-->
শিরোনাম

ব্র্যান্ডের লবণেও প্লাস্টিকের কণা

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
ব্র্যান্ডের লবণেও প্লাস্টিকের কণা

বাংলাদেশে বিজ্ঞানীদের এক গবেষণায় সামুদ্রিক লবণে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে প্লাস্টিকের ক্ষুদ্র কণা বা মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি পাওয়া গেছে, যা বিশ্বের অন্য দেশগুলোর তুলনায় উদ্বেগজনক। বাজারের সুপরিচিত ব্র্যান্ড ও খোলাবাজার থেকে সংগৃহীত এসব নমুনায় দেখা গেছে, প্রতি ১ কেজি লবণে রয়েছে আড়াই হাজারের বেশি প্লাস্টিকের কণা। এ হিসাবে দেশের একজন মানুষ প্রতি বছর গড়ে প্রায় ১৩ হাজার মাইক্রোপ্লাস্টিক গ্রহণ করে থাকে।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের একদল পরিবেশবিজ্ঞানী ২০২১ সালের সেপ্টেম্বর ও অক্টোবর মাসে এ গবেষণা চালিয়েছেন। গবেষণার ফল বিজ্ঞান বিষয়ক আন্তর্জাতিক সাময়িকী ‘এনভায়রনমেন্টাল অ্যাডভান্সেস’-এ প্রকাশিত হয়েছে। বাংলাদেশে এটিই এ ধরনের প্রথম গবেষণা। বিজ্ঞানীদের দলটি এর আগে দেশি মাছের ওপর গবেষণা চালিয়ে সেগুলোর পেটের ভেতরেও প্লাস্টিকের উপস্থিতি দেখতে পেয়েছেন।

বাজারে যেসব লবণ পাওয়া যায়, তার বেশিরভাগই আসে বঙ্গোপসাগরের উপকূলীয় জমি থেকে। বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেসব এলাকায় বড় ধরনের প্লাস্টিকের দূষণের কারণে মাইক্রোপ্লাস্টিক এখন লবণের সঙ্গেও মিশে গেছে।

এ গবেষণা দলের একজন সদস্য এবং পরিবেশ বিজ্ঞান বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ফাহমিদা পারভীন বলেন, সমুদ্রসৈকতে যত্রতত্র প্লাস্টিক বর্জ্য ফেলা হচ্ছে এবং নানা কারণে সেসব ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে চলে যাচ্ছে পানিতে। সামুদ্রিক লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের মূলত সেটাই প্রধান উৎস।

গবেষণার জন্য বিভিন্ন সুপারমার্কেট ও দোকান থেকে এসব লবণ সংগ্রহ করা হয়। এর মধ্যে রয়েছে দেশের নামিদামি ১০টি ব্র্যান্ডের লবণ। এছাড়া খোলাবাজার থেকে আরো তিনটি নমুনা সংগ্রহ করা হয়। সামুদ্রিক লবণের মোট ১৩টি নমুনার ওপর এ গবেষণা পরিচালিত হয়। পরে পরীক্ষাগারে গবেষণা চালিয়ে দেখা যায়, সংগৃহীত এসব লবণের প্রতি কেজিতে গড়ে ২ হাজার ৬৭৬টি আণুবীক্ষণিক প্লাস্টিক রয়েছে।

ফাহমিদা পারভীন বলেন, তবে লবণভেদে এ হিসাবে তারতম্য রয়েছে। কিছু কিছু লবণে ১ কেজিতে এর সংখ্যা ছিল সর্বনিম্ন ৩৯০ আবার কিছু কিছু লবণে সর্বোচ্চ ৭ হাজার ৪০০ মাইক্রোপ্লাস্টিকও পাওয়া গেছে। দেখা গেছে, বিভিন্ন কোম্পানির প্যাকেট লবণের চেয়ে খোলাবাজারের লবণে এর উপস্থিতি বেশি।

তিনি বলেন, বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ হচ্ছে একজন মানুষ প্রতিদিন ৫ গ্রাম লবণ গ্রহণ করবে। কিন্তু বাংলাদেশে এক সমীক্ষায় দেখা গেছে, একজন মানুষ প্রতিদিন খালি লবণ হিসেবে কিংবা তরকারির সঙ্গে গড়ে ১৩.৪ গ্রাম লবণ খেয়ে থাকেন।

তিনি বলেন, এ হিসাবে দেখা যায়, বাংলাদেশে একজন মানুষ বছরে যতো লবণ গ্রহণ করে থাকে, তাতে তার পেটের ভেতরে প্রতি বছর ১৩ হাজার ৮৮টি মাইক্রোপ্লাস্টিক চলে যাচ্ছে। রান্নার সময় ব্যবহৃত লবণ প্রচÐ তাপে গলে যায় কিনা অথবা শেষ পর্যন্ত তার আকৃতি কী হয়, সেটা নিশ্চিত করে বলা সম্ভব নয়। তবে বিজ্ঞানীরা বলছেন, সেসব যদি গলেও যায়, উদ্বায়ী না হওয়ার কারণে এসব প্লাস্টিক পাত্রের ভেতরে খাবারের সঙ্গেই মিশে থাকে। তিনি বলেন, এটা তো আর উড়ে যায় না। ফলে সেটা কঠিন কিংবা গলিত' যে অবস্থাতেই থাকুক না কেন, আপনি কিন্তু সেটা খেয়ে ফেলছেন।

বিজ্ঞানীরা বলছেন, সাধারণত প্লাস্টিকের কোনো কণা ৫ মিলিমিটারের ছোট হলে তাকে মাইক্রোপ্লাস্টিক হিসেবে ধরা হয়। কিন্তু এ গবেষণায় যেসব কণা পাওয়া গেছে, সেগুলোর কিছু কিছু আকারে খুবই ছোট। এসব মাইক্রোপ্লাস্টিকের আকার ছিল শূন্য দশমিক ১ থেকে শূন্য দশমিক ৫ মিলিমিটার পর্যন্ত। প্লাস্টিকের এসব কণা খালি চোখে দেখা যায় না। তবে মাইক্রোস্কোপের নিচে এসবের আকৃতি স্পষ্ট বোঝা যায়।

লবণে যেসব প্লাস্টিক পাওয়া গেছে, তার মধ্যে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের পলিমার প্লাস্টিক যেমন পলিস্টাইরিন, ইথিলিন ভিনাইল এসিটেট, উচ্চ ঘনত্বের পলিইথিলিন, নাইলন এবং পলিথিলিন টেরেপথ্যালেট। বিশ্বের মতো বাংলাদেশেও প্লাস্টিকের দূষণ বেড়েছে। এ দূষণে বেড়েছে সমুদ্রেও। মানুষ যেখানেই প্লাস্টিক ব্যবহার করুক না কেন, শেষ পর্যন্ত এসব প্লাস্টিক সাগরে গিয়ে পৌঁছায়। বিজ্ঞানীরা বলছেন, দক্ষিণাঞ্চলীয় কক্সবাজারের প্রচুর জমিতে লবণ উৎপাদিত হয়। ওই এলাকাটি প্রধানতম পর্যটন এলাকা। এ কারণে সেখানে প্লাস্টিকের বিভিন্ন প্যাকেজিং, বোতল, ওষুধ, কাপড় ইত্যাদির বর্জ্য তৈরি হচ্ছে।

গবেষক ফাহমিদা পারভীন বলেন, ‘আমাদের ধারণা সেসব থেকে মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়ে সমুদ্রের পাণিতে মিশে যায় এবং এই পানি থেকে যখন লবণ তৈরি করা হয়, তখন সেসব প্লাস্টিক লবণের মধ্যে রয়ে যাচ্ছে।’ এছাড়া মাছ ধরার জন্য নাইলনের যেসব জাল ব্যবহার করা হয়, সেগুলো থেকেও ভেঙে ভেঙে প্রচুর মাইক্রোপ্লাস্টিক তৈরি হয়ে সাগেরর পানিতে ছড়িয়ে পড়ছে। সাধারণত প্লাস্টিক বর্জ্য পানির স্রোত ও প্রক্রিয়ার মধ্যে অনেক দিন ধরে ভাঙতে থাকে। এছাড়া তাপমাত্রা, অণুজীব, সূর্যের অতিবেগুনি রশ্মি ও অন্যান্য কারণে প্লাস্টিক ভেঙে মাইক্রোপ্লাস্টিকে পরিণত হয়।

প্লাস্টিকের এসব কণা মানবদেহে ক্যান্সারের অন্যতম কারণ। এর ফলে যকৃৎ, ফুসফুসসহ অন্যান্য অঙ্গে সমস্যা হতে পারে। মাইক্রোপ্লাস্টিক মানবদেহে হরমোনের ভারসাম্য নষ্ট করার কারণে নারী ও পুরুষের প্রজননক্ষমতাও নষ্ট হয়ে যেতে পারে। এছাড়া প্লাস্টিকের এসব ক্ষুদ্র কণা পাকস্থলীর ভেতরে গেলে সেটা বন্ধ হয়ে যেতে পারে। কিন্তু বিজ্ঞানীদের সবচেয়ে বেশি উদ্বেগের কারণ হচ্ছে এসব প্লাস্টিকে যেসব রাসায়নিক মেশানো হয়, মানবদেহে সেগুলোর প্রতিক্রিয়ার ব্যাপারে।

ফাহমিদা পারভীন বলেন, তারা দেখেছেন বিশ্বের ১৭টি দেশের সামুদ্রিক লবণে মাইক্রোপ্লাস্টিকের উপস্থিতি নিয়ে গবেষণা করা হয়েছে। এসব দেশের তথ্য-উপাত্ত তুলনা করে তারা দেখেছেন, বাংলাদেশের লবণে এ প্লাস্টিক-দূষণের হার অনেক বেশি। দূষণের এ তালিকার শীর্ষস্থানে রয়েছে ক্রোয়েশিয়া, দ্বিতীয় স্থানে ইন্দোনেশিয়া এবং তারপরই বাংলাদেশ।

মন্তব্য

Beta version