-->

রাশিয়ার দখলে ৪ শহর

* আন্তর্জাতিক আদালতে কিয়েভ * বেলারুশে আপত্তি জেলেনস্কির * পুতিন স্মার্ট, আমরা নির্বোধ: ট্রাম্প * রুশ নেতার পতন হতে পারে: ব্রিটেন

নিজস্ব প্রতিবেদক
রাশিয়ার দখলে ৪ শহর
দেশ ছেড়ে যাচ্ছেন হাজার হাজার ইউক্রেনবাসী। ছবি- এএফপি

ইউক্রেনে রুশ অভিযান টানা চার দিনে গড়িয়েছে। রাজধানী কিয়েভসহ অন্য শহরগুলোতে হামলা অব্যাহত রেখেছে রাশিয়া। রুশ বাহিনীকে প্রতিহত করতে ইউক্রেন সেনারা আপ্রাণ চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। ইতোমধ্যে রুশ বাহিনী ইউক্রেনের চারটি শহর দখল করে নিয়েছে।

দেশটির কর্মকর্তারা জানান, উত্তর-পূর্বাঞ্চলে ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে ঢুকে পড়েছে রুশ সেনারা। সেখানে রকেট হামলা চালানো হয়েছে। এতে একজন নারী নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া আহত হয়েছেন আরো অনেকে।

সর্বশেষ খবর পাওয়া পর্যন্ত রুশ হামলায় ইউক্রেনে অন্তত ২৪০ বেসামরিক লোক হতাহতের খবর পাওয়া গেছে। ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস এক সাক্ষাৎকারে বলেছেন, এটি পুতিনের জন্য হতে পারে শেষের শুরু। তবে পশ্চিমা নেতারা ইউক্রেন সংকট নিরসনে এখনো কার্যকর কোনো পদক্ষেপ নেয়নি। খবর: বিবিসি, সিএনএন ও আল জাজিরার।

ইউক্রেনে আগ্রাসন বন্ধ না হওয়ায় পশ্চিমা দেশগুলো রাশিয়ার প্রেসিডেন্টসহ দেশটির সামরিক- বেসামরিক ব্যক্তি ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের ওপর কঠোর নিষেধাজ্ঞা আরোপ অব্যাহত রেখেছে। আর্থিক লেনদেনের বার্তা আদান-প্রদানকারী আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠান সুইফট পেমেন্ট নেটওয়ার্কে রাশিয়ার কিছু ব্যাংককে নিষিদ্ধের সিদ্ধান্ত নিয়েছে পশ্চিমা নেতারা। এ ছাড়া ইউক্রেনে অস্ত্র পাঠাচ্ছে যুক্তরাষ্ট্র, ফ্রান্স, জার্মানি ও নেদারল্যান্ডস।

সংকট নিরসনে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্টের বৈঠকের প্রস্তাবে রুশ প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন সম্মতি দিলেও স্থান নিয়ে দুই নেতা একমত হতে না পারায় তা বারবার পিছিয়ে যাচ্ছে। জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় প্রস্তুত। তবে বেলারুশে আলোচনা অনুষ্ঠিত হলে, তাতে অংশ নিতে রাজি নন তিনি। বেলারুশ ছাড়া অন্য যেকোনো জায়গায় আলোচনায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি নেই বলেও জানান তিনি।

দুনিয়ার সব নাগরিক, ইউক্রেন এবং শান্তি ও গণতন্ত্রের বন্ধুদের উদ্দেশে জেলেনস্কি বলেন- ইউক্রেন, ইউরোপ এবং বিশ্বের প্রতিরক্ষায় যোগদানে আগ্রহী যে কেউ এসে রাশিয়ার যুদ্ধাপরাধীদের বিরুদ্ধে ইউক্রেনীয়দের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে লড়াই করতে পারেন।

এদিকে ইউক্রেনে যুদ্ধরত রাশিয়ার বিশেষ বাহিনীর সেনাদের বীরত্বের প্রশংসা করেছেন পুতিন। রোববার বিশেষ বাহিনীর সেনাদের পেশাগত ছুটির দিনে ইউক্রেনে তাদের লড়াইকে বীরত্বের সঙ্গে তুলনা করে সেনাদের অভিনন্দিত করেন।

রাশিয়াকে প্রতিহত করা সম্ভব নয় জেনেও ইউক্রেনের লোকজন চেষ্টা করে যাচ্ছে। রাষ্ট্র প্রধানের আহ্বানে সারা দিয়ে দেশ রক্ষায় সৈন্য, পুলিশ, চিকিৎসাকর্মীসহ অসংখ্য ও বেসামরিক লোক হাতে অস্ত্র তুলে নিয়েছে।

ইউক্রেন দাবি করেছে এ পর্যন্ত রাশিয়ার চার হাজার তিনশ সৈন্য নিহত হয়েছে। রাশিয়ার ২৭টি প্লেন ধ্বংস করা হয়েছে। ২৬টি হেলিকপ্টার বিধ্বস্ত হয়েছে। এ ছাড়া, রাশিয়ার ১৪৬টি ট্যাংক, ৭০৬টি যুদ্ধযান, ৪৯টি কামান, একটি এয়ার ডিফেন্স সিস্টেম, বেশ কয়েকটি রকেট লঞ্চ সিস্টেমস, ৩০টি গাড়ি, ৬০টি ট্যাংকার, ২টি ড্রোন ও ২টি জাহাজ ধ্বংস করেছে ইউক্রেনের প্রতিরক্ষা বাহিনী।

তাদের এসব দাবির সত্যতা যাচাই করা সম্ভব হয়নি। তবে রাশিয়া এখনো ক্ষয়ক্ষতির কোনো তথ্য প্রকাশ করেনি।

ইউক্রেনের প্রতিরক্ষামন্ত্রী ওলেক্সি রেজনিকভ বলেন, আমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে প্রতিরোধ ব্যবস্থাকে ইউরোপের ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার লড়াই হিসাবে তৈরি করেছি। ফেসবুকে দেওয়া পোস্টে তিনি লেখেন, যারা দুই ঘণ্টার মধ্যে কিয়েভ দখলে নিতে চেয়েছিল, তারা কই? তাদের দেখতে পাচ্ছি না। ইউক্রেনের সেনাবাহিনী এবং দেশটির জনগণ ছাড়া, ইউরোপ কখনোই নিরাপদ হবে না।

আগ্রাসন শুরুর পর থেকে এখন পর্যন্ত অন্তত দেড় লাখের বেশি মানুষ ইউক্রেন থেকে পোল্যান্ডে প্রবেশ করেছেন। গতকালও বিপুলসংখ্যাক মানুষকে ইউক্রেন ছাড়তে দেখা যায়। ইউক্রেনে হামলার পর সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমগুলোর রোষানলে পড়েছে রাশিয়া।

ফেসবুকের পর এবার ইউটিউবের প্রধান কোম্পানি অ্যালফাবেট জানিয়েছে, রাশিয়ার মিডিয়া আউটলেটের বিজ্ঞাপন প্রচার এবং লেনদেন স্থগিত করবে। এর অর্থ দাঁড়াচ্ছে, রাশিয়া টুডেসহ অন্যান্য চ্যানেলগুলো ইউটিউব বা অ্যালফাবেট চালিত ওয়েবসাইট এবং অ্যাপগুলোতে বিজ্ঞাপনের জন্য আর অর্থ গ্রহণ করতে পারবে না। এর আগে রাশিয়ার বিরুদ্ধে ফেসবুক ও টুইটার কঠোর বিধিনিষেধ জারি করে।

কিয়েভ ও খারকিভে লড়াই

ইউক্রেনে সামরিক অভিযান শুরুর পর দেশটির চারটি শহর দখল করেছে রাশিয়া। রোববার তিনটি শহর দখল করে রুশ সৈন্যরা। অভিযান শুরুর তৃতীয় দিন ইউক্রেনের দক্ষিণের জাপোরিঝঝায় অঞ্চলের মেলিটপোল শহর দখল করে নেন রুশ সৈন্যরা। বাকি তিনটি শহর হলো নোভা কাখোভকা, খেরশন ও বারদিয়ানস্ক।

এ ছাড়া ইউক্রেনের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর খারকিভে ঢুকে পড়ার পর দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে রুশ সেনাদের তুমুল লড়াইয়ের খবর পাওয়া গেছে। রাজধানী কিয়েভেও লড়াই চলছে। ভোরে রাজধানী কিয়েভের আশপাশে একাধিক বিকট বিস্ফোরণের শব্দ পাওয়া গেছে। বিশাল রুশ বাহিনী চারদিক থেকে এগিয়ে আসায় সর্বোচ্চ সতর্ক অবস্থায় রয়েছে কিয়েভ।

গতকাল ভোরে ইউক্রেনের রাজধানীর দক্ষিণাঞ্চলে দুটি বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায় অনেক দূর পর্যন্ত। আকাশে আলোর ঝলকানি দেখা যায়। ধারণা করা হচ্ছে, বিস্ফোরণগুলো ভাসিলকিভের আশপাশে হয়েছে। সেখানে তুমুল লড়াই চলছে। কিয়েভ থেকে ৩০ কিলোমিটার দূরের ওই এলাকায় একটি বড় সামরিক ঘাঁটি এবং একাধিক জ্বালানি ট্যাংক রয়েছে।

ইউক্রেনের কৌশলগত বন্দর শহর মাইকোলাইভে গত শনিবার রাতে বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়। সেখানেও ব্যাপক গোলাগুলি চলছিল বলে জানা গেছে। ইউক্রেনের অনেক শহরের রাস্তায় রুশ সেনারা অবস্থান নিয়েছে। সংখ্যা কম হলেও তাদের প্রতিরোধ করার চেষ্টা অব্যাহত রেখেছে ইউক্রেনের সেনারা।

আন্তর্জাতিক আদালতে কিয়েভ

ইউক্রেনে চলমান রুশ অভিযান এখনই বন্ধে জরুরি ভিত্তিতে আদেশ দেওয়া এবং এই অভিযানের কারণে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিচারকাজ শুরু করতে আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদন করেছেন কিয়েভ।

রোববার এক টুইটে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলেনস্কি বলেন, আমরা রাশিয়ার বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক আদালতে আবেদন করেছি। রাশিয়াকে অবশ্যই আগ্রাসন ও গণহত্যার জন্য জবাবদিহিতার আওতায় আনা হবে। আবেদনে এক সপ্তাহের মধ্যে রাশিয়ার বিরুদ্ধে বিচার শুরু করার অনুরোধ জানিয়েছি।

সেনাদের বীরত্বের প্রশংসায় পুতিন

ইউক্রেনে যুদ্ধরত রাশিয়ার বিশেষ বাহিনীর সেনাদের বীরত্বের প্রশংসা করেছেন দেশটির প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন। রোববার পুতিন টেলিভিশনে সম্প্রচারিত ভাষণে বলেন, তাদের প্রতি বিশেষ কৃতজ্ঞতা, যারা ডনবাসের (ইউক্রেনের বিচ্ছিন্নতাবাদী নিয়ন্ত্রিত দুই স্বঘোষিত প্রজাতন্ত্র নিয়ে গঠিত অঞ্চল) প্রজাতন্ত্র দুটির জনগণকে সহায়তা প্রদানের জন্য বিশেষ এক অভিযানের সময় বীরত্বের সঙ্গে তারা সামরিক দায়িত্ব পালন করছেন।

বেলারুশে আপত্তি জেলেনস্কির

ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, তিনি রাশিয়ার সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। তবে বেলারুশে আলোচনা অনুষ্ঠিত হলে, তাতে অংশ নেবেন না। বলেন, রাশিয়া যদি বেলারুশ ভূখণ্ড থেকে হামলা না চালাত, তাহলে আপত্তি করতাম না। বেলারুশ ছাড়া অন্য যেকোনো জায়গায় আলোচনায় অংশ নেওয়ার ক্ষেত্রে আপত্তি নেই।

আমরা অবশ্যই শান্তি চাই, বৈঠক করতে আগ্রহী। আমরা চাই যুদ্ধের অবসান হোক। রাশিয়ার প্রতি আমাদের প্রস্তাব হলো ওয়ারস, ব্রাতিসলাভা, বুদাপেস্ট, ইস্তাম্বুল- কোনোটিকে আলোচনাস্থল হিসেবে বেছে নিতে। যে দেশের ভূখণ্ড থেকে আমাদের লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়া হয়নি, তেমন একটি দেশের যেকোনো শহরেই আলোচনায় আপত্তি নেই আমাদের। আন্তরিকতাপূর্ণ বৈঠক আয়োজনের একমাত্র পথ এটি। সত্যিকার অর্থে যুদ্ধ অবসানেরও একমাত্র উপায় এটি।

এদিকে রোববার এক বিবৃতিতে ক্রেমলিনের মুখপাত্র দিমিত্রি পেসকভ বলেছেন, রাশিয়া ইউক্রেনের সঙ্গে আলোচনায় বসতে প্রস্তুত। আলোচনার জন্য ইতোমধ্যে মস্কো থেকে একটি প্রতিনিধিদল বেলারুশের গোমেল শহরে পৌঁছেছে।

পুতিন স্মার্ট, আমরা নির্বোধ: ট্রাম্প

যুক্তরাষ্ট্রের সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বলেছেন, সমস্যা এটা নয় যে পুতিন স্মার্ট, সমস্যা হলো আমাদের নেতারা খুবই নির্বোধ। স্থানীয় সময় গত শনিবার যুক্তরাষ্ট্রের ফ্লোরিডার অরল্যান্ডোতে অনুষ্ঠিত বার্ষিক কনজারভেটিভ পলিটিক্যাল অ্যাকশন কনফারেন্সে রাশিয়া-ইউক্রেন সংঘাত নিয়ে তিনি এ কথা বলেন।

ট্রাম্প তার দীর্ঘ বক্তৃতায় ইউক্রেন সংকট নিয়ে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন পশ্চিমা সামরিক জোট ন্যাটোর তীব্র সমালোচনা করেন। একই সঙ্গে ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোট চুরির মিথ্যা দাবির পুনরাবৃত্তি করেন। এই নির্বাচনে তিনি বাইডেনের কাছে হেরে ক্ষমতা থেকে বিদায় নেন। ইউক্রেনে রাশিয়ার হামলার জন্য বাইডেনের দুর্বলতাকে দায়ী করেন।

অন্যদিকে, তিনি রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট পুতিনের বুদ্ধির প্রশংসা করেন। তিনি দাবি করেন, সবাই এই বিষয় জানেন-বোঝেন, প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কারচুপি না হলে ইউক্রেনে এই ভয়াবহ বিপর্যয় কখনোই ঘটত না। ন্যাটোর সমালোচনা করে বলেন, অন্তত মনস্তাত্ত্বিকভাবে রাশিয়াকে আঘাত করার বদলে তারা (ন্যাটো) নিষেধাজ্ঞার মতো পদক্ষেপের দিকে তাকিয়ে ছিল। নিষেধাজ্ঞার পদক্ষেপকে স্মার্টের বিপরীত হিসেবে বর্ণনা করেন।

রুশ নেতার পতন হতে পারে: ব্রিটেন

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী লিজ ট্রাস বলেছেন, রাশিয়া ও ইউক্রেনের মধ্যকার সংঘাত কয়েক বছর ধরে চলতে পারে। এমনকি এই যুদ্ধ রুশ প্রেসিডেন্ট পুতিনের পতন ডেকে আনতে পারে। রোববার স্কাই নিউজের সঙ্গে আলাপকালে এমন সতর্ক বার্তা উচ্চারণ করেন।

এসময় ইউক্রেন বাহিনীর সাহসিকতারও প্রশংসা করেন তিনি। বলেন, তাদের এমন প্রতিরোধ মস্কোর জন্য অপ্রত্যাশিত ছিল। এই যুদ্ধ থেকে পুতিনের পতনের সূচনা হতে পারে। আমরা জানি রাশিয়ার শক্তিশালী বাহিনী আছে। কিন্তু ইউক্রেনীয়রা সাহসী। তারা নিজেদের রক্ষা এবং লড়াই চালিয়ে যেতে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ। এটি পুতিনের জন্য হতে পারে শেষের শুরু।

মন্তব্য

Beta version