সবেমাত্র বিদায় নিয়েছে শীত। প্রকৃতির নিয়ম অনুযায়ী সকাল-সন্ধ্যায় হিম শীতল ঠান্ডার রেশ এখনো থাকার কথা। কিন্তু প্রকৃতি যেন হঠাৎই উত্তপ্ত হয়ে উঠেছে। সকাল থেকে বেড়ে যাচ্ছে রোদের তীব্রতা। সেই সঙ্গে বাড়ছে গরমের মাত্রাও। শীত যেতে না যেতেই বেড়ে গেছে বৈদ্যুতিক পাখার ব্যবহার। এবার হঠাৎ কেন আবহাওয়ার এই উত্তপ্ত অবস্থা? আবহাওয়াবিদরা বলছেন, এবার প্রকৃতিতে আগেভাগেই গরম আসছে। সামনের দিনগুলোতে তাপমাত্রা আরো বাড়বে। প্রকৃতিতে এল নিনোর প্রভাবে শুরুতেই গরমের মাত্রা বেড়ে যাচ্ছে।
এল নিনো হচ্ছে আবহাওয়ার উষ্ণ অবস্থা। এর প্রভাবে সাগরের তাপমাত্রা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যায়। বিশ্ব উষ্ণায়ন এবং এল নিনোর প্রভাবে এবার প্রকৃতিতে বন্যা, খরা জলোচ্ছ্বাসের মতো প্রাকৃতিক দুর্যোগ বেড়ে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে।
আবহাওয়া অধিদপ্তরের জ্যেষ্ঠ আবহাওয়াবিদ আবদুল মান্নান ভোরের আকাশকে বলেন, বিশ্ব উষ্ণায়ন প্রক্রিয়ার মধ্যে পড়ায় এবার প্রকৃতি আগেই উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে। স্বাভাবিকের চেয়ে তাপমাত্রা ৪ থেকে ৫ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেশি। সামনে তাপমাত্রা আরো বাড়বে। ফলে প্রকৃতি আরো উত্তপ্ত হয়ে পড়তে পারে। ইতোমধ্যে বঙ্গোপসাগরের তাপমাত্রা বেশিমাত্রায় উত্তপ্ত হয়েছে। দেশের কোথাও কোথাও তাপমাত্রা ৩৪ ডিগ্রি সেলসিয়াস পর্যন্ত উঠে যাচ্ছে, যা এই সময়ে স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি। তিনি বলেন, প্রকৃতির হঠাৎ এই উত্তপ্ত হওয়ার সঙ্গে বিশ^ উষ্ণায়ন এবং ‘এল নিনো’র প্রভাব রয়েছে। ফলে এবার প্রাকৃতিক দুর্যোগের আধিক্য দেখা দিতে পারে।
বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়া এবং ‘এল নিনো’- দুটোই বিশ্ব আবহাওয়ায় পরিবর্তন আনছে। যার প্রভাব পড়ছে বাংলাদেশে। বিজ্ঞানীরা গত ২৫ বছরের ইতিহাস পর্যালোচনা করে বলছেন যে, বৈশ্বিক উষ্ণতা বেড়ে যাওয়ার ফলে আরো শক্তিশালী এল নিনোর উদ্ভব হচ্ছে। এল নিনো বন্যা, খরা এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক দুর্যোগের সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত। উন্নয়নশীল যেসব দেশ কৃষিকাজ এবং মাছধরার ওপর নির্ভরশীল, তারাই এল নিনো দ্বারা অধিক ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে থাকে।
আবহাওয়াবিদরা আরো বলছেন, শুধু রাজধানী ঢাকা নয়। ঢাকার বাইরে তাপমাত্রা অস্বাভাবিক মাত্রায় বেড়ে যাচ্ছে। গ্রীষ্মের শুরু থেকেই এবারের যে তাপমাত্রা তা গত ৩০ বছরের গড় তাপমাত্রার চেয়ে অন্তত ৩ থেকে ৪ ডিগ্রি বেশি। আবহাওয়া অধিদপ্তরের আবহাওয়াবিদ মো. উমর ফারুক বলেন, এবার গ্রীষ্মের শুরু থেকেই ঢাকার স্বাভাবিক তামাত্রা ২৯ ডিগ্রির মধ্যে থাকার কথা। যে তাপমাত্রা পাওয়া যাচ্ছে তা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, এল নিনো বা লা নিনার প্রভাব নতুন নয়। এই দুইয়ের প্রভাবে আবহাওয়া একেক সময় একেক ধরনের আচরণ করে। বিশেষ করে গত বছর জুলাই পর্যন্ত প্রকৃতিতে ‘লা নিনার প্রভাব বেশি ছিল। লা নিনা হলো সাগরের তাপমাত্রার শীতলীকরণ অবস্থা। এর প্রভাবে আবহাওয়া অস্বাভাবিক আচরণ করে থাকে।
অস্ট্রেলীয় আবহাওয়া দপ্তরের হিসাব মতে, লা নিনা হচ্ছে ক্লাইমেট ড্রাইভার। সাধারণ নিয়মে প্রশান্ত মহাসাগরের পূর্বদিক থেকে পশ্চিম দিকে বাতাস বয়ে যায়। এর গতি কখনো বেড়ে যায় আবার কখনো উল্টো দিকেও ঘুরে যায়। গোটাটাই নিয়ন্ত্রণ করে মহাসাগরের মধ্য ও পূর্বাংশের জলতলের তাপমাত্রা। এই তাপমাত্রা যখন নির্দিষ্ট সীমার ওপরে উঠে যায়, তখন তাকে ‘এল নিনো’ নামে ডাকে বিজ্ঞানীরা।
শুধু ‘এল নিনো’ বা ‘লা নিনা’ নয়, প্রকৃতিতে ক্রমাগত বাড়ছে বিশ্ব উষ্ণায়নের প্রভাব। বিশ্ব উষ্ণায়নের এই প্রভাব বলয়ের মধ্যে শুরুতে ঢুকে পড়েছে বাংলাদেশ। ফলে শীত যেতে না যেতে প্রকৃতি অধিক মাত্রায় উত্তপ্ত হয়ে পড়ছে।
ইউরোপীয় কমিশনের জলবায়ু পরিবর্তনবিষয়ক সংস্থা দ্য কোপারনিকাস ক্লাইমেট চেঞ্জ সার্ভিসের তথ্য মতে, গত সাত বছর ছিল উষ্ণতম বছর। আর এই তালিকায় পঞ্চম অবস্থানে ছিল ২০২১ সাল। বছরটিতে বেশ কিছু এলাকায় রেকর্ড পরিমাণ গরম পড়েছিল। গত বছর অনুষ্ঠিত জলবায়ু সম্মেলনে বিশ্বনেতারা বৈশ্বিক তাপমাত্রা ১ দশমিক ৫ ডিগ্রিতে সীমিত রাখার কথা বলেন। তবে বিজ্ঞানীরা বলেছেন, সময় দ্রুত শেষ হয়ে যাচ্ছে। বিশ্বব্যাপী চরম গরমের ক্ষতিকর প্রভাব পড়ছে পরিবেশ, মানুষ ও অর্থনীতির ওপর।
কোপারনিকাসের তথ্য বলছে, রেকর্ড গরমের তালিকায় থাকা বছরের মধ্যে গত বছরের অবস্থান ছিল পঞ্চম। ২০১৫ ও ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২১ সালের অবস্থান গরমের দিক দিয়ে পঞ্চম। সংস্থাটি আরো বলছে, গত সাত বছর ছিল সবচেয়ে গরম বছর।
মন্তব্য