ইউক্রেন নিয়ে গত কয়েক মাস ধরে চলা উত্তেজনা কূটনৈতিক পথে নিরসনে ইতোমধ্যে আগ্রহ প্রকাশ করেছে রাশিয়া, যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ পশ্চিমা বিশ্ব। ইউক্রেনও বারবার কূটনৈতিক পন্থায় এই সমস্যার সমাধানের কথা বলে গেছে।
সর্বশেষ রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন বলেছেন, ইউক্রেন আক্রমণের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চায় না রাশিয়া। ইউক্রেন ইস্যুতে আলোচনার জন্য রাশিয়া সফরে যান জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজ। স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার তিনি প্রায় চার ঘণ্টা বৈঠক করেন পুতিনের সঙ্গে। বৈঠক শেষে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে কিছু সেনা প্রত্যাহারে ঘোষণা দেন পুতিন। কিন্তু তাতেও সন্তুষ্ট নয় পশ্চিমারা। তাদের মতে, উত্তেজনা হ্রাসের মতো কিছু এখনো তারা দেখছে না। রাজনৈতিক বিশ্লেষকদের মতে, ইউক্রেন উত্তেজনা হয়তো যুদ্ধ পর্যন্ত গড়াবে না। তবে এ নিয়ে রাশিয়া ও পশ্চিমা বিশ্বের মধ্যে ইঁদুর-বিড়াল খেলা চলবে দীর্ঘদিন, এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই।
সৈন্য প্রত্যাহারের ঘোষণার পরও যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন বলেন, ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলা চালানোর শঙ্কা এখনো রয়েছে। এ নিয়ে আমরা সতর্ক অবস্থানে রয়েছি। মস্কোর সৈন্য ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়টি খতিয়ে দেখা হচ্ছে। মঙ্গলবার টেলিভিশনে দেওয়া এক বক্তব্যে বাইডেন আরো বলেন, ক‚টনৈতিক তৎপরতায় ইউক্রেন সমস্যার ভালো সমাধান হতে পারে। রাশিয়ার নাগরিকরা আমাদের শত্রু নন। আমার বিশ্বাস রুশরাও রক্তপাত চান না। তারাও ইউক্রেনের বিরুদ্ধে যুদ্ধ চান না।
তিনি ফের হুশিয়ারি উচ্চারণ করে বলেন, ইউক্রেনে হামলা চালালে রাশিয়াকে কঠোর মূল্য দিতে হবে।
এদিকে ন্যাটোর মহাসচিব জেনস স্টলটেনবাগ বলেছেন, ইউক্রেন সীমান্ত থেকে কিছু সৈন্য ফিরিয়ে নিলেও রাশিয়ার পক্ষ থেকে এখন পর্যন্ত উত্তেজনা প্রশমনের কোনো লক্ষণ দেখা যায়নি। তবে ক‚টনৈতিক প্রচেষ্টা সম্পর্কে মস্কোর ইতিবাচক মনোভাব আমাদের সতর্কভাবে আশাবাদী করছে। ইউক্রেন নিয়ে ক‚টনৈতিক সমাধান পথ খোঁজায় রাশিয়ার সিদ্ধান্তে স্বাগত জানিয়েছেন ন্যাটোর প্রধান। তবে ক‚টনৈতিক সমাধানের এই ইঙ্গিত যাতে সফল হয় তিনি সেদিকে রাশিয়ার দৃষ্টি দেওয়া প্রয়োজন।
অন্যদিকে যে ইউক্রেনকে নিয়ে পশ্চিমা বিশ্ব ও রাশিয়ার মধ্য টানা কয়েক মাস ধরে উত্তেজনা বিরাজ করছে তারা বরাবরই এই ঘটনার ক‚টনৈতিক সমাধান চেয়ে এসেছে। ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট একাধিকবার বলেছেন, তারা যুদ্ধ চান না। পশ্চিমারা সীমান্ত ইস্যুকে অতিরঞ্জিত করছে। তারাই পরস্থিতিকে যুদ্ধের দিকে ঠেলে দিচ্ছে। সারা বিশ্ব যুদ্ধের শঙ্কায় থাকলেও খোদ ইউক্রেনবাসীদের মধ্যে এ নিয়ে তেমন মাথাব্যাথা দেখা যাচ্ছে না।
শিশুরা পার্কে খেলা করছে, শীতের রোদে দাঁড়িয়ে কর্কশ কণ্ঠে পিঙ্ক ফ্লয়েডের গান গেয়ে আসর জমিয়েছে এক গায়ক, কিশোর-কিশোরীরা খোলা আকাশের নিচে বরফের ওপর স্কেটিং করতে গিয়ে পিছলে পড়ে হেসে লুটোপুটি খাচ্ছে। স্থানীয় সময় গত মঙ্গলবার পূর্বাঞ্চলীয় ম্যরিউপুল শহরে এমন চিত্র দেখা গেছে। দেখে কোনোভাবেই বোঝার উপায় নেই, তাদের মাথার ওপর বন্দুক তাক করা আছে এবং রাশিয়া যেকোনো সময় পুরোদমে আক্রমণ চালাতে পারে।
প্রতিরক্ষা পর্যবেক্ষকরা মঙ্গলবার জানান, মনে হচ্ছে ইউক্রেন সীমান্ত থেকে রাশিয়া কিছু সৈন্য সরিয়ে নিয়েছে। যদিও পশ্চিমাদেশগুলো রাশিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণ মোকাবিলায় দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেনের মতে, কোনো ধরনের পূর্বসতর্কতা ছাড়াই যে কোনো সময় ইউক্রেন আক্রমণ করতে পারে রাশিয়া।
যুক্তরাষ্টের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন পশ্চিমা নেতারাদের বলেছিলেন, সপ্তাহান্তে অর্থাৎ, ১৬ ফেব্রুয়ারি হামলার সম্ভাবনা রয়েছে। এটা শুরু হতে পারে ক্ষেপণাস্ত্র বা সাইবার আক্রমণের দ্বারা। যদিও তার আগেই অর্থাৎ ১৫ ফেব্রুয়ারি সন্ধ্যায় সাইবার হামলার শিকার হয়েছে ইউক্রেন। কারা এ হামলা চালিয়েছে সে সম্পর্কে সুস্পষ্ট করে এখনো কিছু জানা যায়নি। তবে এ হামলার জন্য রাশিয়াকে দায়ী করছে অনেকে।
পশ্চিমা দেশগুলোর গণমাধ্যমে হামলার সতর্কবার্তা সত্তে¡ও সংঘাতময় অঞ্চল থেকে মাত্র ১০ কিলোমিটার দূরবর্তী পূর্বাঞ্চলীয় ম্যরিউপুল শহরের মানুষকে দেখা গেছে আনন্দ-উল্লাস করতে। তারা রেস্টেুরেন্টে জমিয়ে খাওয়া-দাওয়া করছে। তাদের মধ্যে আতঙ্কের লেশ ছিল খুবই কম। দেখে মনে হচ্ছিল, জীবন জীবনের পথেই চলবে- এটাকে তারা ধারণ করেছে। এমন পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, রাশিয়ার সম্ভাব্য আক্রমণ নিয়ে তাদের চেয়ে পশ্চিমা দেশগুলো তার চেয়ে অনেক অনেক বেশি উদ্বিগ্ন। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় ইউক্রেনে দুটি ব্যাংক এবং প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়ে সাইবার আক্রমণ হয়েছে। তা সত্তে¡ও ম্যরিউপুলের সুপার মার্কেটগুলোতে ক্রেতাদের কমতি ছিল না। ৫ লাখ মানুষ অধ্যুষিত এ অঞ্চলে খুবই শান্ত পরিস্থিতি বিরাজ করতে দেখা গেছে।
রাশিয়ার হুশিয়ারির বিষয়ে ইউক্রেনবাসী বেশ ভালোভাবেই অবগত। ২০১৪ সালে পূর্বাঞ্চলে রাশিয়া সমর্থিত যুদ্ধে ইউক্রেনের অন্তত ১৪ হাজার মানুষ নিহত হয়েছে। সে সময় ম্যরিউপুলও কিছু সময়ের জন্য বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে চলে যায়। তা সত্তে¡ও সেখানকার মানুষ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিনের ছায়াতলে থাকতে অভ্যস্থ হয়ে গেছে।
সীমান্ত উত্তেজনাকে কেন্দ্র করে অনেকেই নতুন নতুন পরিকল্পনা করছেন। কেউ কেউ কীভাবে ক্ষত পরিচর্যা করতে হয় বা বন্দুক চালাতে হয় সে প্রশিক্ষণ নিচ্ছে। ৩৫ বছর বয়সি মেডিকেল রিপ্রেজেন্টিটিভ মারিয়ানা হেটম্যানোভা বলেন, আমি একটি ব্যাগ গুছিয়ে রেখেছি এবং গাড়িতে পেট্রল ভরে রেখেছি। পরিস্থিতি যাই হোক’ আমি তার জন্য প্রস্তুত। আমি রাশিয়ায় থাকতে চাই না। আমি পশ্চিম ইউক্রেনের দিকে যেতে পারে। পোল্যাল্ড বা জার্মানিও আমার গন্তব্য হতে পারে। আমি ঠিক জানি না কোথায় যাব। তবে আমি মরতে চাই না। আজ না হোক কাল বা এখনই’ যে কোনো সময় আক্রমণ হতে পারে। কবে হবে সে সম্পর্কে আমরা কিছু জানি না-বলেন তিনি।
মঙ্গলবার মস্কো বলেছে, ইউক্রেন সীমান্ত থেকে কিছু সৈন্য তারা ফিরিয়ে নিচ্ছে। এ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প এক সংবাদ সম্মেলনে বলেন, রাশিয়ার সশস্ত্র বাহিনী এখনো হুমকিপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে।
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমিরি জেলনস্কি দীর্ঘদিন ধরে বলে আসছেন- এটা ঠিক যে, রাশিয়া তার দেশ আক্রমণের হুমকি দিচ্ছে। তবে এটাকে পশ্চিমারা অতিরঞ্জিত করছে। ইউক্রেন সরকার ১৬ ফেব্রæয়ারিকে ডে অব ইউনিটি (ঐক্য দিবস) ঘোষণা করেছে। এর মধ্য দিয়ে তিনি জনগণকে পতাকা হাতে নিয়ে জাতীয় সংগীত গেয়ে ভয় দূর করতে উৎসাহিত করেছেন।
সংঘাত শুরু হলে পরিস্থিতি মোকাবিলায় তাৎক্ষণিক কাজ করতে পারবেÑ এমন কোনো বেসামরিক ইউনিট এখনো প্রস্তুত করা হয়নি। যুদ্ধ শুরু হলে সাধারণ জনগণের কি করতে হবে সে সম্পর্কেও কোনো দিকনির্দেশনা নেই। বোমা বিস্ফোরণ হলে কি করতে হবে সে সম্পর্কে বেশিরভাগ মানুষ অবগত নয়। তাদের কোনো প্রস্তুতি নেই। ইউরেশিয়া ডেমোক্র্যাসি ইনিশিয়েটিভের পরিচালক এবং সোভিয়েত পরবর্তী রাষ্ট্রগুলোর থিংক ট্যাংক হিসেবে পরিচিত ইউক্রেনের বাসিন্দা পিটার জালমায়েভ বলেন, বিপুল সংখ্যক মানুষ হুমকির সত্যতা ও বিশ^াযোগ্যতা নিয়ে সন্দিহান।
তিন দিক থেকে আক্রমণের ঝুঁকিতে রয়েছে ম্যরিউপুল। এর উত্তরে রাশিয়া, বিচ্ছিন্নতাবাদীদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে এর পশ্চিমাঞ্চল। পূর্বে রয়েছে আযব সি- যা ইউক্রেন ও রাশিয়ার অংশ। নগরীর একটি বোমা আশ্রয়কেন্দ্রের ব্যবস্থাপক বলেন, প্রস্তুতি খুবই সামান্য। আশ্রয়কেন্দ্রগুলোতে প্রয়োজনীয় উপকরণ খুব কমই রাখা হচ্ছে। পর্যাপ্ত পানির ব্যবস্থাও করা হচ্ছে না। কারণ খুব কম লোকই মনে করে তাদের এসবের প্রয়োজন হবে। দীর্ঘদিন ধরে অব্যবহৃত থাকার কারণে অনেক আশ্রয়কেন্দ্র এখন স্পা ও রেস্টুরেন্টে পরিণত হয়েছে।
জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শলৎজের সঙ্গে এক যৌথ সংবাদ সম্মেলনে পুতিন বলেন, ইউরোপে তিনি যুদ্ধ চান না। যুক্তরাষ্ট্র ও ন্যাটোর সঙ্গে ক্ষেপণাস্ত্র ব্যবস্থাপনা ও সামরিক স্বচ্ছতা নিয়ে সঙ্গে বৈঠকে প্রস্তুত মস্কো। কিন্তু তিনি ইউক্রেনের ন্যাটোতে যোগদানের বিষয়টির এখনই সুরাহা চান। কিন্তু এ নিয়ে পশ্চিমা বিশে^র আশ^াস যথেষ্ট নয়। গত ডিসেম্বর থেকে ইউক্রেনের ন্যাটোর সদস্য হওয়ার বিরোধিতা করে আসছে রাশিয়া। তখন থেকেই ইউক্রেন সীমান্তে হাজার হাজার সেনাসদস্য জড়ো করা শুরু করে রাশিয়া।
উত্তেজনা নিরসনে পশ্চিমা নেতাদের অব্যাহত প্রচেষ্টা সত্তে¡ও গত রোববার ধনী ব্যবসায়ী ও শিল্পপতিদের নিয়ে অন্তত ২০টি চার্টার্ড বিমান কিয়েভ ছেড়ে গেছে। বাণিজ্যিক বিমানগুলোর চলাচলের সুবিধার্থে নিজস্ব আকাশসীমা উন্মুক্ত রাখতে তহবিলের প্রতিশ্রুতি দিয়েছে ইউক্রেন সরকার। যদিও যুক্তরাষ্ট্র, ব্রিটেনসহ আরো বেশ কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের ইউক্রেন ছাড়ার পরামর্শ দিয়েছে। কিছু কিছু দূতাবাস তাদের অফিস পশ্চিমাঞ্চলে স্থানান্তর করেছে এবং দূতাবাসকর্মীদের সরিয়ে নিয়েছে।
ম্যরিউপুলের আল জাজিরা সংবাদদাতা জানান, গত কয়েক বছরের মধ্যে মঙ্গলবার প্রথমবারের মতো রুশ যুদ্ধবিমানকে টহল দিতে দেখা গেছে। কিছু বাণিজ্যিক বিমানকে ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে উড়তে দেখা গেছে। ২০১৪ সালে বিচ্ছিন্নতাবাদীরা মালয়েশিয়া এয়ারলাইনসের ফ্লাইট এমএইচ১৭ গুলি করে ভ‚পাতিত করার পর এই আকাশসীমায় আর বিমান চলাচল করেনি।
আট বছর ধরে যুদ্ধাবস্থায় থাকা ইউক্রেনের জন্য প্রতিবেশী দেশ রাশিয়ার যে কোনো আরচরণই স্বাভাবিক মনে হতে পারে। সম্ভাব্য আক্রমণকে প্রতিহত করতে সতর্কতা হিসেবে পশ্চিমাদেশগুলোর ক‚টনৈতিক কার্যক্রম এবং সামরিক সরঞ্জাম সরবরাহ ব্যাপক প্রশংসিত হয়েছে। গত মঙ্গলবার পুতিন আবারো বলেছে, ইউক্রেনে আক্রমণের কোনো পরিকল্পনা তাদের নেই। ইউরোপের সঙ্গে যুদ্ধে জড়াতে চায় না রাশিয়া।
কারো কারো মতে, ইউক্রেন নিয়ে যে অচলাবস্থা সৃষ্টি হয়েছে তা দীর্ঘায়িত হবে। স্থানীয় বিশ্লেষকদের মতে, পুতিন ইউক্রেন আক্রমণ করবেÑ এটা আমরা বিশ^াস করি না। জালমায়েভ বলেন, বেশিরভাগ বিশ্লেষকদের মতে, চলতি বছরই এই অচলাবস্থার নিরসন হবে। এই অচলাবস্থা অনির্দিষ্টকালের জন্যও হতে পারে’ এমনটাও মনে করছেন অনেকে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে ইঁদুর-বিড়ালের খেলা সবে শুরু হয়েছে। সূত্র-বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরা অবলম্বনে।
মন্তব্য