আমেরিকা, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও ভারতকে নিয়ে গঠিত 'কোয়াড' স্ট্র্যাটেজিক জোটে ভারত ক্রমশ একঘরে হয়ে পড়ছে বলে ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। ইউক্রেন যুদ্ধে ভারতের অবস্থানের কারণেই এ প্রশ্নটি তৈরি হয়েছে। বিবিসি বাংলার দিল্লি প্রতিনিধি দেশটির বিভিন্ন পক্ষের সঙ্গে কথা বলে প্রতিবেদনটি করেছেন।
এতে বলা হয়েছে, কোয়াডের বাকি তিন দেশ রাশিয়ার সামরিক অভিযানের কঠোর নিন্দা জানালেও ভারত সরকার এখনও একবারের জন্যও প্রেসিডেন্ট পুতিনের কোনও সমালোচনা করেনি।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন গত সোমবার ইউক্রেন প্রশ্নে ভারতের এই অবস্থানকে দুর্বল ('শেকি') বলেও অভিহিত করেছেন।
ওয়াশিংটনে একটি সভায় ভাষণ দিতে গিয়ে প্রেসিডেন্ট বাইডেন কোনও রাখঢাক না-করেই বলেন, ‘পুতিনের আগ্রাসন মোকাবিলায় কোয়াড খুব কঠোর অবস্থান নিয়েছে - যেমন জাপান, তেমনি অস্ট্রেলিয়াও। তবে এখানে একমাত্র ব্যতিক্রম হল ভারত, কোনও কোনও ক্ষেত্রে তাদের ভূমিকাকে দুর্বলই বলতে হবে।’
এর আগে মাত্র আটচল্লিশ ঘণ্টার মধ্যে জাপান ও অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে ভারতের পৃথক দুটি দ্বিপাক্ষিক বৈঠকেও কোয়াড জোটের ভেতরে এই মতপার্থক্য সামনে চলে আসে।
তবে পর্যবেক্ষকদের অনেকেই বলছেন, এরপরেও কোয়াড হয়তো টিকে যেতে পারে। এর কারণ ভূরাজনীতিতে এই জোটটির মূল উদ্দেশ্য ভিন্ন।
বস্তুত, ২০০৪ সালের সুনামির পর ইন্দো-প্যাসিফিক, অর্থাৎ ভারত মহাসাগর ও প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে ভারত, জাপান, অস্ট্রেলিয়া ও আমেরিকা মিলে যে সমন্বিত ত্রাণ ও উদ্ধার অভিযান চালিয়েছিল ‘কোয়াড’জোটটির ভাবনা তখন থেকেই শুরু।
জোটটি যখন আনুষ্ঠানিকভাবে গঠিত হয়, তখন অবশ্য তার অঘোষিত উদ্দেশ্য ছিল ইন্দো-প্যাসিফিকে চীনকে প্রতিহত করা।
প্রকাশ্যে কোয়াডের নেতারা অবশ্য এটিকে প্রধানত একটি অর্থনৈতিক জোট হিসেবেই বর্ণনা করে এসেছেন, যদিও শরিক দেশগুলো এখন 'মালাবার এক্সারসাইজ' নামে নিয়মিত যৌথ সামরিক মহড়াতেও অংশ নিচ্ছে।
তিন শরিক সোচ্চার, ভারতের ভিন্ন সুর
২০২১-র সেপ্টেম্বরে কোয়াড নেতারা প্রথমবারের মতো সশরীরে কোনও বৈঠকে মিলিতও হয়েছেন, তবে গত দেড়-দুমাসে ইউক্রেন সঙ্কটকে ঘিরে কোয়াডের সেই তাল যেন কিছুটা কেটে গেছে।
সোমবার অস্ট্রেলিয়ার প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসনের সঙ্গে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির বৈঠকের পর ভারতের পররাষ্ট্রসচিব হর্ষবর্ধন শ্রিংলাও কার্যত স্বীকার করে নিয়েছেন, ইউক্রেন ইস্যুতে দুই দেশের মতপার্থক্য আছেই। তবে ইন্দো-প্যাসিফিকে তার প্রভাব পড়তে না-দেওয়াটাই কোয়াডের অভিপ্রায়।
শ্রিংলা আরও বলেন, ‘ভারতকে যে নিজস্ব পরিস্থিতির বিবেচনাতেই ইউক্রেন ইস্যুতে অবস্থান নিতে হয়েছে, স্কট মরিসন সেটা বুঝেছেন।’
এর আগে গত শনিবার সন্ধ্যায় দিল্লিতে নরেন্দ্র মোদির পাশে দাঁড়িয়ে জাপানের প্রধানমন্ত্রী ফুমিও কিশিদাও বলে গেছেন, ‘রাশিয়ার অভিযান আন্তর্জাতিক বিশ্বে সম্পর্ক-শৃঙ্খলা-রীতিনীতির ভিতটাই নড়িয়ে দিয়েছে - আরও কঠোর ভঙ্গিতে এর নিন্দা করা প্রয়োজন।’
মোদি অবশ্য এরপরও রাশিয়ার সমালোচনা করে একটি শব্দও বলেননি, বরং তার সরকার ইতোমধ্যে রাশিয়া থেকে বেশ সস্তায় অন্তত ৫০ লাখ ব্যারেল তেল কেনার সমঝোতা করে ফেলেছে।
'মতের অমিল থাকলেও কোয়াড টিকবে'
তবে ভারতের দিল্লির এক সিনিয়র কূটনৈতিক বিশ্লেষক সুহাসিনী হায়দার দাবি করেছেন, কোয়াডের শরিকদের মধ্যে বহু মতপার্থক্য থাকলেও এই জোটের ভবিষ্যৎ আছে।
তিনি বলেন, ‘মনে রাখতে হবে এই জোটের দুটি দেশ- জাপান ও অস্ট্রেলিয়া হল আমেরিকার বহু পুরনো সঙ্গী, অ্যালাই। ইউক্রেন প্রশ্নে তারা যে কঠোর অবস্থান নিয়েছে, আমেরিকার নতুন মিত্র ভারতের ততটা নেওয়ার কোনও দায় নেই।’
এই কূটনীতিক বলেন, দক্ষিণ চায়না সাগরে শান্তি বজায় রাখতে কোয়াডের বিবৃতিগুলো দেখলে বোঝা যাবে তাতে একবারও সরাসরি চীনের নাম করা হয়নি। কিন্তু, জাপান বা অস্ট্রেলিয়ার সঙ্গে আমেরিকা যে দ্বিপাক্ষিক বিবৃতিগুলো দিয়েছে, তাতে কিন্তু সব সময় চীনের নাম করেই হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে।’
কিংবা, ‘মিয়ানমারে সামরিক জুনটা-র ওপর অবরোধ আরোপের ক্ষেত্রেও ভারত বাকি তিন কোয়াড শরিকের সঙ্গে একমত নয়,’ বলেন তিনি।
মন্তব্য