-->
শিরোনাম

অনাস্থা প্রস্তাব পাস, পাকিস্তানে ক্ষমতা হারালেন ইমরান খান

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
অনাস্থা প্রস্তাব পাস, পাকিস্তানে ক্ষমতা হারালেন ইমরান খান
পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান

চরম নাটকীয়তা শেষে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব সংখ্যাগরিষ্ঠ ভোটে পাস হয়েছে। অনাস্থা প্রমাণের জন্য ১৭২ ভোটের দরকার হলেও জাতীয় পরিষদে এ প্রস্তাবের ওপরে ১৭৪টি ভোট পড়ে।

শনিবার (৯ এপ্রিল) মধ্যরাত পেরিয়ে যাওয়ার পর এ প্রক্রিয়া শুরু হয়। শেষ হয় পাকিস্তান সময় রাত পৌনে ১টায় (বাংলাদেশ সময় রাত সোয়া দুইটায়।)

এর আগে জাতীয় পরিষদের স্পিকার আসাদ কায়সার পদত্যাগ করেন। বিরোধীদের ক্রমাগত দাবি সত্ত্বেও দিনভর অনাস্থা ভোট ঠেকিয়ে রাখার চেষ্টা চালান তিনি। তবে মধ্যরাতেও একই দাবির মুখে তিনি বলেন, বিদেশি ষড়যন্ত্রে প্রধানমন্ত্রীকে ক্ষমতাচ্যুত করার কাজের অংশ হতে চান না তিনি।

এরপর স্পিকার হিসেবে প্যানেল চেয়ারম্যান পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) এর জাতীয় পরিষদ সদস্য আয়াজ সাদিককে ভোট সেশন পরিচালনার আহ্বান জানান তিনি।

তবে এর আগে স্পিকার আসাদ কায়সার বলেন, সরকারের তরফ থেকে তার হাতে গুরুত্বপূর্ণ নথি হাতে এসে পৌঁছেছে। এই নথি তিনি বিরোধীদলীয় নেতা এবং প্রধান বিচারপতিকে দেখাতে চান।

তার পদত্যাগ ও দায়িত্ব হস্তান্তরের সঙ্গে সঙ্গে বিরোধীদলগুলোর দাবির ষোলকলা পূর্ণ হয়ে যায়।  আয়াজ সাদিক দায়িত্ব নিয়ে স্পিকারের দায়িত্বশীলতার প্রশংসা করেন। এরপর ভোট প্রক্রিয়া শুরু করেন।

তিনি বেল বাজানোর নির্দেশ দেন এবং জাতীয় পরিষদের সদস্যদের এর মাধ্যমে অবহিত করেন যে পাঁচ মিনিটের মধ্যে ভোট প্রক্রিয়া শুরু হতে যাচ্ছে। এরপরই জাতীয় পরিষদে প্রবেশের দরজা বন্ধ হয়ে যাবে। তবে ভোট প্রক্রিয়া যখন শুরু হয় তখন পাকিস্তান সময় রাত ১১টা ৫৮ মিনিট।  এরপর তিনি পরিষদ সদস্যদের উদ্দেশে বলেন, যারা এই অনাস্থা প্রস্তাবকে সমর্থন করেন তারা যেন তার বাম পাশের দরজা দিয়ে বের হয়ে যান।

এরপর স্পিকারের দায়িত্বপ্রাপ্ত সাদিক চার মিনিটের জন্য অধিবেশন মুলতবি ঘোষণা করেন। এর কারণ হচ্ছে একটি সেশন মধ্যরাত অতিক্রম করা যাবে না এমন সাংবিধানিক বাধ্যবাধকতা।

ঠিক চার মিনিট পর আবার জাতীয় পরিষদে নতুন অধিবেশন শুরু হয়। সে অধিবেশনে অনাস্থা প্রস্তাবের ওপর ভোট শুরু হলে পক্ষে ১৭৪ ভোট পড়ে। স্পিকারের দায়িত্বে থাকায় মুসলিম লিগ (নওয়াজ) এর আয়াজ সাদিক ভোট দেননি বলে এক টুইটে জানিয়েছেন, দলটির একজন নারী আইন প্রণেতা মরিয়ম আওরঙ্গজেব।

এদিকে, ভোট গণনার সঙ্গে সঙ্গে প্রধানমন্ত্রী ইমরান খানের বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব জাতীয় পরিষদে গৃহীত হয়। স্পিকার এ বিষয়ে রুলিং দেন।

এর মাধ্যমে পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে ইমরান খানকে অপসারণ করল জাতীয় পরিষদ। পাকিস্তানের ইতিহাসে অনাস্থা ভোটে হারা প্রথম প্রধানমন্ত্রী তিনি। তবে দেশটি স্বাধীনতা লাভের পর কোনো প্রধানমন্ত্রী পাঁচ বছরের নির্ধারিত মেয়াদ পার করতে পারেননি, পারলেন না ইমরান খানও।

উল্লেখ্য, পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদে ৩৪২ আসন থাকায় সরকার গঠন কিংবা সরকারের বিরুদ্ধে অনাস্থা আনার জন্য ১৭২ ভোটের প্রয়োজন পড়ে। অনাস্থার পক্ষে বিরোধীরা ১৭৪ ভোট দেওয়ায় ইমরান খানের পক্ষে পরিষদে আর প্রমাণের কিছুই অবশিষ্ট থাকেল না।

তবে ইমরান খানের দল পাকিস্তান তেহরিক-ই-ইনসাফ (পিটিআই) জানিয়েছে, গত ৩ এপ্রিল ডেপুটি স্পিকারের দেওয়া রুলিংয়ের ওপরে সর্বোচ্চ আদালত যে রায় দিয়েছে তার বিরুদ্ধে তারা আপিল করবে। শনিবার বিকালে এজন্য চেষ্টা করা হলে রমজানের কারণে অফিস আগেই বন্ধ হয়ে যাওয়ায় তাদের আবেদন গ্রহণে অস্বীকৃতি জানায় আদালত। পিটিআই নেতারা তখন জানান, তারা সোমবার এ বিষয়ে আপিল করবেন।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার দেশটির সর্বোচ্চ আদালতের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ এক অভূতপূর্ব রায় দিয়ে প্রেসিডেন্টের ভেঙে দেওয়া জাতীয় পরিষদ পুনর্বহাল করে। সে রায় অনুযায়ী শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হয়। অধিবেশনে কোরআন তেলাওয়াত, জাতীয় সংগীত বাজানো, শোক প্রস্তাবের পর চতুর্থ এজেন্ডা ছিল অনাস্তা প্রস্তাবের ওপর ভোট গ্রহণ। তবে শোক প্রস্তাবের পর রীতি অনুযায়ী অধিবেশন মূলতবি করা হলে নাটকীয়তা শুরু ও দিনভর চলতেই থাকে। 

অধিবেশন প্রথমবার মুলতবি ঘোষণার পর স্পিকার সরকারি দল ও বিরোধীদলের শীর্ষ কয়েকজন নেতাকে তার কক্ষে ডেকে অপ্রকাশ্যে মীমাংসার চেষ্টা চালানোর আগেই বিরোধী নেতারা সুপ্রিম কোর্টের নির্দেশনার আলোকেই ভোটের প্রক্রিয়া দাবি করেন। ফলে স্পিকারের উদ্যোগ প্রথম চেষ্টাতেই ভেস্তে যায়।

এদিকে, গত ৮ মার্চ বিরোধীরা প্রথম অনাস্থা প্রস্তাব আনার পর জোটসঙ্গীদের হারিয়ে ফেলায় সরকারি দল আগে থেকেই জানতো জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা প্রমাণে তারা ব্যর্থ হবে। ফলে ভোটাভুটির দিনে জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে একবারও আসেননি প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

প্রসঙ্গত ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে গত ৮ মার্চ দেশটির বিরোধীদলগুলো অনাস্থা প্রস্তাব আনে। একইদিনে তার জোট সঙ্গীরা পক্ষ ত্যাগ করে। এ বিষয়ে জাতীয় পরিষদে সংখ্যাগরিষ্ঠতা যাচাইয়ের মুখোমুখি হন ইমরান খান। তবে তিনি জাতির উদ্দেশে ভাষণ দিয়ে পুরো বিষয়টিকে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ এবং দেশের ‘সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাত’ হিসেবে দেখানোর চেষ্টা করেন। গত ৩ এপ্রিল দেশটির জাতীয় পরিষদে অনাস্থা ভোট হওয়ার কথা ছিল। কিন্তু সেদিন সরকারি দলের বক্তব্যকে সমর্থন করে ডেপুটি স্পিকার কাসেম সুরি দেশটির সংবিধানের ৫ নম্বর ধারায় বর্ণিত দেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি অবিচল থাকার বিষয়টি সামনে টেনে এনে রুলিং দেন এবং ইমরান খান সরকারের ওপর আনা অনাস্থা প্রস্তাব বাতিল করে দেন। এর পরপরই প্রেসিডেন্টের কাছে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেওয়ার পরামর্শ দেন প্রধানমন্ত্রী ইমরান খান।

সাংবিধানক বাধ্যবাধকতায় প্রধানমন্ত্রীর আহ্বানে সাড়া দিয়ে জাতীয় পরিষদ ভেঙে দেন দেশটির প্রেসিডেন্ট আরিফ আলভি। এরপর নতুন তত্ত্বাবধায়ক প্রধানমন্ত্রী নির্ধারণে সরকার ও বিরোধীদলের প্রতি আহ্বান জানান তিনি। তবে পাকিস্তানের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এসময় ঘোলাটে হয়ে ওঠে। প্রধান বিচারপতি নিজেই সুপ্রিম কোর্টে সুয়োমোটো রুল জারি করেন। অন্যদিকে, বিরোধীরা অভিযোগ আনে, প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশে ডেপুটি স্পিকার অসাংবিধানিকভাবে অনাস্থা ভোট বাতিল করেছেন। এরপর বিষয়টি নিয়ে তারাও আদালতের দ্বারস্থ হন।

সর্বোচ্চ আদালত আবেদনটি গ্রহণ করে এবং রুলের ওপর শুনানি শেষে গত বৃহস্পতিবার সর্বসম্মতভাবে ডেপুটি স্পিকারের দেওয়া রুলিং অবৈধ ঘোষণা করে রায় দেন। সুপ্রিম কোর্টের পূর্ণাঙ্গ বেঞ্চ সর্বসম্মতভাবে জাতীয় পরিষদ পুনর্গঠন, সরকারকে বৈধতা দেওয়াসহ জাতীয় পরিষদে ইমরান খানের সরকারের বিরুদ্ধে বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব যাচাইয়ের নির্দেশ দেন। শনিবার সকাল সাড়ে ১০টায় এ প্রক্রিয়া শুরুর আদেশও দেওয়া হয়।

আদালতের আদেশ অনুযায়ী এদিন অধিবেশন শুরু হলেও সরকারি দল থেকে নির্বাচিত স্পিকার নানাভাবে গড়িমসি করে সময় ক্ষেপণের চেষ্টা চালান। তিনি সরকারি দলের পররাষ্ট্রমন্ত্রী ও মানবাধিকার বিষয়কমন্ত্রীকে ফ্লোর দিয়ে দীর্ঘ ভাষণ দেওয়ার সুযোগ দেন। পরে সুযোগ পেয়ে বিরোধীদলের নেতা পিপিপি প্রধান বিলওয়াল ভুট্টো-জারদারি, তার বাবা আসিফ আলি জারদারি, পাকিস্তান মুসলিম লিগ (নওয়াজ) প্রধান ও বিরোধীদলীয় নেতা শেহবাজ শেরিফসহ অন্য দলগুলোর প্রধান নেতারা সরকারপক্ষের আনা ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ ও ‘সার্বভৌমত্বের ওপর আঘাতের‘ যে দাবি সরকার পক্ষ করে যাচ্ছে সেগুলোকে চ্যালেঞ্জ করেন। তারা বলেন, সরকার মুখে মুখে এসব দাবির কথা বললেও কোনো প্রমাণ দেখাতে পারেনি। তাদের অনেকেই প্রমাণ দেখানোর দাবি জানান। এমন কোনো ইস্যু থাকলে প্রয়োজনে সে বিষয়ের ওপর আলাদা অধিবেশন ডাকার কথাও বলেন। তবে সবাই এইদিনের এজেন্ডাভুক্ত অনাস্থা প্রস্তাবের দাবি জানাতেই থাকেন।

এ অবস্থায় সকাল থেকে গভীর রাত পর্যন্ত অন্তত চারবার অধিবেশন মূলতবি করা হয় এবং প্রায় প্রতিবারই নির্ধারিত সময়ের অনেক পরে স্পিকার ও একটি সেশনে একজন প্যানেল সদস্য অধিবেশন শুরু করেন। তবে শত চেষ্টাতেও বিরোধীদের হটাতে পারেননি স্পিকার আসাদ কায়সার। রাত বেড়ে গেলেও তারা জাতীয় পরিষদে অবস্থান করে অনাস্থা ভোটের দাবি জানাতেই থাকেন।

মধ্যরাতে বিরোধীদের অব্যাহত চাপের মুখে এক পর্যায়ে স্পিকার আসাদ কায়সার বলেন, তার পক্ষে ‘বিদেশি ষড়যন্ত্র’ বাস্তবায়নের মাধ্যমে প্রধানমন্ত্রীকে উৎখাতের অংশ হওয়া কোনোভাবেই সম্ভব নয়। এরপর পদত্যাগ করেন তিনি। তার পদত্যাগের পরই ভোট প্রক্রিয়া সম্পন্ন করেন প্যানেল স্পিকার আয়াজ সাদিক।

/টিএন/

মন্তব্য

Beta version