-->
শিরোনাম

গর্ভপাত মামলার রায় নিয়ে যেসব নাটকীয় ঘটনা ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রে

আন্তর্জাতিক ডেস্ক
গর্ভপাত মামলার রায় নিয়ে যেসব নাটকীয় ঘটনা ঘটেছিল যুক্তরাষ্ট্রে
ছবি: বিবিসি

যুক্তরাষ্ট্রে একটি মামলার রায় হবার আগেই বিচারকদের একজনের মতামতের খসড়া ফাঁস হয়ে যাবার নজির খুব বেশি নেই। কিন্তু মার্কিন নারীদের গর্ভপাতের অধিকারের ক্ষেত্রে অতি গুরুত্বপূর্ণ 'রো বনাম ওয়েড' মামলার ক্ষেত্রে ঠিক এটাই ঘটেছিল।

ব্যাপারটি নিয়ে এত হৈচৈ পড়ে যাবার কারণ-এ রায়ের ওপর নির্ভর করছিল যে মার্কিন নারীদের গর্ভপাত করানোর অধিকার বহাল খাকবে কিনা।

ফাঁস হওয়া দলিল থেকে ধারণা তৈরি হয় যে মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট হয়তো সে অধিকার কেড়ে নিতে পারে। শেষ পর্যন্ত তাই ঘটেছে-সুপ্রিম কোর্ট শুক্রবার 'রো বনাম ওয়েড' মামলায় ৫০ বছর আগেকার একটি রায় বাতিল করে দিয়েছে।

এর ফলে যুক্তরাষ্ট্রের লক্ষ লক্ষ নারী গর্ভপাত করানোর অধিকার হারালেন।

কীভাবে বিচারকের মতামত ফাঁস হয়েছিল

পলিটিকো নামে একটি মার্কিন সংবাদ ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয় ওই খসড়া দলিল। এতে বলা হয় যে, ১৯৭৩ সালের "রো বনাম ওয়েড" নামে খ্যাত ওই রায়টিতে মারাত্মক রকমের ভুল আছে বলে একজন বিচারপতি মনে করেন।

এ দলিল ফাঁসের সাথে সাথেই এমন আশঙ্কা তৈরি হয় যে, আদালতের সংখ্যাগরিষ্ঠ বিচারপতিই যদি এমন মনে করেন-তাহলে তাৎক্ষণিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের ২২টি অঙ্গরাজ্যে গর্ভপাত বেআইনি হয়ে যেতে পারে।

এরপর গর্ভপাতের পক্ষ-বিপক্ষের আন্দোলনকারী আর অধিকারকর্মীরা রাস্তায় নামতে শুরু করেন।

যুক্তরাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আদালতের সামনে গর্ভপাতের সমর্থক ও বিরোধী উভয় পক্ষই বিক্ষোভ করে। এ নিয়ে কথা বলতে শুরু করেন রাজনীতিবিদরাও। ডেমোক্রেটিক পার্টির নেতারা ওই দলিলের নিন্দা করেন।

এমনকি ই-কমার্স জায়ান্ট অ্যামাজনও নেমে পড়ে এ ইস্যুতে।

তারা ঘোষণা করে, সুপ্রিম কোর্ট যদি নারীদের গর্ভপাতের অধিকার কেড়ে নেয় আর তাদের কর্মচারীদের যদি গর্ভপাত করানোর জন্য অন্য কোথাও যেতে হয় - তাহলে তার খরচ অ্যামাজনই যোগাবে।

অ্যামাজন জানায়, এ জন্য তারা প্রতিবছর চার হাজার ডলার পর্যন্ত দিতে পারে। অন্য আরো কিছু কোম্পানিও তাদের স্টাফরা যেন গর্ভপাতের সুবিধা পেতে পারে সেজন্য একই ধরনের পরিকল্পনার কথা ঘোষণা করে।

রো বনাম ওয়েড মামলাটি কী ছিল

এটি হচ্ছে যুক্তরাষ্ট্রের সাড়া-জাগানো একটি মামলা- যার ওপর সুপ্রিম কোর্ট রুলিং দেয় ১৯৭৩ সালে। এতেই যুক্তরাষ্ট্রের নারীদের গর্ভপাত করানোর অধিকার দেয়া হয়।

উনিশশো উনসত্তর সালে নরমা ম্যাককর্ভি নামে ২৫ বছর বয়স্ক একজন অবিবাহিত নারী - জেন রো এই ছদ্মনাম নিয়ে টেক্সাস অঙ্গরাজ্যের ফৌজদারি গর্ভপাত আইনটিকে আদালতে চ্যালেঞ্জ করেন। ওই রাজ্যে তখন গর্ভপাত ছিল অসাংবিধানিক এবং নিষিদ্ধ।

তবে শুধুমাত্র মায়ের জীবন বিপদাপন্ন এমন অবস্থায় গর্ভপাতের অনুমতি ছিল।

সেই মামলায় আইনটির পক্ষের প্রতিনিধি ছিলেন হেনরি ওয়েড - ডালাস কাউন্টির ডিস্ট্রিক্ট অ্যাটর্নি।

সেই থেকেই মামলাটির নাম হয়ে যায় রো বনাম ওয়েড। ম্যাককর্ভি যখন মামলাটি করেছিলেন তখন তার গর্ভে তার তৃতীয় সন্তান।

তিনি দাবি করেন যে তাকে ধর্ষণ করা হয়েছিল। তার মামলাটির প্রত্যাখ্যাত হয় এবং তিনি সন্তানটির জন্ম দিতে বাধ্য হন। উনিশশো তিয়াত্তর সালে তার আপিলটি যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে ওঠে।

সেখানে তার মামলাটির সাথে স্যান্ড্রা বেনসিং নামে আরেকজন ২০ বছরের নারীর আরেকটি মামলারও শুনানী হয়।

এতে এই দুই নারী বলেন, টেক্সা্স ও জর্জিয়ার গর্ভপাত সংক্রান্ত আইন মার্কিন সংবিধানের বিরোধী - কারণ এটি একজন নারীর ব্যক্তিগত গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করেছে।

মামলার রায়ে ৭-২ ভোটে বিচারপতিরা রায় দেন যে গর্ভপাত নিষিদ্ধ করার ক্ষমতা সরকারগুলোর নেই।তারা বলেন, মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানে একজন নারীর স্বেচ্ছায় গর্ভপাত ঘটানোর অধিকার সংরক্ষিত আছে।

এই মামলা নারীদের অধিকারে কী পরিবর্তন এনেছিল

এ রায়ে একজন নারীর গর্ভাবস্থাকে কয়েকটি ট্রাইমেস্টার বা তিনমাসের সময়কালে ভাগ করা হয়। এতে আমেরিকান নারীদের গর্ভবতী হবার প্রথম তিন মাসের মধ্যে গর্ভপাত করানোর পূর্ণ অধিকার দেয়া হয়।

গর্ভাবস্থার পরের তিন মাস সময়কালের মধ্যে দেয়া হয় সীমিত অধিকার।

যুক্তরাষ্ট্রে ভ্রুণের পরিণত অবস্থা বলতে সেই সময়টাকে বোঝানো হয় - যখন থেকে তাকে জরায়ুর বাইরে বাঁচিয়ে রাখা সম্ভব।

গর্ভসঞ্চারের ২৩ বা ২৪ সপ্তাহ পর থেকে এই পর্যায়ের শুরু বলে ধরা হয়।

সুপ্রিম কোর্টের রায়ে বলা হয়েছিল যে গর্ভাবস্থার শেষ তিন মাস সময়কালে গর্ভপাত নিষিদ্ধ বা সীমিত করতে পারে।

এ সময়টায় একজন নারী শুধু তখনই গর্ভপাত করাতে পারে যদি ডাক্তাররা নিশ্চিত করেন যে 'নারীর জীবন রক্ষা বা স্বাস্থ্যের জন্য এটা প্রয়োজন।'

এরপর গর্ভপাতের ক্ষেত্রে কী কী বিধিনিষেধ জারি হয়েছে?

রো বনাম ওয়েড মামলার পর গত ৪৯ বছরের মধ্যে গর্ভপাতবিরোধী আন্দোলনকারীরা কিছু হারানো জায়গা পুনরুদ্ধার করেছেন।

মার্কিন সুপ্রিম কোর্ট ১৯৮০ সালে এমন একটি আইন বহাল রাখে - যাতে গর্ভপাতের জন্য কেন্দ্রীয় ফেডারেল সরকারের তহবিল ব্যবহারকে নিষিদ্ধ করা হয়।

শুধুমাত্র কোন নারীর জীবন রক্ষার ক্ষেত্রে এর ব্যতিক্রম হতে পারতো।

এরপর ১৯৮৯ সালে আদালত আরো কিছু বিধিনিষেধ অনুমোদন করে।

এর ফলে অনেক রাজ্যেই গর্ভপাতের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে নারীকে তার বাবা-মা বা একজন বিচারককে জড়িত করতে হয়।

অনেক জায়গায় আবার নিয়ম হয়েছে যে অ্যাবরশন ক্লিনিকে নারীর প্রথম যাবার দিন ও গর্ভপাত ঘটানোর দিনের মধ্যে কিছু দিন তাকে অপেক্ষা করতে হয়।

এর ফলে যা হয়েছে যে - অনেক নারীকে গর্ভপাত ঘটানোর জন্য অন্য রাজ্যে যেতে হয়, বা আরো বেশি অর্থ খরচ করতে হয়।

গর্ভপাতের পক্ষের আন্দোলনকারীদের মতে এজন্য দরিদ্র নারীদেরই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়।এর ফলে অনেক রাজ্যেই গর্ভপাতের ওপর কিছু বিধিনিষেধ আরোপ করা হয়েছে।

অনেক ক্ষেত্রে গর্ভপাতের সিদ্ধান্ত নেবার ক্ষেত্রে নারীকে তার বাবা-মা বা একজন বিচারককে জড়িত করতে হয়।

অনেক জায়গায় আবার নিয়ম হয়েছে যে অ্যাবরশন ক্লিনিকে নারীর প্রথম যাবার দিন ও গর্ভপাত ঘটানোর দিনের মধ্যে কিছু দিন তাকে অপেক্ষা করতে হয়।

এর ফলে যা হয়েছে যে - অনেক নারীকে গর্ভপাত ঘটানোর জন্য অন্য রাজ্যে যেতে হয়, বা আরো বেশি অর্থ খরচ করতে হয়।

গর্ভপাতের পক্ষের আন্দোলনকারীদের মতে এজন্য দরিদ্র নারীদেরই সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগে পড়তে হয়।

যেমন অঙ্গরাজ্যের সরকারি ক্লিনিকে সরকারি কর্মচারিদের দিয়ে কোন গর্ভপাত করানো যাবে না।

সবচেয়ে বড় প্রভাব পড়ে ১৯৮২ সালে সুপ্রিম কোর্টের দেয়া একটি রুলিংয়ে।

'প্ল্যানড প্যারেন্টহুড বনাম কেইসি' নামের মামলায় রো বনাম ওয়েড মামলাটির রায়কে বহাল রেখেই বলা হয়, রাজ্যগুলো এমনকি প্রথম তিন মাসের মধ্যে গর্ভপাতকেও সীমিত করতে পারে যদি তা নন-মেডিক্যাল কারণে হয়।

এতে অবশ্য বলা হয়, ভ্রুণ পরিণত অবস্থায় যাবার আগে পর্যন্ত কোন নারী গর্ভপাত করাতে চাইলে অঙ্গরাজ্যের কর্তৃপক্ষ তার ওপর অন্যায় কোন আইনি বোঝা চাপিয়ে দিতে পারবে না।

কিন্তু এটাও বলা হয় যে এসব নিয়মকানুন যে ক্ষতিকর তা ওই নারীকেই প্রমাণ করতে হবে।

মিসিসিপি কিভাবে এই রায়কে উল্টে দিতে পেরেছিল?

মিসিসিপি অঙ্গরাজ্যে| ২০১৮ সালে একটি আইন পাস হয় যাতে কোন নারীর গর্ভসঞ্চারের ১৫ সপ্তাহের পর গর্ভপাত করানোর অধিকাংশ সুযোগই অবৈধ হয়ে যাবে।

ধর্ষণ বা নিষিদ্ধ সম্পর্কের মধ্যে যৌনমিলনের ফলে সৃষ্ট গর্ভাবস্থাও এর মধ্যে অন্তর্ভুক্ত।

মিসিসিপি চাইছে রো বনাম ওয়েড মামলার রায়টি পুরোপুরি উল্টে দিতে।

তবে মিসিসিপি রাজ্যের একমাত্র গর্ভপাত সেবা প্রদানকারী জ্যাকসন উইমেন্স হেলথ অর্গানাইজেশনের করা একটি চ্যালেঞ্জের ফলে আইনটি এখনো কার্যকর হয়নি।

সুপ্রিম কোর্ট কী করতে পারে?

সুপ্রিম কোর্ট এখন মিসিসিপির পক্ষে রায় দেয়ার ফলে কার্যত যুক্তরাষ্ট্রে গর্ভপাতের ক্ষেত্রে সাংবিধানিক অধিকারের অবসান ঘটবে। তখন এটি একেকটি রাজ্যের নিজস্ব সিদ্ধান্তের ব্যাপারে পরিণত হবে।

যুক্তরাষ্ট্রের সুপ্রিম কোর্টে এখন বিচারক আছেন নয় জন। তাদের মধ্যে ছয় জনই রিপাবলিকান প্রেসিডেন্টদের নিয়োগ দেয়া।

এই ছয় জনের একজন বিচারপতি স্যামুয়েল এলিটোর খসড়া মতটিই ফাঁস হয়ে গিয়েছিল।

এতে বলা হচ্ছে রো বনাম ওয়েড মামরার রায়টি "গুরুতর রকমের ভুল।"

এ জন্যেই আশঙ্কা দেখা দিয়েছিল যে ১৯৭৩ সালের রুলিংটি সুপ্রিম কোর্ট বাতিল করে দিলে যুক্তরাষ্ট্রের প্রায় অর্ধেক রাজ্যে গর্ভপাত নিষিদ্ধ হয়ে যাবে। এখন ঠিক সেটাই ঘটেছে বলে দেখা যাচ্ছে।

মন্তব্য

Beta version