ইউক্রেন ইস্যুতে গত কয়েক মাস ধরে সারা বিশ্বে যুদ্ধ যুদ্ধ খেলা বিরাজ করছে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, যেকোনো সময় যুদ্ধ শুরু হয়ে যাবে। কিন্তু আদৌ কি কোনো পক্ষ যুদ্ধে জড়াবে। নাকি ইউক্রেনকে ইস্যু বানিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্ব প্রত্যেকেই নিজস্ব ফায়দা লুটতে চায় সেটাই এখন দেখার বিষয়। গত বছরের শেষের দিক থেকে ইউক্রেন সীমান্তে লাখেরও বেশি রুশ সৈন্য অবস্থান করছে। পুতিনের এই বিপুলসংখ্যক সৈন্য সমাবেশের অর্থ হতে পারে ভাওতাবাজি বা নিজ দেশের জনগণের উদ্দেশ্যে রাজনৈতিক খেলা। যেটাই হোক- এটাকে খুঁচিয়ে ঘাঁ করছে যুক্তরাষ্ট্র। এর সঙ্গে যোগ দিয়েছে ব্রিটেনও।
রাশিয়ার মুখপাত্ররা প্রতিনিয়ত বলে যাচ্ছে ইউক্রেনে আক্রমণের কোনো ইচ্ছা তাদের নেই। ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমানুয়েল ম্যাখোঁর সঙ্গে বৈঠকে এবং যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে ফোনালাপেও একই বুলি আওরাচ্ছে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। তা সত্ত্বেও ইউক্রেন ইস্যুটা ক্রমশ ঘোলাটে হয়ে উঠছে।
বিশ্লেষকরা পুতিনের আচরণের মধ্যে দুটি সমস্যা খুঁজে পেয়েছেন। কেউ কেউ পুতিনের মধ্যে ইংরেজ কবি স্যামুয়েল জনসনের (তিনি ছিলেন একাধারে কবি, নাট্যকার, প্রাবন্ধিক, নীতিবিদ, সমালোচক, জীবনীকার, সম্পাদক এবং অভিধান রচয়িতা) ছায়া দেখতে পান। কিছু কিছু পশ্চিমা নেতা পুতিনের বক্তব্যকে অপ্রলাপ বলেও মনে করেন। তা ছাড়া আক্রমণ না করার দাবির পক্ষে পুতিন গ্রহণযোগ্য কোনো যুক্তি এখনো দেখাতে পারেননি। তার উদ্দেশ্য যদি শান্তিপূর্ণ হয় তাহলে রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনীর অর্ধেকেরও বেশি অর্থাৎ এক লাখ ৩০ হাজার সৈন্য কেন ইউক্রেন সীমান্তে জড়ো হয়েছে। তবে কি এসবই ভাওতাবাজি। ইউক্রেন নিয়ে কি বড় ধরনের বাজি চলছে। কিন্তু বিষয়টা হচ্ছে
এখানে বাজিটা ধরেছে কে?
ইউক্রেন ইস্যুতে অনেকগুলো হিসাব কাজ করছে। পুতিন সবসময় বলে এসেছেন তিনি পূর্ব ইউরোপে একটি রাশিয়ান বলয় তৈরি করতে চান। পূর্ব ইউরোপীয় দেশ এস্তোনিয়া, লাটভিয়া, লিথুনিয়া, বেলারুশ, জর্জিয়া এবং ইউক্রেন একসময় সোভিয়েত ইউনিয়নের অংশ ছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর তাকে প্রায়ই দেখা গেছে রাশিয়ার ক্ষতি নিয়ে আক্ষেপ করতে। পশ্চিমা দেশ এবং রুশ জনগণকে পুতিন হয়তো এটা দেখাতে চাইছেন, রাশিয়া এখনো পরাশক্তি। যদিও বর্তমান পরিস্থিতিতে (পারমাণবিক অস্ত্রের মজুত ও ভৌগোলিক আয়তনে) রাশিয়াকে একটি ব্যর্থ মাঝারি মানের শক্তিধর দেশের বেশি কিছু মনে করে না অনেকে।
ইউক্রেনের কৌশলগত গুরুত্ব নিয়েই ভয় পুতিনের। তার আশঙ্কা পশ্চিমা দেশগুলোর সঙ্গে মিলে রাশিয়ার দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলীয় অংশে প্রভাব বিস্তার করতে চায় ইউক্রেন। দেশটি দ্রুত ন্যাটোর দিকে ঝুঁকে পড়াতেও আপত্তি পুতিনের। ইউরোপীয় ইউনিয়নের সঙ্গে কিয়েভের সম্পর্কোন্নয়নের চেষ্টারও বিরোধী পুতিন। এখানে উল্লেখ্য, ইউক্রেন একটি গণতান্ত্রিক দেশ। তাদের স্বাধীন গণমাধ্যম ও বাকস্বাধীনতা রয়েছে। তারা স্বাধীনভাবে নেতা নির্বাচন করতে পারে। এসব হয়তো পুতিনকে স্বস্তি দিচ্ছে না। কারণ, সত্যিকার অর্থে বলতে গেল, রাশিয়ার জনগণের কোনো স্বাধীনতা নেই বললেই চলে।
রুশ জনগণ যদি ইউক্রেনের পথ অনুসরণ করে তাহলে পুতিন বেশি দিন ক্ষমতায় থাকতে পারবে না। আরো ব্যাপক অর্থে বলা যায়, সাবেক সোভিয়েত ইউনিয়নের স্মৃতি এখনো পুতিনকে বেদনাতুর করে তোলো। ইউক্রেনকে তিনি এখনো ঐতিহাসিক রাশিয়ার অবিচ্ছেদ্য অংশ মনে করেন। স্নায়ুযুদ্ধে পরাজয়ের ক্ষতির প্রতীক হিসাবেই ইউক্রেনকে বিবেচনা করেন।
পশ্চিমাদের দুর্বলতা কোথায় পুতিন তা খুব ভালোভাইে জানে। গত বছর আফগানিস্তানে ন্যাটো বাহিনী ব্যাপক অপদস্থ হয়। এ ছাড়া যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত বছর আফগানিস্তানে তাদের ২০ বছরের যুদ্ধের সমাপ্তি ঘোষণা করে। এরপর থেকে নতুন করে কোনো সংঘাতে জড়ায়নি দেশটি। তবে যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রনীতি ও সামরিক দৃষ্টি যে পুনরায় চীনের দিকে দিচ্ছে, ইউরোপে নয়- তা বেশ ভালোই জানা পুতিনের। তাই সুযোগটা কাজে লাগানোর জন্য মাঠে নেমে পড়ে রুশ নেতা।
২০১৪ সালে ইউক্রেনে আক্রমণের ফলে পশ্চিমা নিষেধাজ্ঞার কবলে পড়ে রাশিয়া। এতে ব্যাপক দুর্ভোগ পোহাতে হয় রুশ জনগণকে। নিজ দেশে পুতিনের অবস্থা নরবড়ে হয়ে পড়ে। তার সেসময়কার সিদ্ধান্ত যে ঠিক ছিল তা প্রমাণ করটাও পুতিনের জন্য জরুরি। পশ্চিমাবিরোধী নীতিকে কাজে লাগিয়ে নিজ দেশে জনসমর্থন বাড়াতে পুতিন আবারো ইউক্রেনকেই বেছে নিয়েছে। ২০১৪ সালে ক্রিমিয়া দখল করে পুতিন বাহিনী এবং পূর্বাঞ্চলীয় ডনবাস এলাকার নিয়ন্ত্রণও কার্যত তাদের হাতে।
অচলাবস্থার নিরসন যদি হয়ও, পুতিন নিশ্চয়ই ইউক্রেন ছাড়াও জর্জিয়া এবং মলদোভাকে ন্যাটোর অন্তর্ভুক্ত করা হবে না- এমন নিশ্চয়তা চাইবে। এ ছাড়াও বিলুপ্ত ওয়ারশা চুক্তির সদস্য দেশ যেমন- পোল্যান্ড, রোমানিয়া, বুলগেরিয়ার মতো দেশগুলো জোট ছেড়ে আবারো পূর্বের অবস্থায় ফিরে যাওয়াটাও তার চাহিদা হতে পারে। মিনস্ক চুক্তি মেনে ক্রিমিয়ার দাবি পরিত্যাগ করে ডনবাস অঞ্চলের স্বায়ত্তশসন মেনে নিতে কিয়েভের ওপর চাপ দিতে পারে। ইউরোপের পূর্ব ও দক্ষিণাঞ্চলে যুক্তরাষ্ট্রের মাঝারি পাল্লার ক্ষেপণাস্ত্র স্থাপনা সীমিত বা বন্ধের দাবিও করতে পারনে।
তার মধ্যে সবসময় রাশিয়ার প্রভাব পুনপ্রতিষ্ঠার উচ্চাভিলাসী মনোভাব কাজ করে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ভূ-রাজনৈতিক অবস্থানকে প্রসারিত করতে ইউরোপীয় নিরাপত্তা ব্যবস্থাকে নিজের মতো করে ঢেলে সাজাতে ইচ্ছুক পুতিন। তবে তার বেশির ভাগ চাওয়াকেই যুক্তরাষ্ট্র না বলবে- আর এ কারণেই বর্তমান সংকট।
মোমেনা আক্তার পপি; দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে
মন্তব্য