ধার করতে পারেনি তারা। ফলে চিরতরে হারিয়ে যায় এই অস্ত্রটি।
এই অস্ত্র যে কতটা বিধ্বংসী, তা টের পেয়েছিলেন আরবরা। ৬৭৮ খ্রিস্টাব্দে কনস্টান্টিনোপল দখলের চেষ্টা করেছিলেন তারা। তবে গ্রিক ফায়ারের আঁচে ঝলসে গিয়েছিলেন আরব নৌসেনারা। ৭১৭-৭১৮ খ্রিস্টাব্দেও একইভাবে ধ্বংস হয়েছিল তাদের বাহিনী।
বিদেশিদের পাশাপাশি ঘরের শত্রুদের বিরুদ্ধেও এ অস্ত্রকে কাজে লাগিয়েছিলেন বাইজেন্টাইন সম্রাটেরা। ইতিহাসবিদের একাংশের দাবি, বাইজেন্টাইন সাম্রাজ্য ছাড়াও পশ্চিমা সভ্যতায় বিদেশি হানাদারদের বহু শতক ঠেকিয়ে রেখেছিল ‘গ্রিক ফায়ার’! সূত্র : আনন্দবাজার।
মন্তব্য