ইউক্রেনে রুশ আগ্রাসনের তিন সপ্তাহ পার হওয়ার পথে। এখনো এই সংকট নিরসনে কার্যকর কোনো পন্থা বের করতে পারেননি কূটনীতিকরা। রাশিয়া যে ইউক্রেন দখল করতে চায় না তা ইতোমধ্যে একাধিকবার বলেছে মস্কো। তারা চায় ইউক্রেনের জনগণকে বশ্যতা স্বীকার করাতে। এটা করতে গিয়ে তারা অস্ত্র হাতে নিয়েছে। কিন্তু অস্ত্র দিয়ে যে সব সমস্যার সমাধান হয় না সেটা হয়তো মস্কোও বুঝতে পারছে। এ কারণে ইউক্রেনে বিশাল সামরিক বহর পাঠানো সত্ত্বেও আলোচনার পথ উন্মুক্ত রেখেছে ক্রেমলিন। খবর: বিবিসি, সিএনএন ও আলজাজিরার।
সংকট নিরসনে বেলারুশের গোমেলে এর আগে চারবার বৈঠকে বসেন রাশিয়া ও ইউক্রেনের প্রতিনিধিরা। আলোচনা তেমন ফলপ্রসূ না হলেও এটা চালিয়ে যাওয়ার বিষয়ে তারা একমত হন। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল সোমবার পঞ্চম দফা বৈঠকে বসার কথা উভয় দেশের নেতাদের। আগের বৈঠকগুলোতে প্রতিনিধিরা সরাসরি উপস্থিত ছিলেন। কিন্তু সর্বশেষ বৈঠকে প্রতিনিধিদের ভার্চুয়ালি অংশ নেওয়ার কথা। এ ছাড়াও একই দিন ইউক্রেন সংকট নিরসনে তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ও জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলাৎজ বৈঠক করবেন। তুরস্কে এই বৈঠক অনুষ্ঠিত হবে। এর আগে তুরস্কের উদ্যোগে সে দেশের আন্তালিয়া শহরে বৈঠক করেন রুশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী সের্গেই ল্যাভরভ ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী দিমিত্র কুলেবারের মধ্যে বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। রুশ আগ্রাসনের পর এটাই ছিল দেশ দুটির মধ্যে সর্বোচ্চ পর্যায়ের বৈঠক।
এদিকে ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি আবারো রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট ভøাদিমির পুতিনের সঙ্গে সরাসরি বৈঠক করার আগ্রহ প্রকাশ করেছেন। গতকাল তিনি বলেন, পরবর্তী আলোচনার সময় প্রতিনিধিদের অবশ্যই দুই দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে বৈঠকের ব্যাপারে একমত হতে হবে। আমাদের প্রতিনিধিদলকে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, তারা যেন প্রেসিডেন্টদের সঙ্গে বৈঠকের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করে। আমি নিশ্চিত, সবাই এটা প্রত্যাশা করছে। হয়তো এটি জটিল বিষয়, কিন্তু সংকট নিরসনে এটি খুব জরুরি একটি উপায়।
অন্যদিকে ইউক্রেনকে যুদ্ধের ময়দানে একা রেখে পেছন থেকে সরে যাওয়া পশ্চিমা বিশ^ এই সংকটে চীনকে জড়ানোর চেষ্টা করছে। চীনের কাছে রাশিয়া সামরিক সহায়তা চেয়েছে বলে দাবি করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। তবে চীন বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করছে। দেশটির পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অহেতুক গুজব ছড়াচ্ছে। যুদ্ধ চালিয়ে যেতে রাশিয়া আমাদের কাছে সামরিক সরঞ্জাম বা অন্যান্য সহায়তা চায়নি।
ভার্চুয়াল আলোচনায় রাশিয়া-ইউক্রেন
রাশিয়া-ইউক্রেন সংকট সমাধানে গতকাল স্থানীয় সময় সকাল ৮টা ২০ মিনিটে পঞ্চম দফা আলোচনায় বসার কথা দেশ দুটির প্রতিনিধিদের। তবে এর আগে মুখোমুখি বৈঠক হলেও এবার বৈঠক হবে ভার্চুয়ালি। বরাবরের মতো রুশ প্রতিনিধিদলের নেতৃত্বে থাকবেন প্রেসিডেন্ট পুতিনের উপদেষ্টা ভ্লাদিমির মেদিনস্কি। ক্রেমলিনের প্রেস সার্ভিস জানায়, ফ্রান্সের প্রেসিডেন্ট ইমান্যুয়েল ম্যাখোঁ এবং জার্মান চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজের সঙ্গে টেলিফোনে আলোচনার পর প্রেসিডেন্ট পুতিন ইউক্রেনের প্রতিনিধিদের সঙ্গে ভার্চুয়ালি সিরিজ আলোচনায় বসতে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের নির্দেশ দেন।
ইউক্রেনের প্রতিনিধিদলের প্রধান মাইখাইলো পোডোলিয়াকও বৈঠকের বিষয়টি নিশ্চিত করেছেন। সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে পোস্ট করা একটি ভিডিওতে তিনি জানান, রাশিয়া পারস্পরিক সমঝোতার ভিত্তিতে ইতিবাচক সিদ্ধান্ত নিতে শুরু করেছে। রাশিয়া তার চারপাশের বিশ্বকে অনেক বেশি উপলব্ধি করছে। সারাবিশ্ব ইউক্রেনের পক্ষে অবস্থান নিয়েছে এবং তারা কিয়েভের প্রতি অনেক বেশি সংবেদনশীল। তবে আলোচনা শুরুর প্রাক্কালে ইউক্রেনের সেনাবাহিনী দাবি করেছে, নতুন করে হামলা জোরদারের প্রস্তুতি নিচ্ছে রুশ বাহিনী। বিশেষত, রুশ বাহিনীর দখলে থাকা এলাকাগুলোতে নতুন করে হামলার আশঙ্কা করা হচ্ছে।
বৈঠকে বসছেন এরদোগান-শোলৎজ
ইউক্রেন ইস্যুতে গতকাল বৈঠকে বসার কথা তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়্যেপ এরদোগান ও জার্মানির চ্যান্সেলর ওলাফ শোলৎজের। তুরস্কের রাজধানী আঙ্কারায় এই বৈঠক হচ্ছে। ইউক্রেনে রুশ বাহিনীর শুরু হওয়া বিশেষ সামরিক অভিযান পৌঁছেছে ১৯তম দিনে। অভিযান বন্ধ ও ইউক্রেনে স্থায়ী যুদ্ধ বিরতি কার্যকরে করণীয় বিষয়ক আলোচনা এ বৈঠকে প্রধান্য পাচ্ছে। ইউক্রেন নিয়ে আন্তর্জাতিক রাজনীতিতে তুরস্কের অবস্থান শুরু থেকেই বেশ স্বতন্ত্র। কারণ, কৃষ্ণ সাগর অঞ্চলে ইউক্রেন ও রাশিয়া- উভয় দেশের সঙ্গেই সমুদ্র সীমানা আছে তুরস্কের। দেশটি একই সঙ্গে ইউক্রেন ও রাশিয়ার ঘনিষ্ঠ মিত্র হিসেবে পরিচিত।
পাশাপাশি, ন্যাটোর একমাত্র প্রাচ্যদেশীয় সদস্য হচ্ছে তুরস্ক। রাশিয়ার সঙ্গে যুদ্ধবিরতি বিষয়ক আলোচনার স্থান ও ফ্রেমওয়ার্ক নির্মাণে তুরস্ক ও ইসরায়েলের সঙ্গে যৌথভাবে কাজ করছে বলে রোববার জানিয়েছেন ইউক্রেনের কর্মকর্তারা। জার্মানির চ্যান্সেলর পদে আসীন হওয়ার পর এই প্রথমবার আঙ্কারায় যাচ্ছেন ওলাফ শোলৎজ। ইউক্রেন ছাড়াও দ্বিপাক্ষিক সম্পর্ক ও ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) বিষয়ে দুই নেতা আলোচনা করবেন। প্রসঙ্গত, ২০০৫ সাল থেকে ইইউ সদস্যপদের জন্য চেষ্টা করে যাচ্ছে তুরস্ক। এক্ষেত্রে তাদের প্রধান ভরসার দেশ জার্মানি। দেশটির সাবেক চ্যান্সেলর এঙ্গেলা মের্কেলও একাধিকবার তুরস্ককে সহযোগিতার আশ্বাস দিয়েছিলেন।
যুক্তরাষ্ট্রের দাবি প্রত্যাখ্যান চীনের
যুক্তরাষ্ট্র দাবি করেছে, ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের কাছে সামরিক সহায়তা চেয়েছে রাশিয়া। তবে বিষয়টি প্রত্যাখ্যান করছে চীন। চীনের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ঝাও লিজিয়ান বলেন, যুক্তরাষ্ট্র অহেতুক গুজব ছড়াচ্ছে। রাশিয়া আমাদের কাছ থেকে সামরিক সরঞ্জাম বা অন্যান্য সহায়তা চায়নি। ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের বিরুদ্ধে অশুভ উদ্দেশ্য নিয়ে মিথ্যা তথ্য প্রচার করেছে যুক্তরাষ্ট্র। ইউক্রেন ইস্যুতে চীনের অবস্থান বেশ স্পষ্ট। শান্তি প্রতিষ্ঠায় গঠনমূলক কাজ করতে আমরা আগ্রহী। কূটনৈতিকভাবে বিষয়টির সমাধান চাই আমরা।
এসময় আগুনে ঘি না ঢেলে সব পক্ষকেই শান্ত করতে চেষ্টা করার আহ্বানও জানান তিনি। যদিও রাশিয়া কি ধরনের সরঞ্জাম চেয়েছে সে সম্পর্কে কিছু জানাতে অস্বীকার করেছেন যুক্তরাষ্ট্রের কর্মকর্তারা। ইউক্রেন সংকটের শুরু থেকেই বেইজিং দীর্ঘদিনের মিত্র মস্কোর প্রতি জোরালো সমর্থন প্রকাশ করেছে। কিন্তু কোনো সামরিক বা অর্থনৈতিক সহায়তা দিয়েছে এমন তথ্য জানা যায়নি। রোববার এনবিসিকে যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা উপদেষ্টা জ্যাক সুলিভান বলেন, চীন বা অন্য কোনো দেশ যাতে রাশিয়াকে তার অর্থনৈতিক ক্ষতির জন্য ক্ষতিপূরণ দিতে না পারে তা নিশ্চিত করবে ওয়াশিংটন।
প্রেসিডেন্ট পর্যায়ের বৈঠক জরুরি: জেলেনস্কি
ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কি বলেছেন, ইউক্রেন ও রাশিয়ার প্রতিনিধিদের অবশ্যই দুই দেশের প্রেসিডেন্টের মধ্যে বৈঠকের ব্যাপারে একমত হতে হবে। আমাদের প্রতিনিধিদলকে সুস্পষ্টভাবে বলা আছে, তারা যেন প্রেসিডেন্টদের মধ্যে বৈঠকের জন্য সম্ভাব্য সবকিছু করে। আমি নিশ্চিত, সবাই এটা চায়। বিষয়টি বেশ জটিল হলেও সংকট নিরসনে তা খুব জরুরি। ইউক্রেন যেন প্রত্যাশা অনুযায়ী ফল পায় তার জন্য চলমান এ লড়াইয়ের মধ্যে কঠিন এ আলোচনা প্রক্রিয়া চালিয়ে যাচ্ছে। শান্তি, নিরাপত্তা এবং স্বাভাবিক জীবনযাপন নিশ্চয়তার জন্য তা জরুরি। এ পর্যন্ত বেলারুশে দুই পক্ষের মধ্যে কয়েক দফা বৈঠক হয়েছে। এসব বৈঠকে মূলত মানবিক বিষয়গুলোই প্রাধান্য পেয়েছে। যুদ্ধকবলিত শহরগুলো থেকে কিছু বেসামরিককে সরে যাওয়ার পথ করে দিয়েছে। তবে এসব আলোচনায় কিছু ইতিবাচক পরিবর্তন ঘটেছে বলে মন্তব্য করেছেন পুতিন।
শান্তিরক্ষী চায় না মস্কো
প্রায় তিন সপ্তাহ ধরে ইউক্রেনে সামরিক অভিযান চালাচ্ছে রাশিয়া। রুশ বাহিনীর জোরদার হামলার কারণে কয়েক দিনের মধ্যেই ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছে পূর্ব ইউরোপের এই দেশটি। রাজধানী কিয়েভসহ অনেক এলাকায় ইউক্রেনীয় যোদ্ধাদের শক্ত প্রতিরোধের মুখে পড়েছে রুশ সেনারা। এমন পরিস্থিতিতে জাতিসংঘের অধীনে ইউক্রেনে শান্তিরক্ষী পাঠানোর কোনো প্রয়োজন দেখছে না মস্কো।
রুশ বার্তা সংস্থা আরআইএ জানিয়েছে, রাশিয়ার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের আন্তর্জাতিক সংস্থা বিভাগের পরিচালক পিয়োটর ইলিয়েচেভ বলেন, (ইউক্রেন) আমাদের নিয়ন্ত্রণে থাকায় সেখানে শান্তিরক্ষীর প্রয়োজন নেই। এদিকে কিয়েভের একটি আবাসিক ভবনে গোলাবর্ষণ করেছে রুশ বাহিনী। এতে একজন নিহত এবং আরো ৩ জন আহত হয়েছেন।
তবে ইউক্রেনের স্টেট ইমার্জেন্সি সার্ভিস বলছে, গতকাল সোমবার সকালে স্থানীয় সময় ৭টা ৪০ মিনিটে চালানো হামলার পর দুটি মৃতদেহ উদ্ধার করা হয়েছে। এ ছাড়া তিনজনকে হাসপাতালে নেওয়া হয়েছে। কিয়েভের ওই আবাসিক ভবনে হামলার পরের কিছু ছবি প্রকাশ করেছে ইমার্জেন্সি সার্ভিস। ছবিতে ৯তলাবিশিষ্ট ভবন থেকে ধোঁয়ার কুণ্ডলী উঠতে দেখা যায়। আটকে পড়াদের উদ্ধারে জরুরি সেবা কর্মীদের মই ব্যবহার করতেও দেখা যায়।
মন্তব্য