কূটনীতিক এবং বিশ্লেষকদের মতে, এটা ঠিক যে ইউক্রেনে অপ্রত্যাশিত বাধার মুখে পড়েছে রাশিয়া। দেশটিকে বশ্যতা স্বীকার করাতে রাশিয়া দিন দিন কঠোর থেকে কঠোরতর হচ্ছে। কিয়েভের মেয়র ভিটালি ক্লিটসকো বলেছেন, রাজধানীতে এক থেকে দুই সপ্তাহ পর্যন্ত চলার মতো সরবরাহ আছে। যদি হামলা হয়, পরিস্থিতি বেশ খারাপ হবে। ইতোমধ্যে অর্ধেক মানুষ কিয়েভ ছেড়ে গেছে। পশ্চিমা জোট চাইলেও আর হয়তো ইউক্রেনকে রক্ষা করতে পারবে না। কারণ সময় ফুরিয়ে আসছে।
বিশ্লেষকদের মতে, সামরিক এবং অর্থনৈতিক দিক থেকে পুতিনের ওপর সর্বোচ্চ চাপ প্রয়োগ করতে হবে পশ্চিমাদের, এবং এটা জরুরি। সর্বাত্মক সহযোগিতা ছাড়া ইউক্রেনের জনগণ ও সৈন্যদের পক্ষে খুব বেশি দিন রুশ বাহিনীকে প্রতিহত করা সম্ভব না। ভবিষ্যতে ইউক্রেন একটি স্বাধীন গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র থাকবে কি না সেটা আগামী কয়েক দিনের মধ্যেই বোঝা যাবে। পরিস্থিতি দেখে মনে হচ্ছে, খোদ রাশিয়াও ভবিষ্যতে পুতিনবাদকে লালন করবে।
২০ বছরেরও বেশি সময় ধরে অত্যাচারী ও দুর্নীতিগ্রস্ত শাসনব্যবস্থার মাধ্যমে মস্কো সে দেশের জনজীবনকে বিধ্বস্ত করার পাশাপাশি সারাবিশ্বে ভীতি ও বিরোধ ছড়িয়ে দিয়েছে। এটি একটি রাক্ষুসে মুহূর্ত। ইউরোপের ভবিষ্যৎ নিরাপত্তা কৌশল পুনর্নির্মাণ করতে হতে পারে- যেমনটা রাশিয়া প্রায়ই বলে। যদি এমনটা হয় তাহলে তা হবে পুতিন-পরবর্তী আমলে সহযোগিতামূলক, আইনসম্মত, গণতান্ত্রিক সহাবস্থানের ভিত্তিতে- সন্ত্রাসের সঙ্গে ভারসাম্য বজায় রেখে নয়।
পরমাণু ক্ষমতাধর এই স্বৈরশাসকের সঙ্গে যদি উত্তেজনাপূর্ণ ভারসাম্য বজায় রাখা হয় তাহলে সর্বাত্মক সংঘর্ষ ছড়িয়ে পড়ার ঝুঁকি থাকে। ভুল হিসাব ঝড়ের বেগে আঘাত হানতে পারে। পশ্চিম ইউক্রেনে জাতিসংঘের নির্দেশিত নিরাপদ জোন বা ইউক্রেনের প্রেসিডেন্ট ভলোদিমির জেলেনস্কির অনুরোধ সত্ত্বেও নো ফ্লাইজোন না করার মতো ভুল সিদ্ধান্ত নিয়েছে ন্যাটো। এ ধরনের সিদ্ধান্তগুলো সত্যিই ভয়ানক।
ইউক্রেন ইস্যুতে তিনটি দৃশ্যের অবতারণ হতে পারে: আপসে শান্তি চুক্তি, অচলাবস্থা বা একটি ক্রমবর্ধমান যুদ্ধকে আরো প্রশস্ত করা। যুদ্ধের দুই সপ্তাহ পর থেকে আলোচনা জোরদার হলেও প্রকৃতপক্ষে শান্তি প্রক্রিয়ার কোনো অগ্রগতি হয়নি। সংকট নিরসনে চীন উদ্যোগী হবে আশা করলেও দেশটি নিরাপদ দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে। গত সপ্তাহে তুরস্কের উদ্যোগে রাশিয়া ও ইউক্রেনের পররাষ্ট্রমন্ত্রীদের বৈঠক ছিল মস্কোর সুচিন্তিত পদক্ষেপ। কারণ, স্থায়ী শান্তি প্রক্রিয়া থেকে দুই পক্ষই এখনো যোজন যোজন দূরে অবস্থান করছে।
একের পর এক শহর অবরুদ্ধ করা, দেশটির বিস্তীর্ণ অংশ দখল এবং যুদ্ধাপরাধ বাড়তে থাকা সত্ত্বেও ইউক্রেনের নেতারা স্থায়ী কোনো সমাধানে আসতে রাজি হবেন না বলেই মনে হচ্ছে। অন্যদিকে পুতিনও ন্যাটো বা ইউরোপীয় ইউনিয়ন থেকে ইউক্রেনকে দূরে রাখার জেদ বা ক্রিমিয়া এবং সম্প্রতি দক্ষিণে সমুদ্র তীর দখলকৃত অঞ্চলের দাবি ছেড়ে দেবেন, এমন কোনো সম্ভাবনা দেখা যাচ্ছে না।
দ্বিতীয় দৃশ্য হতে পারে এমন- যুদ্ধকে টেনে ডনবাসের মতো অচলাবস্থা বা জমাট দ্বন্দ্বে পরিণত করা। এটাতে কেউই খাপ খাওয়াতে পারবে না। এটি ইউক্রেনের জনগণের জন্য বিপর্যয়কর হবে। যারা এখনো ইউক্রেনে রয়ে গেছে তারাও বাস্তচ্যুত হবে। ইউক্রেনের অখণ্ডতার জন্য রুশ বাহিনীকে মোকবিলায় দৃঢ়প্রতিজ্ঞরাও হতাশায় নিমজ্জিত হবে। আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও স্থিতিশীলতা নষ্ট হবে। ইউক্রেন উত্তেজনা অবিরাম মেরুকরণের দিকে ধাবিত হবে যা সারাবিশ্বে ক্ষতিকর প্রভাব ফেলবে।
তৃতীয় দৃশ্যটির অবতারণা করতে পারে খোদ পুতিন। সামরিক বাহিনী দিগুণ, শহরগুলো ঘেরাও করে, ক্ষুধার্তের সংখ্যা বাড়িয়ে, বেসামরিকদের জিম্মি এবং আরো অঞ্চল দখল করে একটি যুদ্ধকে বিস্তৃত করতে পারে- যেখানে রাসায়নিক এমনকি পরমাণু অস্ত্রের ব্যবহারের আশঙ্কাকে উড়িয়ে দেওয়া যায় না। পশ্চিমাদের দ্বিধাদ্বন্দ্বের মূল কারণ এটাই। যুক্তরাষ্ট্র এবং ব্রিটেন অনবরত ইউক্রেনকে উস্কে যাচ্ছে এবং অস্ত্রশস্ত্র সরবরাহের পরিমাণ ক্রমশ বাড়াচ্ছে। ব্রিটিশ এন্টি মিসাইলগুলো মারাত্মক প্রাণঘাতী তা ইতোমধ্যে প্রমাণিত। বর্তমানে স্টারস্ট্রিকের মতো বিমান বিধ্বংসী অস্ত্রও মোতায়েন করা হচ্ছে- যদিও তা প্রতিরক্ষার জন্য, আক্রমণের উদ্দেশ্য নয় বলে দাবি ইউক্রেনের।
পশ্চিমারা যতই শাক দিয়ে মাছ ঢাকার চেষ্টা করুক না কেন, ন্যাটোর নো ফ্লাই জোন প্রত্যাখ্যান বা ইউক্রেনের বিমানবাহিনীকে পোল্যান্ডের মিগ জঙ্গি বিমান সরবরাহে যুক্তরাষ্ট্রের বিরোধিতার মধ্যদিয়ে মিত্ররা যে প্রকৃতপক্ষে এই সংঘাতের অংশীদার হয়ে উঠেছে বা আইনি ভাষায় বলা যায় সহযোদ্ধা তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না।
মস্কোর ওপর পশ্চিমাদের একের পর এক নিষেধাজ্ঞাকে পুতিন অর্থনৈতিক যুদ্ধ হিসাবে বর্ণনা করেছেন। রাশিয়া পশ্চিমাদের সামরিক আক্রমণের অধীনে রয়েছে-তিনি যে কোনো মুহূর্তে এমন ঘোষণা দিতে পারে-যা যুদ্ধের গতিকে আরো ত্বরান্বিত করবে। বাল্টিক প্রজাতন্ত্র নামে পরিচিত সাবেক সোভিয়েতের অংশ- এস্তেনিয়া, লাটভিয়া এবং লুথানিয়াকে যে ইউক্রেনের মতোই স্বাধীন-সার্ভভৌম দেশ বলে পুতিন স্বীকার করে না এটা সর্বজনবিদিত। রুশ ছিটমহল কালিনিনগ্রাদও তেমনই আরেকটি উন্মুক্ত প্রান্তর।
লাটভিয়ার সাবেক প্রধানমন্ত্রী ভালদিস গত সপ্তাহে সতর্ক করে বলেছেন, পুতিনের পরবর্তী লক্ষ্য হতে পারে বাল্টিক দেশগুলো। আমরা যদি কিয়েভকে সমর্থন নাও করি তাহলে এই অভিযান ইউক্রেনেই সীমাবদ্ধ থাকবে না। দুর্ভাগ্যবশত বলতে পারি, এই আগ্রাসন সম্ভবত অন্যান্য দেশেও চলবে।
পুতিনের পরমাণু অস্ত্র অবগুণ্ঠনের হুঁশিয়ারি নিয়ে ইউরোপীয় ইউনিয়ন কমিশনের ভাইস প্রেসিডেন্ট বলেছিলেন, পশ্চিমাদের ভয় পাওয়া ঠিক হবে না। এখানে প্রশ্ন হচ্ছে- আমরা এই হুমকিতে কতটা নতজানু হয়ে পড়ছি। কারণ সবকিছুর বিরুদ্ধে সবসময় পরমাণু হুমকি দেওয়াটা এখন স্বভাবে পরিণত হয়েছে।
সোজা কথা বলা যায়, এই বিভীষিকা থেকে বের হওয়ার ঝুঁকিমুক্ত কোনো পথ নেই। এই যুুদ্ধ ইউরোপীয় গণতন্ত্রকে ধ্বংস করে দিতে পারে বা রুশ আগ্রাসনের বিজয় হতে পারে। কিন্তু কোনোটাই টেকসই হবে না। এটা কেবল শোকের মাত্রা বাড়াবে। তাই, ইউক্রেনে রাশিয়ার লাগাম টানতে, গণহত্যা বন্ধ এবং পুতিনের মারাত্মক সংক্রামক সংক্রমণ বন্ধ করতে পশ্চিমাদের ঐক্যবদ্ধ হয়ে সর্বশক্তি প্রয়োগ করতে হবে। প্রয়োজনে সামরিক পথে হাঁটতে হবে।
মোমেনা আক্তার পপি; দ্য গার্ডিয়ান অবলম্বনে
মন্তব্য