-->
শিরোনাম
বিশ্ব জনসংখ্যা দিবস আজ

স্থবির হয়ে পড়ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম

শিপংকর শীল
স্থবির হয়ে পড়ছে জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম

শিপংকর শীল: দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম অনেকটা স্থবির হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা। তারা বলছেন, দেশে জনসংখ্যা বিস্ফোরণ ঘটেছে অনেক আগেই। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম থেকে দূরে সরে গেছে সরকার। কিন্তু জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তর কর্মসূচিও এখন পর্যন্ত সফলতা পায়নি। ফলে জনসংখ্যার বিস্ফোরণ দেশের সার্বিক উন্নতির পথে বড় প্রতিবন্ধকতা তৈরি করছে।

 

বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) জরিপে বলা হয়েছে, দেশের মোট জনসংখ্যা এখন ১৬ কোটি ৯৮ লাখ। ২০২২ সালের ২৭ জুলাই জনশুমারি ও গৃহগণনার যে প্রাথমিক প্রতিবেদন প্রকাশ করা হয়েছিল, সেখানে জনসংখ্যা দেখানো হয়েছিল ১৬ কোটি ৫১ লাখ ৫৮ হাজার ৬১৬ জন। সে হিসাবে cUড়ান্ত ফলাফলে জনসংখ্যা বেড়েছে প্রায় ৪৭ লাখ। তার আগে ২০১১ সালের আদমশুমারি ও গৃহগণননায় দেশের জনসংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ১২ কোটি ৪৩ লাখ ৫৫ হাজার ২৬৩ জন।

 

স্বাধীনতার পর ১৯৭৪ সালে দেশের প্রথম শুমারিতে জনসংখ্যা পাওয়া গিয়েছিল ছিল ৭ কোটি ১৪ লাখ ৭৯ হাজার ৭১ জন। ১৯৮১ সালের শুমারিতে তা বেড়ে ৮ কোটি ৭১ লাখ ১৯ হাজার ৯৬৫ জন হয়। ১৯৯১ সালের শুমারিতে জনসংখ্যা দাঁড়ায় ১০ কোটি ৬৩ লাখ ১৪ হাজার ৯৯২ জনে।

 

জরিপে আরো বলা হয়েছে, দেশে জনসংখ্যার বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ২২ শতাংশ। ২০১১ সালের আদমশুমারিতে গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ছিল ১ দশমিক ৩৭ শতাংশ। সে অনুপাতে বার্ষিক গড় বৃদ্ধির হার শূন্য দশমিক ১৫ শতাংশ কমেছে। জনসংখ্যার ঘনত্ব বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১ হাজার ১১৯ জন। ২০১১ সালের শেষ জনশুমারিতে যা ছিল ৯৭৬ জন।

 

জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম: একসময় দেশের জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম ব্যাপক সাড়া ফেলেছিল। মাঠকর্মীদের পরিদর্শনে জেগে উঠেছিল গ্রামবাংলার বাড়িগুলো। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে বাংলাদেশের সাফল্য একসময় উন্নয়ন নীতিনির্ধারকদের দৃষ্টি কেড়েছিল। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ কার্যক্রম যেভাবে বাংলাদেশে গুরুত্ব হারাচ্ছে, তাতে দেশটির সাফল্য ভেস্তে যেতে পারে।

 

জনসংখ্যাবিজ্ঞান বিশেষজ্ঞ অধ্যাপক এ কে এম নুর-উন-নবী বলেন, সরকারের বারবার নীতি পরিবর্তনই মূলত এর জন্য দায়ী। একসময়ে বাংলাদেশের পরিবার পরিকল্পনা কর্মসূচি অনুন্নত দেশগুলোর জন্য রোলমডেল হলেও এখন আর সে অবস্থা নেই। জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে নীতিগত পরিবর্তন, রাজনৈতিক দলগুলোর মতভিন্নতার কারণে কখনো ফ্যামিলি প্ল্যানিংয়ের বিষয়টি সামনে গেছে, কখনো পেছনে গেছে। ফলে এই বিষয়টি আর সেভাবে গুরুত্ব নিয়ে থাকেনি বলে জানান অধ্যাপক এ কে এম নুর-উন-নবী।

 

বিশেষজ্ঞরা বলেন, আশির দশকে বাড়ি বাড়ি গিয়ে স্বাস্থ্যকর্মীরা জন্ম নিয়ন্ত্রণের উপকারিতা বোঝানোর পাশাপাশি পিল ও কনডম পৌঁছে দিতেন। কিন্তু সরকারের সেই কার্যক্রমে ভাটা পড়েছে। প্রায় দীর্ঘ বছর ধরে নতুন করে কোনো মাঠকর্মী নিয়োগ করা হয়নি। ফলে সেখানে একটি শূন্যতার সৃষ্টি হয়েছে। আরেকটা সমস্যা হচ্ছে, মাঠ পর্যায়ে যে পদগুলো রয়েছে, সেগুলো তৈরি হয়েছে সত্তরের দশকের শেষদিকে। তখন প্রতি ছয়শ পরিবারের জন্য একজন করে কর্মী নির্দিষ্ট করা হয়েছিল। কিন্তু জনসংখ্যা বেড়ে যাওয়ায় এখন একজন কর্মী অনুপাতে পরিবার হয়েছে বারোশ থেকে পনোরোশ। ফলে কর্মীরা আর আগের মতো সবার কাছে যেতে পারছেন না।

 

এ বিষয়ে অধ্যাপক নুর-উন-নবী বলছেন, সরকার জন্মহার বৃদ্ধির হার ও ফার্টিলিটি রেট কমাতে সফল হয়েছে। কিন্তু এখন যে হার রয়েছে, এই হারে চললেও দেশের আয়তন অনুপাতে ভবিষ্যতে জনসংখ্যার হার অনেক বেশি হবে। এই হারে চললে ২০৮০ সাল নাগাদ একটি স্থিরতা আসবে। কিন্তু ততদিনে জনসংখ্যা অনেক বেশি হয়ে যাবে।

 

জনসংখ্যা বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অতিরিক্ত জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য সম্পদ না সমস্যা এটা নিয়ে বিতর্ক রয়েছে। জনসংখ্যা জনসম্পদে পরিণত করা একটি চ্যালেঞ্জিং বিষয়। প্রত্যেক সামর্থ্যবান মানুষের জন্য উপযুক্ত কাজ নিশ্চিত করা, তাদের কাজে উৎসাহিত করা এবং এ লক্ষ্যে কর্মসংস্থান সৃষ্টি, নতুন উদ্যোক্তা তৈরি, প্রশিক্ষণ প্রদান, ঋণ বিতরণ ইত্যাদি কার্যক্রম অন্তর্ভুক্ত। জনসংখ্যাকে জনসম্পদে রূপান্তরিত করতে সক্ষম হলে তা সম্পদ। আর সক্ষম না হলে অতিরিক্ত জনসংখ্যা হয়ে ওঠে একটি দেশের সার্বিক উন্নয়ন তথা জীবন ও জীবিকা টিকিয়ে রাখার পথে সবচেয়ে বড় প্রতিবন্ধকতা।

 

বিশেষজ্ঞরা আরো বলেন, আয়তনের তুলনায় বাংলাদেশের জনসংখ্যা অধিক। ঘনবসতির কারণে বাড়ছে নানা সমস্যা। এত বিপুল সংখ্যক মানুষের খাদ্য, বাসস্থান স্বাস্থ্য, কর্মসংস্থান, শিক্ষার সুযোগ সৃষ্টি করা এক বিরাট কর্মযজ্ঞ। এ জন্য জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণ অত্যন্ত জরুরি। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে এক সময় জোর দেয়া হলেও এখন তেমন একটা কার্যক্রম চোখে পড়ে না। দেশে দিন দিন বেকারত্বের হার বাড়ছে।

 

অন্যদিকে বাড়ছে জনসংখ্যা। এ অবস্থা চলতে থাকলে সব ক্ষেত্রেই একটি নৈরাজ্যকর অবস্থার সৃষ্টি হবে। এ জন্য জনসংখ্যাকে জনসম্পদে পরিণত করতে হলে দেশে-বিদেশে কর্মসংস্থান সৃষ্টি করতে হবে। পাশাপাশি জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণেও নিতে হবে কার্যকর পদক্ষেপ।

 

শিক্ষাবিদ ও ইতিহাসতত্ত¡বিদ মমতাজউদ্দীন পাটোয়ারী বলেন, দেশে জনসংখ্যা নিয়ে দুই ধরনের ধারণা বিশেষজ্ঞ ও রাজনৈতিক মহলে বিরাজ করছে। এক. জনসংখ্যা বাংলাদেশের জন্য আশীর্বাদ তথা জনসম্পদে পরিণত হয়েছে। দুই. বর্তমান জনসংখ্যার চাপ না কমাতে পারলে আমাদের সব উন্নয়ন শিগগিরই ব্যর্থ হতে বাধ্য। দুটো মতই প্রণিধানযোগ্য। কোনোটাকেই আমরা উড়িয়ে দিচ্ছি না।

 

তবে নিকট-ভবিষ্যতের কথা ভাবলে আমাদের অনেক কিছুই নতুন করে ভাবনাচিন্তা করতে হবে বলে মনে করি। বিশ্ব এখন চতুর্থ শিল্পবিপ্লবের যুগে প্রবেশ করেছে। আর ২০-৩০ বছর পরেই তথ্যপ্রযুক্তি, জৈবপ্রযুক্তি, জিনতত্ত্ব, জলবায়ু, বাস্তুসংস্থান, ইত্যাদি জটিলতায় মানুষের ভবিষ্যৎ কী হতে যাচ্ছে তা নিয়ে বিজ্ঞানীরা নানা ধরনের সতর্কতা জানিয়ে আসছেন। বিষয়গুলোকে খুব হালকাভাবে নেয়ার সুযোগ আছে বলে মনে হয় না।

 

কেননা সত্যি সত্যি যদি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার যন্ত্র তথা রোবটের ব্যবহার উৎপাদনশীলতায় স্থান করে নিতে থাকে তাহলে মানুষের অস্তিত্ব কতটা টিকে থাকবে সেটি নিয়েও প্রশ্ন উঠছে। এই বিষয়গুলো নিয়ে আমাদের দেশে এখনো সেভাবে আলোচনা হচ্ছে না। তবে আমাদের দেশ জনঘনত্বে যেভাবে ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে, তাতে নানা ধরনের সমস্যার চাপ এই দেশ আর কতখানি বহন করতে পারবে সেটি নিয়ে এখনই ভাবতে হবে।

 

কেননা একুশ শতকের পৃথিবী যেভাবে দ্রুত গতিতে পরিবর্তিত হচ্ছে তার সঙ্গে তাল মিলিয়ে বিপুল এই জনগোষ্ঠীর দেশকে উন্নত, সমৃদ্ধ দেশে রূপান্তরিত করা মোটেও সহজ কাজ হবে না। কারণ আমাদের বিপুল জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করার ক্ষেত্রে আমাদের সংকট দিন দিন প্রকটতর হচ্ছে। একুশ শতকের জ্ঞান-বিজ্ঞান, সমাজচিন্তা, রাষ্ট্রচিন্তা, মানবচিন্তা, প্রকৃতিচিন্তা ইত্যাদিতে জনগোষ্ঠীকে শিক্ষিত করে তোলা বিদ্যমান শিক্ষা ব্যবস্থা দিয়ে মোটেও সম্ভব নয় এটি অস্বীকার করার কোনো উপায় নেই।

 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী জাহিদ মালেক সাংবাদিকদের বলেন, দেশে সাড়ে চার কোটি কিশোর-কিশোরী ও তরুণ-তরুণী রয়েছে। জনসংখ্যা নিয়ন্ত্রণে সরকার এখন কিশোর-কিশোরীদের স্বাস্থ্যের দিকে বিশেষ নজর দিচ্ছে। আমরা মনে করি, যদি তাদের স্বাস্থ্যের দিকে মনোযোগ দেওয়া যায়, তাহলে দেশের জনসংখ্যা আর বাড়বে না। ‘বাড়ি বাড়ি গিয়ে পরিবার পরিকল্পনার সেবা দেয়া বন্ধ করা হয়নি।

 

আগের চেয়ে এখন যোগাযোগব্যবস্থা অনেক ভালো হওয়ায় লোকজন নিজেরাই সেবাকেন্দ্রে চলে আসেন। বাড়ি বাড়ি যাওয়ার ততটা প্রয়োজন হয় না। এরপরও প্রয়োজন হলে বাড়ি বাড়ি যাওয়া আরো বাড়ানো হবে।’ দেশে এখন মোট প্রজনন হার ২ দশমিক ৩। এ হার ২-এ নামিয়ে আনার চেষ্টা চলছে। এ জন্য সঠিক পরিকল্পনা নিয়ে এগোনোর বিকল্প নেই।

 

স্বাস্থ্যমন্ত্রী বলেন, সীমিত সম্পদ দিয়েই আমাদের এগিয়ে যেতে হবে। তার কাজের ক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। এই সম্পদকে সঠিকভাবে গড়ে তুলতে হবে। এ সম্পদকে দক্ষ জনশক্তিতে রূপান্তরের জন্য কর্তৃপক্ষ নানা কার্যক্রম গ্রহণ করেছে। ইচ্ছাশক্তিকে কাজে লাগিয়েই এ সম্পদের সঠিক ব্যবহার করতে হবে। সাধারণ শিক্ষার পাশাপাশি কারিগরি শিক্ষায় যথাযথ গুরুত্বারোপ করতে হবে। হাতেকলমে শেখার কোনো বিকল্প নেই। জনসংখ্যা সমস্যার সমাধান করতে হলে অবশ্যই শিক্ষিত ও দক্ষ জনগোষ্ঠী তৈরি করতে হবে।

 

বেকারত্ব ও কর্মসংস্থান: অনিয়ন্ত্রিত জনসংখ্যা বৃদ্ধির সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে তৈরি হয়নি কর্মসংস্থান, দক্ষ জনশক্তি। ফলে বেড়েই চলেছে বেকারত্বের হার, যা দেশের সার্বিক উন্নয়ন কার্যক্রম চরমভাবে ব্যাহত করছে।

 

সরকারি সংস্থা বিআইডিএসের তথ্য অনুযায়ী, দেশে শিক্ষিত মানুষের মধ্যেই বেকারের হার বেশি। ৪৭ শতাংশ শিক্ষিতই বেকার। দেশে প্রতিবছর শ্রমশক্তিতে যোগ হচ্ছে ২০ লাখ মানুষ। কিন্তু সেই অনুপাতে কর্মসংস্থান হচ্ছে না। ফলে বড় একটি অংশ বেকার থেকে যাচ্ছে।

 

ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পপুলেশন সায়েন্সেস বিভাগের অধ্যাপক মোহাম্মদ মঈনুল ইসলাম বলেন, দেশে অর্থনৈতিক উন্নতি হচ্ছে, এটি যেমন সত্য, তেমনি তরুণদের কর্মসংস্থান হচ্ছে না, এটিও বাস্তবতা। জনমিতির লভ্যাংশকে (ডেমোগ্রাফিক ডিভিডেন্ড) সফল করতে চাইলে তরুণ জনগোষ্ঠী যাতে গুণগত শিক্ষা পায়, সেদিকে নজর দিতে হবে। তাদের দক্ষ করে গড়ে তুলতে হবে। একই সঙ্গে তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করতে হবে। সরকার যদি তরুণদের গুণগত শিক্ষা দিয়ে দক্ষ মানবসম্পদে পরিণত করতে না পারে, তাহলে জনমিতির লভ্যাংশের সুফল পাওয়া থেকে বঞ্চিত হবে বাংলাদেশ।

 

সম্প্রতি একশনএইড বাংলাদেশ ও সাউথ এশিয়ান নেটওয়ার্ক অন ইকোনমিক মডেলিংয়ের (সানেম) এক জরিপে বলা হয়, বাংলাদেশে যুবগোষ্ঠীর বড় অংশ আর্থসামাজিক ঝুঁকির মধ্যে আছে। বৈষম্য আর গুণগত শিক্ষার অভাবে ৭৮ শতাংশ তরুণ মনে করেন, পড়াশোনা করে তারা চাকরি পাবেন না, গরিব শিক্ষার্থীদের ক্ষেত্রে এ হার ৯০ শতাংশ। চাকরি, পড়াশোনা বা প্রশিক্ষণে নেই ২৯ দশমিক ৮ শতাংশ তরুণ।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version