ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের দুই সপ্তাহেরও বেশি সময় পার হয়েছে। এই যুদ্ধ এখন পর্যন্ত ভারসাম্যপূর্ণ অবস্থানে রয়েছে। যুদ্ধ সবসময় অনিশ্চিত। কিন্তু ইউক্রেন সংকট কত দিন চলতে পারে, তা নিয়ে উভয়পক্ষ বা বাইরের কোনো পর্যবেক্ষক- কেউই পূর্বাভাস দেয়নি। প্রত্যেকেই তীব্র যুদ্ধ ও দ্রুত ফলের প্রত্যাশা করছিল। পশ্চিমারা এখন পুতিনের ভুল গণনার পরিবর্তে যুদ্ধ কেন গতিশীল হচ্ছে না তার কারণগুলো খুঁজে বের করার চেষ্টা করছে। রুশদের অক্ষমতা খোঁজার চেয়ে ইউক্রেনীয়দের প্রতিরোধ আরো কার্যকর করার জন্য পশ্চিমাদের ঐক্যের প্রয়োজন ছিল বেশি। এখানে একটি বিষয় সবার মাথায় রাখতে হবে- যদি ইউক্রেন সংকটের সুরাহা হয়, তাহলে ইউরোপের অন্য দেশগুলোকে রাশিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক তৈরির ক্ষেত্রে নতুন কৌশল নিয়ে এগিয়ে আসতে হবে।
সর্বোপরি এই যুদ্ধকে বলা যায় ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনকে কেন্দ্র করে পুরোনো সম্পর্কের ব্যর্থতার ফল। সুতরাং পরিস্থিতি যে খুব তাড়াতাড়ি স্বাভাবিক হবে এমনটা আশা করা ঠিক হবে না। ইউরোপে যাতে স্থায়ী শান্তি পরিস্থিতি বিরাজ করে তার জন্য ভয়াবহ যুদ্ধের পথে না গিয়ে রাশিয়া এবং উদার গণতন্ত্রের মধ্যে একটি সমন্বয় জরুরি।
রাশিয়ায় পশ্চিমাদেশগুলোর ব্যর্থ নীতির স্থলে কি প্রতিস্থাপন করা দরকার সেটাই এখন বিবেচ্য বিষয়। ইউক্রেন সংকটের নিরসন কীভাবে হচ্ছে সেটাও এখানে গুরুত্বপূর্ণ। এই যুদ্ধ যে দীর্ঘ সময় ধরে গভীর অবিশ্বাসের সৃষ্টি করবে সেটা খুবই পরিষ্কার। ২৪ ফেব্রুয়ারির আগে যে স্থিতাবস্থা ছিল সেখানে ফিরে যাওয়া একেবারেই অসম্ভব। রাশিয়া, ইউক্রেন এবং পশ্চিম ইউরোপ আর আগের অবস্থানে নেই। তাই তাদের মধ্যে আগের মতো সম্পর্ক থাকবে এমনটা আশা করা বোকামি।
যুদ্ধাবস্থায় ইউক্রেনের সঙ্গে একাত্মতা এখানে অগ্রাধিকার হওয়া উচিত ছিল। পশ্চিমা নীতিনির্ধারক ও পর্যবেক্ষকরাও এ বিষয়ে একমত পোষণ করেন। ইউক্রেনের দুর্ভোগ ও বীরত্বের গুণগান গাওয়ার চেয়ে সম্পর্ক নিয়ে পশ্চিমাদেশগুলোর সরকার ও বিশ্লেষকদের বৃহৎ পরিসরে চিন্তা করা জরুরি। কারণ, রাশিয়া এই যুদ্ধে ভিন্ন উপায়ে টিকে থাকবে। যুদ্ধ শুরুর আগে বিশ্বায়ন, জাতীয় প্রতিরক্ষা, জলবায়ু সংকট, আন্তর্জাতিক শৃঙ্খলা ও এর অগ্রগতি নিয়ে যেসব ধারণা দেওয়া হয়েছিল সেগুলো এখন অন্যভাবে চিন্তা করতে হচ্ছে।
হ্যাঁ, এটা রাশিয়ার যুদ্ধ। তাই বলে অন্য ইউরোপীয় দেশগুলোকে নিষ্ক্রিয় খেলোয়াড় ভাবা ঠিক হবে না। ব্রিটেনসহ ইউরোপীয় রাষ্ট্রগুলোর ভুল সিদ্ধান্ত পুতিনের বেপরোয়া আচরণকে লালন করতে সাহায্য করেছে। হঠাৎ করে জার্মানীর অবস্থান পরিবর্তন করে প্রতিরক্ষা ব্যয় বৃদ্ধি, নাটকীয়ভাবে গ্যাস লাইন বন্ধ করে দেওয়ার সিদ্ধান্তগুলো যুদ্ধ পূর্ববর্তী বছরগুলোর ভুল অনুমান এবং নীতির ব্যর্থতাকেই তুলে ধরে। একইভাবে রাশিয়ার সম্পদ, জ¦ালানি নিরাপত্তা এবং ক্রীড়া যোগাযোগের ক্ষেত্রে ব্রিটেনের নেওয়া সাম্প্রতিক পদক্ষেপগুলো ছিল অসম্পূর্ণ।
ইউক্রেন ইস্যুতে রাশিয়ার প্রতি সর্বোপরি আরো কঠোর ও বাস্তববাদী দৃষ্টিভঙ্গির প্রয়োজন ছিল। ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং এর প্রধান সদস্য দেশগুলো রক্ষী নামানোর বিষয়ে কখনোই এক ছিল না। ব্রিটেনও তাই করেছে। সংসদীয় বুদ্ধিমত্তা এবং নিরাপত্তা কমিটি ২০১৯-২০ সালে রাশিয়া সম্পর্কে যে প্রতিবেদন দেয়, তাতে গত দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত শত্রু দেশের কার্যকলাপ-বিশেষ করে মস্কো যে ব্রিটিশ নিরাপত্তা পরিষেবার দৃষ্টি আকর্ষণ করেছে তা স্পষ্ট বর্ণিত আছে।
রাশিয়ার সঙ্গে নতুনভাবে দীর্ঘমেয়াদি সম্পর্ক স্থাপন অতো সহজ কাজ নয়। ইউক্রেনে আক্রমণের পেছনে শুধুমাত্র একটি কারণ কাজ করেনি। এর মূল অনেক গভীরে। গণতান্ত্রিক বা আইনের শাসনের প্রথা রাশিয়ায় তেমন বিস্তার লাভ করেনি। গির্জা ছাড়া তাদের অন্য প্রতিষ্ঠানগুলো তুলনামূলকভাবে ভঙুর। পশ্চিম ইউরোপে তাদের এমন কোনো বন্ধু বা অংশীদার নেই যাকে তারা বিশ^াস করে। একইভাবে, ফ্রান্স এবং ইতালি একে-অপরকে বিশ^াস করে এবং কেউ কারো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করে না। কিন্তু মনে রাখতে হবে, রুশরা অন্য গ্রহের বাসিন্দা নয়। দুই শতাব্দিরও বেশি সময় ধরে বৃহত্তম এ অঞ্চলে এটা ছিল এবং আছে।
বিংশ শতাব্দিতে পশ্চিমা উদারপন্থিরা রাশিয়ার জারপন্থিদের প্রতিক্রিয়াশীল এবং স্বৈরাচারের মূর্ত প্রতীক হিসাবে দেখত। ব্রিটেন তার সাম্রাজ্য বিস্তারে রাশিয়াকে শত্রু মনে করত। বিশেষ করে ভারতীয় উপমহাদেশ নিয়ন্ত্রণে রাশিয়া ছিল ব্রিটেনের জন্য হুমকিস্বরূপ। এমনকি চরম রুশ বিরোধীরা ব্রিটেনের সাবেক প্রধানমন্ত্রী লর্ড পালমারস্টনকে রুশ চর বলতেও পিছপা হয়নি। ১৮৫০ সালে কার্ল মার্কস যুক্তি দিয়ে বলেছিলেন, ১৮শতকের গোড়ার দিকে পিটার দ্য গ্রেটের সময় থেকে রাশিয়া বিশ^কে নিয়ন্ত্রণের জন্য পুরোদমে কাজ শুরু করে। ১৯১৭ সালে বলশেভিক বিপ্লবের পর চিরাচরিত সন্দেহ ভিন্ন রূপ পেয়েছিল।
৭০ বছরেরও বেশি সময় ধরে কর্তৃত্ব করা রাশিয়া ১৯৪৫ সালে এসে স্নায়ুযুদ্ধের কঠোর আবরণে পশ্চিমাদের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়। ১৯৯১ সালে সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পর সবকিছুই যেন রাতারাতি পাল্টে যায়। বলতে গেলে, কোনো ধরনের কার্যকর নিয়ম ছাড়াই ইউরোপীয় ইউনিয়ন বিপুল পরিমাণ অর্থ ও সম্পদ ক্রেমলিনে বিনিয়োগ করে। অন্যদিকে নিরাপত্তা বাহিনী জিহাদি সন্ত্রাসবাদে ব্যস্ত হয়ে পড়ে। বিগত ৩০ বছরের নির্বুদ্ধিতা এখন ভোগাচ্ছে পশ্চিমাবিশ^কে। তাই নতুন রূপে সময়োপযোগী একটি নতুন সম্পর্ক তৈরি করতে হবে পশ্চিমাদের। সেক্ষেত্রে তাদের স্নায়ুযুদ্ধ ও বিশ্বায়নের মাঝামাঝি নতুন কোনো পথ খুঁজে নিতে হবে, এটা খুবই গুরুত্বপূর্ণ এবং জরুরি। এটা করতে গিয়ে বরিস জনসনের মতো একজন গুণী প্রধানমন্ত্রীর অধীনে দলটি সম্পূর্ণ ভেঙে যেতে পারে বা বিভক্তির দিকে দ্রুত ধাবিত হতে পারে।
ব্রিটেন-রাশিয়ার দুইশ বছরের সম্পর্ক নিয়ে সম্প্রতি একটি বই প্রকাশিত হয়েছে। বইটি খুবই প্রাসঙ্গিক- (যদিও ২৪ ফেব্রুয়ারির ঘটনাটি ছিল অকস্মাৎ)। লেবার পার্টির সাবেক পররাষ্ট্রমন্ত্রী ডেভিড ওয়েন বইটিতে বেশ কিছু বিষয় নিয়ে আলোকপাত করেন। ওয়েন জোর দিয়ে বলেন, ২০২১ সালের শেষ দিকে আরো সূক্ষ্ম সম্পর্ক সম্ভব ছিল। ২০১৪ সালের যুদ্ধের পর ইউক্রেন ইস্যুকে কম গুরুত্ব দেওয়া এবং এ নিয়ে নীতিনির্ধারণ থেকে বিরত থাকার জন্য তিনি ব্রিটেনের শাসকদের দিকে অভিযোগের আঙুল তোলেন। তিনি বইয়ে একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে উল্লেখ করেন। বলেন, প্রকৃত সত্যি হলো- ব্রিটেন এবং রাশিয়া অনেকটা একে অন্যের মতো এবং উভয়ে সেটা স্বীকার করতেও পছন্দ করে। উনিশ এবং বিশ শতকে উভয় দেশই ছিল প্রায় একই রকম শক্তিশালী। পরিবর্তিত পরিস্থিতির সঙ্গে মানিয়ে নিতে উভয়কেই সংগ্রাম করতে হয়েছে।
তবে এখানে একটি প্রশ্ন গুরুত্বপূর্ণ হয়ে দাঁড়িয়েছে-পশ্চিমারা কি রাশিয়ার সঙ্গে কোনো বিষয়ে একমত হতে পারবে? ইউক্রেন নিয়ে গত দুই সপ্তাহের ঘটনা প্রশ্নটিকে আরো জোরালো করেছে। সত্যি বলতে, প্রশ্ন এবং রাশিয়া- কোনোটাই বিদায় নেবে না। নিরাপত্তা কমিটির প্রতিবেদন পর্যবেক্ষণ করে ফরাসি কূটনৈতিক ট্যালিরান্ড বলেছিল, রাশিয়া সবসময় খুবই শক্তিশালী আবার খুবই দুর্বল একটি দেশ। বর্তমানে তার কথাটিই প্রতিধ্বনিত হচ্ছে। এমন একটি জাতির সঙ্গে কখনোই নিখুঁত সম্পর্ক সম্ভব না।
মোমেনা আক্তার পপি, দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে
মন্তব্য