ইউক্রেনে রুশ অভিযানের প্রায় সপ্তাহ হতে চলল। ইতোমধ্যে রুশ বাহিনী দেশটির বেশ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহর দখল করে নিয়েছে। আর কয়েকটি শহর দখলের পথে রয়েছে বলে দাবি করেছে মস্কো। কয়েক দিন আগে থেকেই রুশ বাহিনী রাজধানী কিয়েভের দিকে অগ্রসর হচ্ছে। তবে তারা এখনো তা দখল করেনি এবং করতে চায় এমনটাও মনে হচ্ছে না। কারণ পুতিন মার্চের ২ তারিখের মধ্যে অভিযান শেষ করার জন্য তার বাহিনীকে নির্দেশ দিয়েছিলেন। এরপর রুশ বাহিনী তাদের আক্রমণের তীব্রতা কমিয়ে দিয়েছে।
সবেচেয়ে বড় আশ্চর্যের বিষয়টা হলো- একটি গ্রহণযোগ্য সমাধানে পৌঁছানোর লক্ষ্যে বেলারুশে উভয় পক্ষ আলোচনার টেবিলে বসেছে। স্থানীয় সময় গত সোমবার দুপুর ১২টায় শুরু হওয়া সেই বৈঠক ৫ ঘণ্টাব্যাপী চলে। শিগগিরই তারা আবারো বৈঠকে মিলিত হবে বলে জানায়।
এখানে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, রাশিয়ার বিশাল এবং শক্তিশালী সামরিক বাহিনী থাকা সত্ত্বেও কেন আক্রমণের তীব্রতা কমিয়ে দিয়েছে। তারা চাইলেই কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই কিয়েভ দখল করে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদমির জেলনেস্কির সরকারকে হটাতে পারে। কিন্তু তা করছে না। এটা ঠিক যে, ইউক্রেনে আক্রমণ করতে গিয়ে রুশ বাহিনী অপ্রত্যাশিত প্রতিরোধের সম্মুখীন হয়েছেন। ইউক্রেনে রুশ নেতা কী করতে চাইছে সে সম্পর্কে কেউই সুস্পষ্ট কোনো ধারণা দিতে পারছে না। তবে পুতিন যে নিজ ইচ্ছা বাস্তবায়নে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ- এ বিষয়ে সবাই একমত।
বিশ্লেষকদের মতে, রাশিয়া এখনো আলোচনার টেবিলে তার সব খাতা রাখেনি। রাশিয়া ইউক্রেনের ক্ষমতা ও পরিস্থিতি অনুধাবন করে সে অনুযায়ী চাল দিচ্ছে। ইউক্রেনে রুশ আক্রমণ গতকাল মঙ্গলবার ৬ষ্ঠ দিনে গড়িয়েছে। সপ্তাহব্যাপী এ আক্রমণে কয়েক শ প্রাণহানির খবর পাওয়া গেছে। এখন প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, এই অভিযানের মধ্য দিয়ে পুতিন কী অর্জন করার চেষ্টা করছে।
এ নিয়ে লন্ডনের লফবরো বিশ্ববিদ্যালয়ের ডিপ্লোমেসি অ্যান্ড ইন্টারন্যাশনাল গভর্নেন্সের প্রভাষক ক্রিশ্চিয়ান নিতই বলেন, রাশিয়ার উদ্দেশ্য সম্পর্কে বিভ্রান্ত হওয়া উচিত নয়। তিনি সংশোধনবাদী রাজনীতি ও বিশাল ক্ষমতার অধিকারী হওয়ার স্বপ্ন দেখছেন। স্নায়ুযুদ্ধের অবসানের পর থেকে সাবেক সোভিয়েত যুগে ফিরে যাওয়ার মাধ্যমে পশ্চিমাদের সমকক্ষ হওয়ার লক্ষ্যে দীর্ঘদিন ধরেই কাজ করে যাচ্ছে রাশিয়া। ইউক্রেন, মলদোভা বা কাজাখস্থানের মতো ছোট প্রতিবেশী দেশগুলোতে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ করতে চান তিনি।
যাই হোক, ইউক্রেন পশ্চিমাবলয়ের অন্তর্ভুক্ত হতে চায়- যা পুতিনের ইচ্ছা বাস্তবায়নে বাধা হয়ে দাঁড়িয়েছে। সে হিসেবে বলা যায়, কিয়েভে রুশ সমর্থিত একজন সরকার বসাতেই ক্রেমলিন সামরিক অভিযান চালাচ্ছে। এ রকম একটি চিত্রনাট্য কি সত্যিই বাস্তবায়ন সম্ভব।
সিডনি বিশ্ববিদ্যালয়ের সরকার ও আন্তর্জাতিক-বিষয়ক প্রফেসর ইমেরিটাস গ্রায়েম গিল বলেন, রাশিয়া যদি কিয়েভের নিয়ন্ত্রণ নিতে পারে তাহলে একজন অন্তর্বর্তী সরকার গঠন করবে। বর্তমান পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, ইউক্রেনের জনগণ এটা মেনে নেবে এমন সম্ভাবনা খুবই কম। বরং, প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলনস্কিকে ক্ষমতায় রেখে আলোচনার মাধ্যমে বর্তমান সরকারের কিছু লোককে নিজের পক্ষে নিতে পারাটাই পুতিনের উদ্দেশ্য বাস্তবায়নে অনেক বেশি কাজে দেবে। হয়তো প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামো বজায় থাকবে। দনতেস্ক এবং লুহানস্কে ফেডারেল ব্যবস্থা চালু করতে আনুষ্ঠানিক স্বায়ত্তশাসন প্রদানটা প্রয়োজন হবে।
রাশিয়া যদি কিয়েভের সঙ্গে আলোচনা অব্যাহত রাখে এবং একটি চুক্তিতে পৌঁছায়ও, তাহলেও সেটা দায়বদ্ধতার সম্মুখীন হবে। কারণ, চাপের মধ্যে পড়ে এ ধরনের আলোচনা ও চুক্তি হয়েছে বলে ধরে নেওয়া হবে এবং এটা কোনো ফল বয়ে আনবে না। পুতিনের জন্য সহজ কোনো বিকল্প নেই। রুশ সেনাবাহিনীর অস্ত্রের জোরে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠনও সহজ কোনো কাজ নয়, বলেন গিল।
সংকট নিরসনে বেলারুশে দুই দেশের প্রতিনিধিরা আলোচনায় বসলেও রাশিয়া এখনো ইউক্রেনে উল্লেখযোগ্য অগ্রগতি করতে পারেনি। কারণ ইউক্রেনের প্রতিরোধ প্রত্যাশার চেয়েও অনেক বেশি। যুক্তরাষ্ট্রের আর্মি ওয়ার কলেজের স্ট্র্যাটেজিক স্টাডিজ ইনস্টিটিউটের যৌথ গবেষণা অধ্যাপক জন আর ডেনি বলেন, রাশিয়া এখনো আলোচনার টেবিলে তার সব খাতা রাখেনি। আমার মতে, রাশিয়া ইউক্রেনের ক্ষমতা ও পরিস্থিতি অনুধাবন করে সে অনুযায়ী চাল দিচ্ছে।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিবেদন অনুযায়ী, রুশ সেনারা কোথাও ৫০ এবং কোথায় ৭০ শতাংশ পর্যন্ত অগ্রসর হতে পেরেছে। লক্ষ্যে পৌঁছাতে তাদের আরো অনেক কাঠখড় পোড়াতে হবে। কাক্সিক্ষত লক্ষ্য অর্জন করতে না পারায়, আন্তর্জাতিক গণমাধ্যম ও বিশ্লেষকরা রাশিয়ার সামরিক কৌশল নিয়ে প্রশ্ন তুলেছে।
ডেন বলেন, কিয়েভের বাইরে এন্টোনভ আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখতে অক্ষম বা অভিজ্ঞ রুশ বাহিনীর মধ্যে সমন্বয়হীনতা- কোনোটাই তাদের আচরণের সঙ্গে যাচ্ছে না। অভিযানের পরিপ্রেক্ষিতে বলা যায়, রুশ বাহিনীর সফল না হওয়া বা ইউক্রেনের আকাশের পূর্ণ নিয়ন্ত্রণ নিতে না পারার মধ্যে কিছু অসঙ্গতি রয়েছে, যা আমার বোধগম্য হচ্ছে না।
কিয়েভের পতন হয় কি না, এবং যদি হয় তাহলে কবে এবং কখন- সেটাই এখন বিশ্লেষকদের ভাবিয়ে তুলেছে। ইউক্রেনের মতে দেশের সঙ্গে পুতিন কি করতে চাচ্ছে সেটা এখনো রহস্য হয়ে রয়েছে। সম্ভাব্য বিকল্প হতে পারে ইউক্রেনকে বিভক্ত করে দেওয়া। এটা করা পুতিনের জন্য কঠিন কিছু না। ইউক্রেনের বিভাজন বাস্তবায়ন ও কার্যকরে জোরালো কিছু যুক্তি প্রয়োজন। বতর্মানে রুশ বাহিনী সুসজ্জিত অবস্থায় রয়েছে এবং তারা এই বিভক্তি বাস্তবায়ন করতেও পারে। তবে খুব অল্প সময়ের মধ্যে রুশ বাহিনী সেটা বাস্তবায়ন করতে সক্ষম-এ বিষয়ে আমি সন্দিহান- বলেন ডেনি।
তার এ সন্দেহ অমূলক নয়। উদাহারণ হিসেবে বলা যায়, ইউক্রেনের পূর্বাঞ্চলে রুশ বাহিনী অপ্রত্যাশিত বাধার মুখে পড়েছে এবং সেখানকার বেসামরিক-সেনা মিলিত হয়ে প্রতিরোধ গড়ে তুলেছে। তারা রুশ বাহিনীকে চ্যালেঞ্জ জানিয়েছে। তবু সম্ভবত ডিনিপ্র নদীর ধারে একটি বিভাজনের সম্ভাবনা উড়িয়ে দেওয়া যায় না, বলেন ডেনি।
আপাত দৃষ্টিতে মনে হচ্ছে, পুতিনের বিকল্পের সংখ্যা ক্রমশ হ্রাস পাচ্ছে। নিতইয়ের মতে, পুতিনের বিকল্প খুবই সীমিত। মনে হচ্ছে, ইউক্রেনে অভিযান চালিয়ে রাশিয়া সাজানো বিজয় অর্জনের ফাঁদে পড়েছে। চীন, ভারত এবং ইরানের মতো দেশগুলো পরিস্থিতি গভীরভাবে পর্যবেক্ষণ করছে। বিজয় ঘোষণা করতে না পারাটা রাশিয়ার শক্তিশালী সামরিক বাহিনীর ভাবমূর্তিকে ক্ষুণ্ন করবে। সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, এই যুদ্ধ ইতোমধ্যে রাশিয়ার ভবিষ্যৎ অবস্থানকে নির্ণয় করে দিয়েছে।
জার্মানি, ফিনল্যান্ডের মতো ইউরোপীয় দেশ, যারা রাশিয়াকে সামরিক পথে না হাঁটার জন্য বা সংযত সামরিক কৌশলের পরামর্শ দিয়েছিল, তারা এখন মস্কোকে শত্রু রাষ্ট্র হিসেবে ভাবার ধারণায় রয়েছে। জার্মানি ইতোমধ্যে তাদের সামরিক বাজেট বাড়িয়েছে। এমনকি ন্যাটোর সদস্যপদ নিয়ে এতদিন ধরে নিরপেক্ষতা বজায় রাখা ফিনল্যান্ড পূর্ব অবস্থা থেকে সরে আসার কথা জানিয়েছে।
বহু ইউরোপীয় দেশ এখনো রাশিয়ার সঙ্গে কথা বলার আগ্রহ প্রকাশ করছে। সংলাপের পথ উন্মুক্ত রাখার অর্থ এই নয় যে, সব মিটমাট হয়ে গেছে। ইউক্রেন ছেড়ে যাওয়া মানুষের স্রোত এবং সেখানকার শহরগুলোর জ¦লে যাওয়ার চিত্র খুব সহজেই ইউরোপ ও আমেরিকার মানুষের মন থেকে মুছে যাবে না। পুতিন যদি কিয়েভে পুতুল সরকার বসাতে পারে তাহলে সেটা হবে পশ্চিমাদের উদার গণতন্ত্রের প্রতি বড় ধরনের আঘাত। এ ছাড়া এটা ইউরোপে আন্তঃরাষ্ট্রীয় সম্পর্কের জন্য বিপজ্জনক হবে।
-আলজাজিরা, বিবিসি ও সিএনএন অবলম্বনে
মন্তব্য