পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী পদে ইমরান খানের রাজনৈতিক দল পিটিআইয়ের ভাইস চেয়ারম্যান শাহ মুহাম্মদ কোরেশি ও বিরোধী নেতা পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজের (পিএমএল-এন) শাহবাজ শরিফ জাতীয় পরিষদের সচিবালয়ে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন।
স্থানীয় সময় গতকাল রোববার দুপুরে কোরেশি ও শাহবাজ শরিফ মনোনয়নপত্র জমা দেন। নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনের লক্ষ্যে আজ (সোমবার) পার্লামেন্টের নিম্নকক্ষ জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে ভোট হবে। খবর: ডন ও জিও নিউজের।
গতকাল সকালে পিটিআইয়ের রাজনীতিক কানওয়াল শাওজাব ও জেরিন কোরেশি পার্লামেন্টে গিয়ে মাহমুদ কোরেশির পক্ষে মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করেন। শাওজাব বলেন, পিটিআইয়ের কোর কমিটির সঙ্গে পরামর্শ করে প্রধানমন্ত্রী পদে মনোনয়নপত্র জমা দিয়েছেন কোরেশি। প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতার জন্য গতকাল রোববার দুপুর ২টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় নির্ধারিত ছিল। বিকেল ৩টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়।
পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদ সচিবালয় জানিয়েছে, প্রাথমিকভাবে সিদ্ধান্ত হয়েছিল, নতুন প্রধানমন্ত্রী নির্বাচনে আজ (১১ এপ্রিল) স্থানীয় সময় বেলা ১১টায় জাতীয় পরিষদের অধিবেশন শুরু হবে। পরে এ সময় পরিবর্তন করে বেলা দুইটায় অধিবেশন শুরুর সময় নির্ধারণ করা হয়।
এর আগে শাহ মুহাম্মদ কোরেশির পক্ষে পিটিআইয়ের কানওয়াল শাওজাব ও জেইন কোরেশি মনোনয়নপত্র সংগ্রহ করতে সংসদ ভবনে যান। সে সময় গণমাধ্যমে শাওজাব বলেন, দলের সঙ্গে পরামর্শ করে মনোনয়ন জমা দেওয়া হবে। প্রধানমন্ত্রী পদে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করার জন্য রোববার দুপুর ২টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র জমা দেওয়ার সময় নির্ধারিত ছিল। বিকেল ৩টা পর্যন্ত মনোনয়নপত্র যাচাই-বাছাই করা হয়।
দিনভর নানা নাটকীয়তা শেষে গত শনিবার স্থানীয় সময় রাত একটার দিকে পাকিস্তানের জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে অনাস্থা ভোটে হেরে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে অপসারিত হন ইমরান খান। ৩৪২ আসনের পার্লামেন্টে তার বিরুদ্ধে ভোট পড়ে ১৭৪টি। ইমরান ছিলেন পাকিস্তানের ২২তম প্রধানমন্ত্রী। তার অবস্থাও পূর্বসূরিদের মতো হয়েছে। দেশটির ৭৫ বছরের ইতিহাসে নির্বাচিত একজন প্রধানমন্ত্রীও মেয়াদ পূর্ণ করতে পারেনি। এর কারণ খুঁজতে গিয়ে আবারো সেনাবাহিনীর দিকে আঙুল উঠছে।
পাকিস্তানের জন্ম থেকেই রাজনীতিতে কলকাঠি নাড়ছে দেশটির সেনাবাহিনী। ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই ইমরানের সঙ্গে সেনাবাহিনীর সুসম্পর্ক ছিল। এমনকি পিটিআইকে ক্ষমতায় আনার ক্ষেত্রে সেনাবাহিনীর ভূমিকার ছিল বলেও অনেকে মনে করেন। তবে সম্প্রতি দেশটির সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান সরকারের বিভিন্ন ইস্যুতে মতবিরোধ হয়। কিন্তু বিরোধীদের আনা অনাস্থা প্রস্তাব, পার্লামেন্ট ভেঙে দেওয়া, বিষয়টি সুপ্রিম কোর্ট পর্যন্ত গড়ানোÑ সব ক্ষেত্রেই শুরু থেকেই নিরপেক্ষ অবস্থানে দেখা যায় সেনাবাহিনীকে। বাহিনীটি কোনো পক্ষের হয়েই মতামত দেওয়া থেকে বেশ কিছুদিন ধরে বিরত রয়েছে। তথাকথিত নিরপেক্ষতার নীতি অবলম্বন করে চলেছে তারা।
ধারণা করা হচ্ছে, সেনাবাহিনীর এমন অবস্থানের কারণেই শক্ত অবস্থানে চলে যায় বিরোধীদলগুলো। সেনাবাহিনী নিশ্চুপ থাকার কারণে বিরোধীরা বুঝতে পারে ক্ষমতা ধরে রাখতে পারবেন না ইমরান খান। সম্প্রতি বৈদেশিক নীতি ও গোয়েন্দা সংস্থার প্রধান নিয়োগ নিয়ে সেনাবাহিনীর সঙ্গে ইমরান খানের মতবিরোধ দেখা দেয়। গত অক্টোবরে উত্তেজনা চূড়ান্ত রূপ নেয়। সে সময় ইমরান খান লেফটেন্যান্ট জেনারেল ফয়েজ হামিদকে গোয়েন্দা প্রধান হিসেবে বহাল রাখার চেষ্টা করেন। যা নিয়ে সেনাপ্রধানের সঙ্গে বিরোধ শুরু। যদিও পরে সেনাপ্রধান জেনারেল কামার বাজওয়ার মনোনীত ব্যক্তিই নিয়োগ পান।
অন্যদিকে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে সম্পর্ক ঢেলে সাজানোর চেষ্টাও করছিলেন ইমরান। যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে পাকিস্তানের ব্যবসা-বাণিজ্যসহ সামরিক ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ অংশীদার। চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে নিরপেক্ষ পররাষ্ট্রনীতি ঘোষণা দেন ইমরান। এর অংশ হিসেবে বাণিজ্য চুক্তির জন্য রাশিয়া সফর করেন। সেদিনই ইউক্রেনে হামলা চালায় রাশিয়া। যা নিয়ে পশ্চিমারা ইমরানের ওপর ক্ষুব্ধ ছিল। এই ইউক্রেন ইস্যুকে কেন্দ্র করেও ইমরান ও সেনাবাহিনীর মধ্যে মতবিরোধ স্পষ্ট হয়। দুই পক্ষ থেকেই পাল্টা বক্তব্য আসে। যুদ্ধ ইস্যুতে ইমরান পশ্চিমাদের সমালোচনা করেন। কিন্তু সেনাপ্রধান রাশিয়ার বিরুদ্ধে কথা বলেন। এর মধ্যেই ইমরান তার বিরুদ্ধে অনাস্থা প্রস্তাব আনার জন্য যুক্তরাষ্ট্রকে দায়ী করেন।
এদিকে রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্যে অনাপত্তিপত্র ছাড়া পাকিস্তানের সরকারি কর্মকর্তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়েছে। পার্লামেন্টে অনাস্থা ভোটে ইমরান খান ক্ষমতাচ্যুত হওয়ার প্রেক্ষাপটে উদ্ভূত পরিস্থিতি বিবেচনায় দেশটির দ্য সিকিউরিটি অ্যান্ড ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির (এফআইএ) ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের এ বিষয়ে সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। এফআইএর একজন জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বিষয়টি নিশ্চিত করেন।
সিকিউরিটি অ্যান্ড ফেডারেল ইনভেস্টিগেশন এজেন্সির নির্দেশনায় দেশটির সব আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের ইমিগ্রেশন কর্মকর্তাদের সর্বোচ্চ সতর্ক থাকতে বলা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের অনাপত্তিপত্র ছাড়া কোনো সরকারি কর্মকর্তা বিদেশে ভ্রমণ করতে চাইলে তাকে বাধা দেওয়ার নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। ইমরানের জোট সরকারের পতনের পর হঠাৎ করেই পাকিস্তানি নাগরিকদের বিভিন্ন দেশে যাওয়ার প্রবণতা বেড়েছে।
মন্তব্য