শাহীন রহমান: অবরুদ্ধ গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে সাধারণ নাগরিকের সরে যাওয়ার নির্দেশ দেয়ার পর সেখানে স্থল হামলা শুরু করেছে ইসরায়েল বাহিনী। টানা এক সপ্তাহ ধরে বিমান হামলার পর এই হামলা শুরু করে তারা। সীমিত আকারে তাদের এই হামলার টার্গে হলো হামাসের টানেল নেটওয়ার্ক ধ্বংস করে বন্দি ইসরায়েলিদের উদ্ধার করা। গত শনিবার ভোর থেকেই গাজার বিভিন্ন স্থানে প্রবেশ করে ইসরায়েলি বাহিনী। ট্যাংক ও সাজোয়াজান সজ্জিত হয়ে তারা এই হামলা চালাচ্ছে তারা। খবর বিবিসি রয়টার্স আল জাজিরা, এপি এফপি
এদিকে গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে অভিযানের পর কয়েকজন ইসরায়েলিদের মরদেহ ও জিনিসপত্র খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র। মরদেহগুলো হামাসের হাতে জিম্মি থাকা বেসামরিক ইসরায়েলি নাগরিকদের হতে পারে বলে জানান তিনি। আল জাজিরা জানায়, গাজায় স্থল অভিযানের ক্ষেত্রে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করতে হতে পারে।
এদিকে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানায়, তারা একটি সন্ত্রাসী সেলকে চিহ্নিত করেছে যারা দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলি ভূখন্ডে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছিল। ওই সন্ত্রাসী সেলকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে ৩ জন নিহত হয়েছে বলে জানায় তারা।
ইসরায়েল ডিফেন্স ফোর্স বা আইডিএফ জানিয়েছে ইসরায়েলের বিমান বাহিনী হামাসের বিভিন্ন আস্তানা লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। এছাড়া হামাসের ব্যবহৃত অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইল লঞ্চার লক্ষ্য করে বিমান হামলা অব্যাহত রেখেছে। এসব অ্যান্টি ট্যাংক মিসাইল লঞ্চার দিয়ে গাজা থেকে ইসরায়েলকে টার্গেট করে হামলা চালানো হয়। বিমান বাহিনী বলছে, আইডিএফ গাজা উপত্যকাকে সন্ত্রাসী ও অস্ত্রমুক্ত করার চেষ্টার অংশ হিসেবে এবং ‘নিখোঁজ ব্যক্তিদের সন্ধান’ পেতে বিভিন্ন জায়গায় ছোট ধরনের কিছু তল্লাশি চালিয়েছে।
রয়টার্স জানায়, হামাসকে নির্মূলে গাজায় টানা এক সপ্তাহ ধরে ভারী বোমাবর্ষণের পর এই প্রথম স্থল অভিযানের ঘোষণা দিয়েছে ইসরায়েল। তারা জানায়, আগামী দিনগুলোতে তারা গাজা শহরে ‘উল্লেখযোগ্য’ অভিযান চালাবে। পরবর্তী ঘোষণা না আসা পর্যন্ত বেসামরিক নাগরিকরা ফিরে আসতে পারবেন না। ইসরায়েলের এ ঘোষণার পর গাজা শহর ছাড়তে দেখা যায় অনেক বাসিন্দাকে। তবে হামাস তাদের বাসস্থান ছেড়ে যেতে নিষেধ করেছে।
ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল ড্যানিয়েল হাগারি বলেন, ফিলিস্তিনি রকেট ক্রুদের ওপর হামলা চালাতে এবং হামাসের হাতে জিম্মিদের অবস্থানের তথ্য জানতে ইসরায়েলি সেনারা ট্যাঙ্কের সাহায্যে অভিযান চালিয়েছে। রয়টার্স জানায়, গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে ঠিক কতো বাসিন্দাকে রাস্তায় ছুটতে দেখা গেছে, তা বলা সম্ভব নয়। তবে অনেকে আবার বাড়ি-ঘর ছেড়ে যেতে অস্বীকৃতিও জানিয়েছেন।
এদিকে হামাস বলছে, তারা শেষ রক্ত বিন্দু দিয়ে হলেও লড়াই চালিয়ে যাবে। গাজা শহরের কেন্দ্রে দুই দিন আগে ইসরায়েলি বিমান হামলায় বিধ্বস্ত একটি ভবনের সামনে দাঁড়িয়ে ২০ বছর বয়সী মোহাম্মাদ রয়টার্সকে বলেন, পালিয়ে যাওয়ার চেয়ে মৃত্যু ভালো। আমি এখানে জন্মেছি এবং এখানেই মরব, পালিয়ে যাওয়া কলঙ্ক, বলেন তিনি। হামাসের স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের মুখপাত্র ইয়াদ আল-বোজোম এক সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, আমরা উত্তর গাজা ও গাজা শহরের বাসিন্দাদের বাড়িতে এবং নিজ নিজ অবস্থানে থাকার নির্দেশ দিয়েছি।
এদিকে গাজা থেকে বেসামরিক নাগরিকদের সরে যাওয়ার জন্য ইসরায়েল চব্বিশ ঘণ্টা সময় বেঁধে দেয়ার পর পর গাজার উত্তরাঞ্চল থেকে সরে গেছে বহু মানুষ। কেউ গাড়িতে, কেউ ট্রাকে করে কিংবা পায়ে হেঁটে এলাকা ছাড়তে দেখা গেছে লোকজনকে। বড় ধরনের স্থল অভিযানের আগেই গাজার উত্তরাঞ্চলের প্রায় এগার লাখ মানুষকে সরে যাওয়ার জন্য বলেছিল ইসরায়েল। জাতিসংঘ এ ধরনের নির্দেশকে ভয়ঙ্কর হিসেবে বর্ণনা করেছে। অন্যদিকে বেসামরিক নাগরিকদের রক্ষায় সব ধরনের ব্যবস্থা নেয়ার আহব্বান জানিয়েছে যুক্তরাষ্ট্র। দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রী অ্যান্টনি ব্রিংকেন বলেছেন গাজায় ‘নিরাপদ এলাকা’ নিশ্চিত করতে তিনি ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করছেন।
গাজা উপত্যকার উত্তরাঞ্চলে অভিযানের পর কয়েকজন ইসরায়েলিদের মরদেহ ও জিনিসপত্র খুঁজে পাওয়ার কথা জানিয়েছেন ইসরায়েলের সামরিক মুখপাত্র। মরদেহগুলো হামাসের হাতে জিম্মি থাকা বেসামরিক ইসরায়েলি নাগরিকদের হতে পারে বলে জানান তিনি। এর আগে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনী জানায়, শিশু, নারী, বৃদ্ধসহ কয়েক ডজন ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিককে জিম্মি করেছে হামাস। স্থল অভিযান শুরুর আগে জিম্মিদের উদ্ধারের বিষয়ে তৎপর হওয়ার জন্য সামরিক বাহিনীর ওপর চাপ ছিল।
আল জাজিরা জানায়, গাজায় স্থল অভিযানের ক্ষেত্রে বিশেষ বাহিনী মোতায়েন করা হয়েছে। এদিকে ইসরায়েলের সেনাবাহিনী জানায়, তারা একটি সন্ত্রাসী সেলকে চিহ্নিত করেছে যারা দক্ষিণ লেবানন থেকে ইসরায়েলি ভূখন্ডে অনুপ্রবেশের চেষ্টা করছিল। ওই সন্ত্রাসী সেলকে লক্ষ্য করে ড্রোন হামলা চালিয়েছে ইসরায়েল। এতে ৩ জন নিহত হয়েছে বলে জানায় তারা।
ইসরায়েলের সপ্তাহব্যাপী বোমা হামলায় গাজা উপত্যকায় ১৩০০-এর বেশি ভবন ধ্বংস হয়েছে বলে জানিয়েছে জাতিসংঘ। জাতিসংঘের মানবাধিকার সংস্থা অফিস ফর দ্য কোঅর্ডিনেশন অব হিউম্যানিটারিয়ান অ্যাফেয়ার্স জানিয়েছে যে ধ্বংস হওয়া ভবনগুলোয় ‘পাঁচ হাজার ৫৪০টি বসতবাড়ি’ ছিল, যার মধ্যে তিন হাজার ৭৫০টি বাসা এমনভাবে ধ্বংস হয়েছে যে সেগুলো আর বসবাসযোগ্য নেই।
হামাসের হাতে এখনো ১৫০ জনের বেশি ইসরায়েলি নাগরিক জিম্মি রয়েছেন বলে দাবি করেছে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্স। এই জিম্মিদের মধ্যে নারী, শিশু ও বয়স্করা রয়েছেন বলে বলা হচ্ছে। হামাস জানিয়েছে, তারা এই জিম্মিদের ‘নিরাপদ স্থানে ও টানেলে’ লুকিয়ে রেখেছে এবং হুমকি দিয়েছে যে ইসরায়েল বেসামরিক নাগরিকদের সতর্ক না করে গাজায় বোমা হামলা চালালে তারা জিম্মিদের হত্যা করবে। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর এক কর্মকর্তা বলেছেন যে হামাস যেন ভবির্ষতে ইসরায়েলি বেসামরিক নাগরিকদের ওপর হামলা করতে না পারে, তা নিশ্চিত করতে তারা হামাসকে চূর্ণ করে দেয়ার জন্য হামলা চালাবে। আমাদের লক্ষ্য পরিষ্কার। এই যুদ্ধের শেষ হবে হামাসের ধ্বংসের মাধ্যমে। তাদের সেনা কর্মক্ষমতা এমনভাবে চূর্ণ করা হবে যেন তারা আর কখনো ইসরায়েলের বেসামরিক নাগরিকদের ক্ষতি না করতে পারে।
তেল আভিভের দেয়া ২৪ ঘণ্টার ‘চরম সময়সীমা’ মেনে প্রায় ২৩ লক্ষ গাজাবাসীর অর্ধেকই এখন বিকল্প বাসস্থান খুঁজতে বাড়ি ছেড়ে পথে নেমেছেন। ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর একজন মুখপাত্র বলেছেন উত্তর গাজার বেসামরিক নাগরিকদের দুটি রাস্তা ব্যবহার করে দক্ষিণে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েলি সেনাবাহিনী। সোশ্যাল মিডিয়া প্ল্যাটফর্ম এক্সে একটি আরবি পোস্টে ইসরায়েলি ডিফেন্স ফোর্সেসের (অইডিএফ) মুখপাত্র আভিচে আদ্রাই লিখেছেন যে স্থানীয় সময় সকাল ১০টা থেকে বিকেল ৪টার (বাংলাদেশ সময় দুপুর ১টা থেকে সন্ধ্যা ৭টা) মধ্যে দুটি পথ ব্যবহার করে ‘কোনো ক্ষয়ক্ষতি ছাড়া’ গাজার নাগরিকরা দক্ষিণে সরে যেতে পারবেন।
গাজা সিটির বাসিন্দাদের বেইত হানুন থেকে খান ইউনিসের দিকে সরে যাওয়ার নির্দেশ দিয়েছে তারা। সমুদ্র উপকূলের কাছে ও অলিভ শহরের পশ্চিমে বসবাসকারী নাগরিকদের দালদুল ও আল-সানার রাস্তা ব্যবহার করে সালাহ আল-দিন ও আল-বাহরে সরে যেতে দেয়া হবে বলে উল্লেখ করা হয়েছে বার্তায়।
এদিকে গাজা শহরের উত্তরাঞ্চল ছেড়ে দক্ষিণাঞ্চলে যাওয়ার সময় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন বলে জানিয়েছে হামাস। শনিবার আল জাজিরার প্রতিবেদনে এ তথ্য জানানো হয়েছে। ফিলিস্তিনি সংগঠন হামাসের মিডিয়া অফিসের বরাত দিয়ে এতে বলা হয়েছে, গাড়িতে করে গাজা শহরের উত্তরাঞ্চল ছেড়ে যাওয়ার সময় ইসরায়েলি বিমান হামলায় ৭০ ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। নিহতদের অধিকাংশই নারী ও শিশু।
ইসরায়েলের হামলায় গাজায় নিহত বেড়েই চলেছে। গত ৭ অক্টোবর হামলা শুরুর পর থেকে উপত্যকাটিতে এক হাজার ৯০০ জনের মৃত্যুর খবর পাওয়া গেছে বলে আল জাজিরার প্রতিবেদনে বলা হয়েছে। আহত সাড়ে সাত হাজারের বেশি। অন্যদিকে হামাসের হামলায় ইসরায়েলে এক হাজার ৩০০ জনের মৃত্যু হয়েছে। আহত দুই হাজার ৮০০ জনেরও বেশি।
এদিকে জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মন্তব্য করেছেন যে ফিলিস্তিনিদের সরে যাওয়ার জন্য ইসরায়েলের নেয়া নতুন কোনো পদক্ষেপ ওই অঞ্চলকে আরো বিস্তৃত সংঘাতের ‘অতলে’ নিয়ে যাবে। জর্ডানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আয়মান সাফাদি এক বিবৃতিতে বলেছেন যে গাজায় মানবিক সহায়তা বন্ধ করে এবং উত্তর গাজার বাসিন্দাদের সরে যেতেন নির্দেশ দিয়ে ইসরায়েল আন্তর্জাতিক আইন ভঙ্গ করেছে।
গাজা থেকে মানুষ স্থানান্তর যুদ্ধাপরাধ, বলছেন নরওয়েজিয়ান কূটনীতিক জ্যান এগেল্যান্ড। অসলো চুক্তির একজন সমন্বয়ক ও ফিলিস্তিন-ইসরায়েলের মধ্যে আলোচনা প্রক্রিয়া শুরু করার পেছনে ভূমিকা রাখা এই কূটনীতিক মন্তব্য করেছেন যে উত্তর গাজা থেকে বাসিন্দাদের সরিয়ে দেয়ার নির্দেশ জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী যুদ্ধাপরাধের শামিল। বিবিসির রেডিও ফোর অনুষ্ঠানকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে তিনি বলেছেন গাজায় হতে যাওয়া মানবিক ‘বিপর্যয়’ সামাল দেয়ার কোনো কার্যকরী পন্থা এখন নেই।
তিনি মন্তব্য করেছেন: ধ্বংসস্তূপের নিচে এখনো অনেক শিশু রয়েছে, সেখানকার কারো পক্ষে তাদের উদ্ধার করা সম্ভব নয়। বসবাসের অযোগ্য হাজার হাজার ঘরবাড়ি রয়েছে। হাজার হাজার মানুষ জীবন বাঁচাতে পালাচ্ছে। পশ্চিমারা এখনো ওই অঞ্চলের পরিস্থিতি ঠিকমতো বুঝে উঠতে পারেনি বলে মন্তব্য করেছেন তিনি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য