-->
শিরোনাম

উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকিতে নারীরাই বেশি

আরিফ সাওন
উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকিতে নারীরাই বেশি
প্রতীকী ছবি

পুরুষদের তুলনায় নারীরা বেশি উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকিতে রয়েছেন। এই ঝুঁকি আরো বেশি স্থূল নারীদের। স্বাভাবিক ওজনের নারীদের তুলনায় স্থূল নারীদের ঝুঁকি দ্বিগুণ। এর পেছনে বিভিন্ন কারণ থাকতে পারে। তবে নারীদের ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিজ কমে যাওয়াও একটা অন্যতম কারণ হতে পারে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, পুরুষের তুলনায় নারীর ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটিস কম হওয়ার কারণে পুরুষের চেয়ে নারীর আক্রান্তের ঝুঁকি বেশি হতে পারে।

২০১৫ সালের এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৪০ শতাংশ নারীর ওভার ওয়েট অ্যান্ড ওবিস। আর সম্প্রতি এক গবেষণায় দেখা গেছে, ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে নারীদের ৫৮ শতাংশ ওভার ওয়েট বা ওবিস।

‘বাংলাদেশ ডেমোগ্রাফিক অ্যান্ড হেলথ সার্ভে ২০১৭-১৮’ অনুযায়ী, ২০১১ থেকে ২০১৭-১৮ সাল সময়ের মধ্যে, ৩৫ বছর ও তদূর্ধ্ব জনগোষ্ঠীর মধ্যে উচ্চরক্তচাপের প্রকোপ উল্লেখযোগ্য হারে বেড়েছে। পুরুষের মধ্যে ২০ শতাংশ থেকে বেড়ে ৩৪ শতাংশে এবং নারীর ক্ষেত্রে এই হার ৩২ শতাংশ থেকে ৪৫ শতাংশে দাঁড়িয়েছে। স্বাভাবিক ওজনের পুরুষদের উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত হওয়ার হার ২৪ শতাংশ আর স্থূল পুরুষদের এই হার ৪২ শতাংশ। দ্বিগুণের একটু কম। এছাড়া স্বাভাবিক ওজনের নারীদের আক্রান্তের হার ২৫ শতাংশ এবং স্থূল নারীদের এই হার প্রায় দ্বিগুণ; ৪৯ শতাংশ। স্বাভাবিক ওজনের নারীপুরুষের তুলনায় স্থূল নারীপুরুষের উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি অনেক বেশি।

বিশ্বে প্রতি বছর ১ কোটিরও বেশি মানুষ উচ্চরক্তচাপের কারণে মারা যায়, যা সকল সংক্রামক রোগে মোট মৃত্যুর চেয়েও বেশি। বাংলাদেশও উচ্চরক্তচাপের নীরব মহামারির মধ্যে রয়েছে।

বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিক্স বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ডা. মো. খালেকুজ্জামান বলেন, আমাদের একটা গবেষণা ছিল যে ২০১৫ সালে, আমরা করেছিলাম বস্তিবাসীদের লাইফস্টাইল নিয়ে। হাইপারটেনশন দেখেছি, ডায়বেটিস দেখেছি। সেখানে দেখলাম ৪০ শতাংশ নারীর ওভার ওয়েট অ্যান্ড ওবিস। এগুলো ভেরি শকিং না!

অ্যাসোসিয়েশন অব সার্জনস ফর স্লিপ অ্যাপনিয়া, বাংলাদেশ-এর মহাসচিব অধ্যাপক ডা. মনিলাল আইচ লিটু বলেন, একটা সমস্যা ভয়াবহ ভাবে দেখা দিয়েছে। তা হলো অনেক মানুষ মোটা হয়ে যাচ্ছেন। পৃথিবীতে তিনটি মহামারি চলছে। এর মধ্যে স্থূল হয়ে যাওয়া একটা। কোটি কোটি মানুষ মোটা হয়ে যাচ্ছে। অন্তত ছয়টা দেশে সুগার ট্যাক্স বসানো হয়েছে। কার্বোহাইডকে বলা হচ্ছে দ্য হোয়াইট পয়জন। কাজেই আমাদের ওজন নিয়ন্ত্রণে রাখতে হবে।

ব্র্যাক জেমস পি গ্রান্টস স্কুল অব পাবলিক হেলথের সেন্টার ফর নন কমিউনিকেবল ডিজিজ অ্যান্ড নিউট্রিশন বিভাগের পরিচালক অধ্যাপক ডা. মলয় কান্তি মৃধা বলেন, মহিলাদের মধ্যে ওভার ওয়েট অ্যান্ড ওবিসিটির মাত্রা আগের চেয়ে বেড়েছে। আমরা রিসেন্ট যে স্টাডি করেছি তাতে ৩৫ বছরের ঊর্ধ্বে মহিলা আছে, তাদের ৫৮ শতাংশ ওভার ওয়েট বা ওবিস। মহিলাদের মধ্যে ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি যে আসলে ব্লাড পেশার কমিয়ে রাখে, সেটা এটা ফ্যাক্টর; ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটির মাত্রা কম ছিল। এখন আরো কমে যাচ্ছে। এটা নিয়ে আরো ভালো করে গবেষণা করা দরকার। ওভার ওয়েট অ্যান্ড ওবিসিটি বেড়ে গেছে, তার পেছনেও ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি জড়িত থাকতে পারে।

ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের ডেপুটি প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. শামীম জোয়াদ্দার বেশ কয়েকটি কারণ উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, নারীরা বেশি স্ক্রিনিংয়ের আওতায় আসেন, যে কারণে তাদের চিহ্নিত বেশি হয়। একজন নারী যখনই গর্ভবতী হন, চিকিৎসকের কাছে গেলে তখনই তিনি স্ক্রিনিংয়ের আওতায় চলে আসেন। কোনো শারীরিক সমস্যায় পুরুষের চেয়ে নারীরা বেশি উপজেলা স্বাস্থ্য কমেপ্লেক্সে আসেন। তার মানে নারীর স্ক্রিনিং বেশি হচ্ছে। আরেকটা বিষয় হচ্ছে মোট জনসংখ্যার পুরুষের চেয়ে নারী বেশি। পুরুষ ৪৭ শতাংশ এবং নারী ৫৩ শতাংশ। মানসিক চাপতো রয়েছেই।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অস্বাস্থ্যকর খাদ্যাভ্যাস যেমন, খাদ্যের সাথে অতিরিক্ত লবণ (সোডিয়াম) গ্রহণ, স্যাচুরেটেড ফ্যাট এবং ট্রান্স ফ্যাটযুক্ত খাবার, তামাক ও অ্যালকোহল সেবন উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করে থাকে। অস্বাস্থ্যকর জীবন-যাপনও উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি করতে পারে যেমন, শারীরিকভাবে কর্মঠ না থাকা, অতিরিক্ত ওজন, মানসিক চাপ এবং পর্যাপ্ত পরিমাণে ফলমূল ও শাকসবজি না খাওয়া। এছাড়াও পারিবারিকভাবে উচ্চরক্তচাপের ইতিহাস থাকলে, বয়স বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে (৬৫ বছরের পরে) এবং ডায়াবেটিস বা কিডনি রোগের সঙ্গে উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি বৃদ্ধি পেয়ে থাকে।

অধ্যাপক ডা. মলয় কান্তি মৃধা বলেন, ধূমপানের সঙ্গে উচ্চরক্তচাপের সম্পর্ক আছে। যদি ওজন বেশি থাকে, তার সঙ্গে হাইপারটেনশনের সম্পর্ক আছে। আমি যদি ফিজিক্যাল অ্যাক্টিভিটি না করি, যেগুলো চাইলে আমরা চেঞ্জ করতে পারি, সেগুলোর ওপর আমাদের জোর দেওয়া উচিত। বংশানুক্রমিক ইতিহাস, আমার পরিবারে কারো হবে এমন না। জিন আছে। কিন্ত সেই জিন কার্যকর নাও হতে পারে। জীবনাচরণে পরিবর্তন করে কিন্তু জিনের কার্যকারিতা দমিয়ে রাখতে পারি। ওয়েটটা যাতে নিয়ন্ত্রণে রাখতে পারি, অ্যালকোহল গ্রহণ না করলে উচ্চরক্তচাপের ঝুঁকি এড়ানো সম্ভব।

তিনি বলেন, আমরা দুপুরে এবং রাতে যা খাই। তা চার ভাগ করে দুই ভাগ শাকসবজি এবং একভাগ ভাত আরেক ভাগ মাছ-মাংস এগুলো খেতে পারি।

ফিজিক্যাল অ্যক্টিভিটিস সম্পর্কে ন্যাশনাল হার্ট ফাউন্ডেশন হসপিটাল অ্যান্ড রিসার্স ইনস্টিটিউটের উচ্চরক্তচাপ নিয়ন্ত্রণ প্রোগ্রামের প্রোগ্রাম ম্যানেজার ডা. মাহফুজুর রহমান ভূইয়া বলেন, বিভিন্ন প্রকার একসারসাইজ আছে। সহজ একসারসাইজ হচ্ছে হাঁটা। প্রতিদিন ৩০ মিনিট করে বলি, তাহলে সপ্তাহে ২১০ মিনিট হওয়ার কথা। প্রতিদিন হাঁটা সম্ভব না, সেখানে আমরা বলি সপ্তাহে ১৫০ মিনিট। তাও যদি না পারি, ঘাম ঝরে এমনভাবে অন্তত ১০ মিনিট হাঁটা।

২০২০ সালে বাংলাদেশে উচ্চরক্তচাপে আক্রান্ত মানুষের সংখ্যা ছিল ৩ কোটি, বর্তমানে ৩ কোটি ২০ লাখ। যা ২০৩০ সাল নাগাদ গিয়ে দাঁড়াবে ৩ কোটি ৮০ লাখে। গ্লোবাল বার্ডেন অব ডিজিস স্টাডি (জিবিডি) ২০১৯-এর তথ্য অনুযায়ী বাংলাদেশে মৃত্যু এবং পঙ্গুত্বের প্রধান তিনটি কারণের একটি উচ্চরক্তচাপ। বাংলাদেশে বছরে ২ লাখ ৭৭ হাজার মানুষ হৃদরোগজনিত অসুস্থতায় মারা যায়, যার অন্যতম প্রধান কারণ উচ্চরক্তচাপ। ডব্লিউএইচওর তথ্যমতে, বাংলাদেশে প্রতি বছর ৫ লক্ষাধিক মানুষ অসংক্রামক রোগে মৃত্যুবরণ করে, যার প্রায় অর্ধেক হৃদরোগজনিত।

মন্তব্য

Beta version