ইউক্রেন উত্তেজনা

কূটনৈতিক পথে শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব

মোমেনা আক্তার পপি
কূটনৈতিক পথে শান্তিপূর্ণ সমাধান সম্ভব

ইউক্রেন ইস্যুতে বড় ধরনের যুদ্ধের আশঙ্কা এখন আর নতুন কিছু নয়। যদি তাই হয়, তাহলে বিশ্বকে ভয়ংকর পরিণতি ভোগ করতে হবে। রাশিয়া যদি সত্যিই ইউক্রেন আক্রমণ করে, তাহলে বিপুলসংখ্যক মানুষের প্রাণহানি হবে। অনেকেই প্রাণ বাঁচাতে অন্যত্র পালিয়ে যাবেন। বাস্তুচ্যুত হবেন হাজার হাজার মানুষ। যুদ্ধের অর্থনৈতিক ক্ষতি হবে আকাশছোঁয়া এবং মানবিক ক্ষতি হবে অপূরণীয়।

একদিকে ইউক্রেন সীমান্তে সৈন্য সংখ্যা বাড়িয়ে চলছে রাশিয়া; অন্যদিকে পশ্চিমারা মস্কোকে অব্যাহত হুমকি দিয়ে যাচ্ছে’ সীমান্ত অতিক্রম করলেই ভয়ংবর পরিণতি ভোগ করতে হবে। উভয়পক্ষই নিজ নিজ অবস্থানে অনড়। যুদ্ধ কখনো ভালো কিছু বয়ে আনে না। যুদ্ধ মানেই ধ্বংস। তাই এ সমস্যার শান্তিপূর্ণ ও স্থায়ী সমাধান জরুরি, যা শুধু কূটনৈতিক উপায়ে সম্ভব। উভয়পক্ষকে যুদ্ধের পথ থেকে সরাতে ক‚টনীতিকদের ঠান্ডামাথায় আলোচনা করতে হবে। যদিও উভয়পক্ষকে সন্তুষ্ট করার মতো পথ খুঁজে বের করা খুব কঠিন। কিছু পেতে হলে কিছু দিতে হয়। সমঝোতা এমনি এমনি হয় না। কাউকে কাউকে অনেক বেশি মূল্য দিতে হয়। তা সত্তে¡ও সামরিক বাহিনীকে না জড়িয়ে আলোচনার মাধ্যমে রক্তক্ষয় এড়ানো এখনো সম্ভব।

পুতিনকে বুঝিয়ে পিছু হটানো : বর্তমান পরিস্থিতিতে পশ্চিমাদের উচিত ভয় বা হুমকির পরিবর্তে রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনকে বুঝিয়ে আক্রমণাত্মক কর্মকাণ্ড থেকে পিছু হটানো। এতে উভয়পক্ষই লাভবান হবে। ইউক্রেনে আক্রমণ চালিয়ে হয়তো পুতিন জয়ী হবেন। কিন্তু সংঘাত বাধলে যে পরিমাণ মানুষ হতাহত হবে এবং অর্থনৈতিক নিষেধাজ্ঞা এবং কূটনৈতিক সংকটে পড়বে, তা যুদ্ধ জয়ের আনন্দকে ম্লান করে দেবে। এসব ধাক্কা কাটিয়ে ওঠা পুতিনের জন্য সহজ হবে না। পশ্চিমা বিশ্ব ইউক্রেনকে সামরিক সহায়তা দিতে পারে’ এটা তাকে বুঝতে হবে। যদি তাই হয়, তাহলে এ যুদ্ধ গড়াবে অনেক বছর; যার মূল্য দিতে হবে সবাইকে। পুতিন হয়তো মনে করছেন, অভ্যন্তরীণ সহায়তা তাকে এসব ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে সহায়তা করবে। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না, নিজ দেশেই তার নেতৃত্ব হুমকিতে রয়েছে। এসব বিবেচনায় বলা যায়, পশ্চিমাদের উচিত পুতিনকে কূটনৈতিক বিজয় লাভের সুযোগ দেওয়া। পুতিন যাতে নিজেকে একজন শান্তিপূর্ণ নেতা প্রমাণের সুযোগ পায় এবং বলতে পারে তিনি ন্যাটোর উসকানিতেও সামরিক পথে সমস্যা সমাধানে অনিচ্ছুক। পুতিন দাবি করতেই পারেন’ তিনি পশ্চিমাদের দৃষ্টি আকর্ষণ করতে সক্ষম হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে নিরাপত্তা নিয়ে নেতাদের উদ্বেগ হওয়াটাও স্বাভাবিক। কারণ রাশিয়া বিশ্ব নেতাদের স্মরণ করিয়ে দিয়েছে, তারা বরাবরই একটি বৃহৎ শক্তিশালী দেশ ছিল। বেলারুশে রাশিয়ার উপস্থিতি সেটাকে আরো দৃঢ় করেছে। একটা কথা মানতেই হবে’ পুতিনের কার্যক্রম পশ্চিমা বিশ্বকে ঐক্যবদ্ধ করছে। ন্যাটো বাহিনী রুশ সীমান্তের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। সুইডেন এবং ফিনল্যান্ডকে ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার বিষয়ে বিবেচনা করতে বলেছে। পুতিন যদি ন্যাটোকে উপেক্ষা করেন এবং ইউক্রেনকে নিয়ন্ত্রণের রাখার ইচ্ছা পোষণ করেন, তাহলে সমস্যায় পড়বে। তাই এখুনি তার সে ইচ্ছা পরিত্যাগ করা উচিত।

ন্যাটো-রাশিয়া নতুন নিরাপত্তা চুক্তি : পশ্চিমা বিশ্ব ইতোমধ্যে স্পষ্ট করেছে’ তারা মূল নীতি, অর্থাৎ ইউক্রেনের সার্বভৌমত্ব ও আঞ্চলিক অখণ্ডতার ক্ষেত্রে কোনো ধরনের আপস করবে না। ন্যাটোর সদস্য হওয়ার ইচ্ছা প্রকাশের অধিকার তাদের রয়েছে। ন্যাটোও তার দরজা সবার জন্য উন্মুক্ত করে রেখেছে। যেকোনো দেশ স্বেচ্ছায় এতে যোগদান করতে পারে। ইউরোপীয় নিরাপত্তার বিষয়টিকে তারা বড় করে দেখাছে। এ ইস্যুকে যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটো’ উভয়ে নিজেদের স্বার্থসংশ্লিষ্ট বলেই ভাবছে। এমন পরিস্থিতিতে উভয় পক্ষ অস্ত্রের ঝনঝনানি বন্ধের লক্ষ্যে অস্ত্রনিয়ন্ত্রণ চুক্তিকে পুনরুজ্জীবিত করতে পারে, যা রুশ ও ন্যাটোবাহিনীর মধ্যে আস্থা বৃদ্ধিতে সহায়ক হবে। ফলে ক্ষেপণাস্ত্রের অবস্থান ও সামরিক মহড়ায় স্বচ্ছতা আসবে এবং স্যাটেলাইটবিরোধী অস্ত্র পরীক্ষা আরো সহজ হবে। রাশিয়া ইতোমধ্যে বলেছে, এগুলো মূল সমস্যা সমধানে যথেষ্ট নয়। ন্যাটোয় ইউক্রেনের যোগদানের ঘটনা রাশিয়ার নিরাপত্তার জন্য হুমকি। কিন্তু যদি বলা হয়, ক্ষেপণাস্ত্র মোতায়েন উল্লেখযোগ্য হারে কমছে, তাহলে হয়তো রাশিয়ার কিছু মানুষের মধ্যে নিরাপত্তা নিয়ে যে উদ্বেগ সৃষ্টি হয়েছে, তা হ্রাস পাবে। এসব দিক থেকে ইতোমধ্যে পুতিনকে সফল বলা যায়। রাশিয়ার শর্তে ইউরোপ নতুন করে নিরপত্তা আলোচনায় যুক্ত হয়েছে।

মিনস্ক চুক্তি পুনরায় জীবিত করা : বেলারুশের রাজধানী মিনস্কে ২০১৪ ও ১৫ সালে আলোচনার পর এ চুক্তি হয়। মিনস্ক নামে পরিচিত এ চুক্তির মধ্য দিয়ে সেসময় ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে সরকারি বাহিনী ও রুশ-সমর্থিত বাহিনীর মধ্যকার যুদ্ধের সমাপ্তি হয়। তবে এক অর্থে এখনো সেখানে যুদ্ধ চলছে। এ চুক্তির উল্লেখযোগ্য দিক হলো’ আলোচনার মধ্য দিয়ে সংবিধান সমুন্নত রেখে যুদ্ধবিরতি ও রাজনৈতিক সমাধানের একটি পথ বের করে আনা সম্ভব হয়। পশ্চিমা রাজনীতিবিদরা মিনস্ক চুক্তি পুনরুজ্জীবিত করার পরামর্শ দিয়ে বলেছে, এর দ্বারা সংকটের সমাধান সম্ভব। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাক্রোঁ বলেছেন, আমাদের সামনে এটাই একমাত্র পথ, যা শান্তি আনতে পারে। ব্রিটিশ প্রতিরক্ষামন্ত্রী বেন ওয়ালেস বিবিসিকে বলেন, উত্তেজনা নিরসনে মিনস্ক চুক্তির পুনরুদ্ধার হতে পারে বড় ধরনের হাতিয়ার। সমস্যা হলো চুক্তির ধারাগুলো বেশ জটিল এবং বিতর্কিত। ক্রেমলিন দাবি করেছে, রুশপন্থিদের ক্ষমতায় আসার সুযোগ হিসেবে ইউক্রেনে অবশ্যই স্থানীয় নির্বাচনের আয়োজন করতে হবে। অন্যদিকে কিয়েভ দাবি করেছে, মস্কোকে প্রথমে অস্ত্র ও সৈন্য সরাতে হবে। সবচেয়ে বিতর্কিত বিষয়টি হলো ডনবাসের স্বায়ত্তশাসন। রাশিয়ার দাবি মেনে চুক্তিতে ডনবাসের স্বায়ত্তশাসন দেওয়ার কথা উল্লেখ থাকলেও আজও তা বাস্তবায়িত হয়নি। মস্কো বলছে, ইউক্রেনের পররাষ্ট্রনীতিতে দনতাস্ক ও লুহানস্কের মতামত থাকা উচিত। এছাড়া এ দুই অঞ্চলের উচিত ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্যপদের বিরোধিতা করা। এখানেই কিয়েভের বড় ভয়।

ফিনল্যান্ডের পথে হাঁটতে পারে ইউক্রেন : রাশিয়া ও পশ্চিমাদের মধ্যকার এ উত্তেজনায় ফিনল্যান্ডের পন্থা অবলম্বন করে চুপ থাকতে পারে ইউক্রেন। এটাকে এক ধরনের নিরপেক্ষতা বজায় রাখা বলে। ফ্রান্স আনুষ্ঠানিকভাবে ইউক্রেনকে ফিনল্যান্ডের পথ অনুসরণ করতে বলেছে’ এমন একটা খবর সম্প্রতি বের হয়েছিল। যদিও পরে ফ্রান্স তা অস্বীকার করে। স্নায়ুযুদ্ধের সময় ফিনল্যান্ড নীরবতা বজায় রাখা অর্থাৎ আনুষ্ঠানিকভাবে নিরপেক্ষ থাকার কথা বলেছিল। ফিনল্যান্ড স্বাধীন, সার্বভৌম এবং গণতান্ত্রিক একটি দেশ। দেশটি তখনো ন্যাটোর বাইরে ছিল এবং আজো আছে’ এটা মনে রাখতে হবে। তবে কি কিয়েভ এ পন্থায় আকৃষ্ট হয়েছে। তারা সামরিক পথ পরিহার করতে চায়। হতে পারে পুতিনের ইচ্ছাকে প্রাধান্য দিয়ে ইউক্রেন কখনো ন্যাটোর সদস্য হবে না। ন্যাটোয় যোগ দেওয়ার চেয়ে ইউক্রেনের নিজের সার্বভৌমত্ব বজায় রাখার দিকে বেশি নজর দেওয়াটা জরুরি। কিন্তু প্রশ্ন হচ্ছে’ ইউক্রেন কি সে পথে হাঁটবে; সম্ভাবনা খুবই কম। কারণ নিরপেক্ষ থাকার অর্থ হলো ইউক্রেনে রাশিয়ার সফল বিস্তারের জন্য দ্বার উন্মুক্ত করে দেওয়া। নিরপেক্ষতা অবলম্বন করা সত্যিকার অর্থে বেশ কঠিন। কারণ রাশিয়া শর্তাবলি মানবে কিনা, তা-ও প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। নিরপেক্ষতার জন্য কিয়েভকে বড় ধরনের মূল্য দিতে হতে পারে। ইউরো-আটলান্টিকে যোগ দেওয়ার আকাক্সক্ষা কিয়েভকে হয়তো পরিত্যাগ করতে হবে। এটা ইউরোপীয় ইউনিয়নের সদস্যপদ পাওয়াকে আরো দূরে ঠেলে দিতে পারে।

দীর্ঘায়িত হতে পারে বর্তমান স্থিতাবস্থা : সংকট নিরসনে চলমান আলোচনা উদ্ভ‚ত পরিস্থিতিকে আরো দীর্ঘায়িত করতে পারে। আবার এমনও হতে পারে’ সময়ের সঙ্গে সঙ্গে উত্তেজনার তীব্রতা হ্রাসও পেতে পারে। পূর্ব ঘোষণা অনুযায়ী, মহড়া শেষে রাশিয়া ধীরে ধীরে তাদের সেনাসদস্যদের ফিরিয়ে নিতে পারে। রাশিয়া বিপুলসংখ্যক সামরিক সরঞ্জাম সীমান্তে ফেলে গেছে’ এমনটাও হতে পারে। ডনবাসের বিদ্রোহীদের সাহায্য দেওয়া অব্যাহত রাখতে পারে। এতে ইউক্রেনের রাজনীতি ও অর্থনীতিতে সবসময় অস্থিতিশীলতা বিরাজ করবে। এটাকে ক্রমাগত রুশ হুমকি বলা যেতে পারে। অন্যদিকে পশ্চিমারা পূর্ব ইউরোপে ন্যাটোর শক্তিশালী উপস্থিতি বজায় রাখবে। পশ্চিমা রাজনীতিক ও ক‚টনীতিকরা রাশিয়ার সঙ্গে এখনকার মতো বিক্ষিপ্তভাবে আলোচনা চালিয়ে যাবে। যদিও আলোচনার মাধ্যমে উল্লেখযোগ্য তেমন কোনো অগ্রগতি এখনো হয়নি। শেষ পর্যন্ত পুরোদমে যুদ্ধে না জড়ালেও ইউক্রেনকে এক ধরনের লড়ায়ের মধ্য দিয়ে যেতে হবে। ধীরে ধীরে এ দ্বন্দ্ব আর খবরের প্রধান শিরোনাম হবে না। এটাও একসময় দীর্ঘ হিমায়িত দ্বন্দ্বে পরিণত হবে এবং জনগণের কাছে এর গুরুত্ব হারাবে। এ বিকল্পগুলোর বাস্তবায়ন খুব সহজ বা সম্ভাব্য নয়। কারণ এসবের সঙ্গে জড়িয়ে আছে আপসের বিষয়টি। কিয়েভের ভয়ের জায়গাটা হলো, ইউক্রেনকেই হয়তো সবচেয়ে বেশি আপস করতে হবে। সব হিসাব-নিকাশ বিবেচনায় এখনো মনে হচ্ছে উত্তেজনা সংঘাতের দিকেই যাচ্ছে। যদি তাই হয়, তাহলে এটা আমরা কীভাবে এড়াতে পারি। আশার কথা হলো, সব পক্ষই এখনো আলোচনার মাধ্যমে সমস্যা সমাধানে ইচ্ছুক’ হোক সেটা নিস্ফল। অযৌক্তিক বা অগ্রহণযোগ্য যেমনই হোক আলোচনা যত বেশি দীর্ঘায়িত হবে সমস্যা সমধানের কূটনৈতিক দ্বার তত বেশি উন্মোচিত হবে। সূত্র : বিবিসি।

মন্তব্য