- জেরুজালেমে ইরান, হিজবুল্লাহ ও হুতির হামলা
- তেল আবিবে বন্দুক হামলা
- তেহরানকে কড়া হুঁশিয়ারি নেতানিয়াহুর
এবার যুদ্ধবাজ ইসরায়েলে চতুর্মুখী হামলা হয়েছে। গত মঙ্গলবার রাতে ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে ইরান। লেবাননের সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহ হত্যার প্রতিশোধ নিতে এ হামলা চালানো হয়। লেবানন থেকেও ক্ষেপণাস্ত্র হামলা করেছে সশস্ত্র হিজবুল্লাহ। গতকাল বুধবার এ হামলায় ইসরায়েলের দুই সেনা নিহত এবং বেশ কয়েকজন আহত হয়েছে বলে জানা গেছে। যদিও ইসরায়েল এক সেনা নিহতের কথা জানিয়েছে। এদিকে দেশটিতে হুতি বিদ্রোহীরাও মঙ্গলবার রাতে রকেট হামলা চালিয়েছে। শুধু তা-ই নয়; দেশটির রাজধানী তেল আবিবে ছুরি ও বন্দুক নিয়ে এদিন সন্ধ্যায় হামলা চালানো হয়েছে। এতে প্রাণ গেছে অন্তত ৮ জনের। ফলে হামলায় পর্যদস্তু হয়ে পড়েছে দেশটি। তাদের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু রাতেই মন্ত্রিসভার বৈঠকে ইরানকে চরম মূল্য দিতে হবে বলে হুমকি দিয়েছেন। তারা দেশটিতে হামলা ছক কষছেন বলে বিভিন্ন সূত্র জানিয়েছে। এতে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে যুদ্ধ ছড়িয়ে পড়ার আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। খবর রয়টার্স, বিবিসি, সিএনএন ও আল-জাজিরার।
গতকাল হুতির সামরিক মুখপাত্র ইয়াহিয়া সারি বলেছেন, ইসরায়েলি সামরিক চৌকি লক্ষ্যবস্তু করে তিনটি ডানাযুক্ত ‘কুদস ৫’ রকেট ছুড়েছে হুতিরা। তবে ইয়েমেন থেকে রকেট নিক্ষেপের বিষয়ে ইসরায়েলি সেনাবাহিনীর পক্ষ থেকে কোনো ঘোষণা আসেনি। মঙ্গলবার বাংলাদেশ সময় রাত ১০টা ৩০ মিনিটের পর ইসরায়েলে প্রায় ২০০ ব্যালিসটিক ও হাইপারসনিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালায় ইরান। এর কয়েকটি ইসরায়েলের ভূমিতে আঘাত হেনেছে। বহু ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরোধ করতে সক্ষম হয়েছে ইসরায়েলের ক্ষেপণাস্ত্র প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা। এদিকে, ইসরায়েলের বাণিজ্যিক রাজধানী তেল আবিবের জাফা এলাকায় বন্দুক ও ছুরি হামলার এক ঘটনায় দুই হামলাকারীসহ নয়জন নিহত হয়েছেন। মঙ্গলবার স্থানীয় সময় সন্ধ্যার এ ঘটনায় আরও অন্তত আটজন আহত হয়েছেন বলে ইসরায়েলি গণমাধ্যম টাইমস অব ইসরায়েল জানিয়েছে। এ ঘটনাকে কয়েক বছরের মধ্যে ইসরায়েলে ঘটা সবচেয়ে প্রাণঘাতী ‘সন্ত্রাসী’ হামলা বলে বর্ণনা করেছে ইসরায়েলি পুলিশ। দুই হামলাকারীর মধ্যে একজনের কাছে রাইফেল ও অপরজনের কাছে ছুরি ছিল বলে জানা গেছে। তারা তেল আবিব লাইট ট্রেনে বেসামরিকদের ওপর আক্রমণ করে, তারপর ট্রেন থেকে নেমে হাঁটতে হাঁটতে নগরীর জেরুজালেম স্ট্রিটে বিভিন্ন লোকজনের ওপর গুলি ছোড়ে ও ছুরি দিয়ে আঘাত করে। এরই এক পর্যায়ে নগর কর্তৃপক্ষের এক নিরাপত্তা কর্মকর্তা ও বেসামরিক ইসরায়েলিরা তাদের গুলি করে হত্যা করে, জানিয়েছে পুলিশ। দুই হামলাকারীকে মোহাম্মদ খালাফ সাহের রজব ও হাসান মোহম্মদ হাসান তামিমি বলে শনাক্ত করা হয়েছে। তাদের উভয়েই ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরের হেবরন শহরের বাসিন্দা ছিলেন। আহতদের তেল আবিবের দুটি হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তাদের পরিচয় তাৎক্ষণিকভাবে প্রকাশ করা হয়নি।
ঘটনাটি কয়েক বছরের মধ্যে ইসরায়েলে হওয়া অন্যতম প্রাণঘাতী একক হামলা। শেষ খবর পর্যন্ত কোনো গোষ্ঠী এ হামলার দায় স্বীকার করেনি। মঙ্গলবার রাতে ইসরায়েলজুড়ে ইরানের ব্যাপক ক্ষেপণাস্ত্র হামলার অল্প কিছুক্ষণ আগে ঘটনাটি ঘটে। গাজা যুদ্ধের এক বছর পূর্তির আগে লেবাননে ইসরায়েলি বাহিনী স্থল আক্রমণ শুরুর এ সময়টিতে পুরো অঞ্চলজুড়ে তীব্র উত্তেজনা বিরাজ করছে। স্থল আক্রমণ শুরুর আগে বৈরুতে ব্যাপক বিমান হামলা চালিয়ে ইসরায়েল লেবাননের প্রভাবশালী সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহর প্রধান হাসান নাসরাল্লাহসহ এর নেতৃবৃন্দকে হত্যা করে। ইসরায়েলের পুলিশ কমিশনার দানিয়েল লেভি তেল আবিবের হামলাস্থল পরিদর্শন করার পর সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, এ হামলার বিষয়ে পুলিশের কাছে আগাম কোনো গোয়েন্দা তথ্য ছিল না। এক প্রত্যক্ষদর্শী ওয়াইনেট নিউজকে বলেছেন, আমরা ধারাবাহিক গুলির শব্দ শুনছিলাম। শঙ্কা নিয়ে আমরা বাইরে এসে দেখি, দুই ব্যক্তি রাস্তা দিয়ে দৌঁড়ে যাচ্ছে, তারাই হামলা চালাচ্ছিল। এটা তাকিয়ে দেখা খুব কষ্টের ছিল। এই হামলার পর ইসরায়েলের কট্টরপন্থি অর্থমন্ত্রী বেজালের স্মোট্রিচ সামাজিক মাধ্যম এক্স এ লিখেছেন, তিনি ওই দুই হামলাকারীর পরিবারকে ‘গাজায় নির্বাসনে পাঠাতে’ ও হেবরনে তাদের বাড়ি গুঁড়িয়ে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন।
আরও যুদ্ধের আশঙ্কা: ইসরায়েলের ওপর ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শেষ করার ঘোষণা দিয়ে আর উস্কানি না দেওয়ার জন্য সতর্ক করেছে ইরান; কিন্তু ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্র তেহরানের বিরুদ্ধে প্রতিশোধ নেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেওয়ায় বিস্তৃত একটি যুদ্ধের আশঙ্কা আরও গভীর হয়েছে। গতকাল বুধবার সামাজিক মাধ্যম এক্স এ এক পোস্টে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী আব্বাস আরাকচি বলেছেন, আমাদের পদক্ষেপ শেষ হয়েছে, যদি না ইসরায়েলি শাসক আরও প্রতিশোধের আমন্ত্রণ জানানোর সিদ্ধান্ত নেয়। সেক্ষেত্রে আমাদের জবাব আরও জোরালো ও শক্তিশালী হবে।
ওয়াশিংটন জানিয়েছে, মঙ্গলবারের হামলার জন্য ইরানকে ‘গুরুতর পরিণতির’ মুখোমুখি করা নিশ্চিত করতে যুক্তরাষ্ট্র দীর্ঘদিনের মিত্র ইসরায়েলের সঙ্গে কাজ করবে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা সংস্থা মধ্যপ্রাচ্যের পরিস্থিতি নিয়ে আলোচনার জন্য বুধবার এক বৈঠক ডেকেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ) অবিলম্বে যুদ্ধবিরতির জন্য সংশ্লিষ্ট দেশগুলোর প্রতি আহ্বান জানিয়েছে। ইসরায়েল গতকাল ভোররাতে লেবাননের ইরান সমর্থিত সশস্ত্রগোষ্ঠী হিজবুল্লাহর দক্ষিণ বৈরুতের অবস্থানগুলোতে ফের বোমা হামলা শুরু করেছে। ইসরায়েল জানিয়েছে, গোষ্ঠীটির লক্ষ্যস্থলগুলোতে অন্তত একডজন বিমান হামলা চালানো হয়েছে। রয়টার্স জানিয়েছে, ইসরায়েলের হামলার পর বৈরুতের দক্ষিণাংশের এলাকাগুলো থেকে বড় ধরনের ধোঁয়ার কুণ্ডুলি উঠতে দেখা গেছে।
বাসিন্দাদের ওই সব এলাকা ছেড়ে চলে যেতে নতুন করে নির্দেশ দিয়েছে ইসরায়েল। তবে এর আগেই কয়েকদিন ধরে চলা ব্যাপক ইসরায়েলি বোমা হামলার মুখে লোকজন ঘরবাড়ি ছেড়ে চলে যাওয়ায় এলাকাগুলো প্রায় লোকশূন্য হয়ে আছে। ইরানের এ হামলাকে এখন পর্যন্ত ইসরায়েলের বিরুদ্ধে সবচেয়ে বড় সামরিক ধাক্কা হিসেবে বিবেচনা করা হচ্ছে। হামলার সময় পুরো ইসরায়েলজুড়ে সতর্কতামূলক সাইরেনের শব্দ শোনা গেছে। দেশটির সব মানুষকে বোম্ব শেল্টারে আশ্রয় নেওয়ার পরামর্শ দেওয়া হয়। এর মধ্যেই জেরুজালেম ও জর্ডান নদী উপত্যকায় বিস্ফোরণের শব্দ শোনা যায়।
ইসরায়েলি কর্তৃপক্ষের দাবি, এ হামলায় ইসরায়েলের কেউ হতাহত না হলেও অধিকৃত পশ্চিম তীরে এক ফিলিস্তিনি নিহত হয়েছেন। ইরান এই হামলাকে ‘আত্মরক্ষামূলক’ বলে বর্ণনা করে জানিয়েছে, শুধু ইসরায়েলি সামরিক স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে হামলাটি চালানো হয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রায়ত্ত গণমাধ্যম বলেছে, ইসরায়েলের তিনটি সামরিক ঘাঁটি লক্ষ্য করে ক্ষেপণাস্ত্রগুলো ছোড়া হয়েছিল। তেহরান জানিয়েছে, হিজবুল্লাহর নেতা হাসান নাসরাল্লাহকে হত্যা এবং গাজা ও লেবাননে আগ্রাসন চালানোর দায়ে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে এ হামলা চালানো হয়েছে। ইসরায়েলের সামরিক বাহিনীর মুখপাত্র রিয়ার অ্যাডমিরাল দানিয়েল হ্যাগারি এক্স এ পোস্ট করা এক ভিডিওতে বলেছেন, ইরানের হামলা মোকাবিলায় ইসরায়েল এয়ার ডিফেন্স সচল করে আর অধিকাংশ ক্ষেপণাস্ত্র ইসরায়েল ও যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বাধীন প্রতিরক্ষা জোট বাধা দিয়ে ধ্বংস করে। ইরানের হামলা একটি মারাত্মক ও বিপজ্জনক উস্কানি। ইসরায়েলের প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু পাল্টা আঘাত হানার প্রত্যয় জানিয়েছেন। মঙ্গলবার রাতে জরুরি রাজনৈতিক নিরাপত্তা মন্ত্রিসভার বৈঠকের পর দেওয়া বিবৃতিতে তিনি বলেন, আজ (মঙ্গলবার) রাতে ইরান একটি বড় ভুল করেছে আর এর জন্য তাদের মূল্য চুকাতে হবে। এক বিবৃতিতে ইরানের সশস্ত্র বাহিনীর জেনারেল স্টাফ বলেছে, ইসরায়েলের যেকোনো জবাবে দেশটির অবকাঠামোর ‘ব্যাপক ধ্বংসসাধন’ করা হবে। ইসরায়েলের যে মিত্ররাই তাদের সঙ্গে যোগ দেবে তাদের আঞ্চলিক সম্পদও ইরানের হামলার লক্ষ্য হতে পারে বলে সতর্ক করেছে তারা। এসব পাল্টাপাল্টি বিবৃতি ও হুমকি ধামকির কারণে ইরান ও যুক্তরাষ্ট্র জড়িয়ে পড়ে মধ্যপ্রাচ্যজুড়ে বড় ধরনের যুদ্ধের সূচনা ঘটাতে পারে বলে আশঙ্কা তীব্র হয়ে উঠেছে।
প্রতিশোধের হুমকি ইসরায়েলের: মধ্যপ্রাচ্যের মরুপ্রান্তরে সাম্প্রতিক সময়ে সমরশক্তি প্রদর্শন করা ইসরায়েলের তেলআবিব, জেরুজালেমসহ কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ শহরে দুই দফায় ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে দেশটির প্রধান আঞ্চলিক প্রতিদ্বন্দ্বী ইসলামি প্রজাতান্ত্রিক ইরান। ইরানকে এই হামলার ‘ফল ভোগ করতে হবে’ বলে ইসরায়েল জবাব দেওয়ার যে হুমকি দিয়েছে, তাতে মধ্যপ্রাচ্যে বড় যুদ্ধের শঙ্কা আরও গভীর হচ্ছে। এরই মধ্যে কূটনৈতিক পর্যায়ে বিশ্বজুড়ে এর প্রভাব ছড়িয়ে পড়েছে। কয়েকশ ক্ষেপণাস্ত্রের আঘাতে ইসরায়েলের বিভিন্ন অঞ্চল কেঁপে উঠেছে বলে খবর এলেও হতাহতের কোনো তথ্য দেয়নি আন্তর্জাতিক সংবাদমাধ্যমগুলো। তাদের সর্বশেষ খবরে বলা হচ্ছে, রাতের মত আঘাত করা স্থগিত করেছে তেহরান। মঙ্গলবার রাত ৮টার পর ইরানের বিপ্লবী রক্ষাবাহিনী-আইআরজিসি দেশটির সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনির নির্দেশে এই হামলা চালায় বলে ইরানি সংবাদমাধ্যমগুলোর খবরে বলা হয়েছে। রেডিও তেহরান বলছে, চার শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়েছে আইআরজিসি, যার মধ্যে অত্যাধুনিক শ্রেণির অস্ত্রও রয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় টেলিভিশনকে আইআরজিসি বলেছে, এই প্রথম ইসরায়েলে তারা হাইপারসনিক শ্রেণির ‘ফাতাহ’ ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে আঘাত হেনেছে। হামলার আগেই ইসরায়েলকে এমন সতর্কবার্তা দিয়েছিল যুক্তরাষ্ট্র; যাতে বলা হয়েছিল, যে কোনো মুহূর্তে অত্যাধুনিক ক্ষেপণাস্ত্র দিয়ে হামলা করতে পারে তেহরান। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তাদের সে বার্তাই সত্য হল। আর এই হামলার মধ্য দিয়ে নড়ে উঠল জাতিসংঘ থেকে যুক্তরাষ্ট্র ও ইউরোপীয় ইউনিয়নের কূটনীতি। বুধবারই এই বিষয়ে আলোচনায় বসছে জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদ। মার্কিন আইনপ্রণেতারাও এ নিয়ে প্রেসিডেন্ট জো বাইডেনের সঙ্গে কথা বলেছেন। শুধু তাই নয়, যুক্তরাষ্ট্রের সামরিক বাহিনী ইসরায়েলের আকাশে তেহরানের ছোড়া ক্ষেপণাস্ত্র ধ্বংস করে তাদের পাশে দাঁড়িয়েছে এবং যে কোনো প্রয়োজনে দেশটির পাশে থাকার অঙ্গীকার পুনর্ব্যক্ত করেছে ওয়াশিংটন। ইসরায়েলি সংবাদমাধ্যম দ্য হার্টৎজ লিখেছে, হামলার সতর্কতা হিসেবে সাইরেন বেজে ওঠার সঙ্গে সঙ্গেই ইসরায়েলিরা ক্ষেপণাস্ত্রনিরোধী বাঙ্কারে আশ্রয় নেয়, অন্যরা রাস্তায়, দোকানে যে যেখানে ছিল সেখানেই মাটিতে বা মেঝেতে শুয়ে পড়ে। টেলিভশন স্টেশনে ইসরায়েলি সাংবাদিকদের মেঝেতে শুয়ে পড়তে দেখা যায়, যার ছবি ও ভিডিও প্রকাশ করেছে হার্টৎজ। আইআরজিসি চার শতাধিক ক্ষেপণাস্ত্র ছোড়ার কথা বললেও ইসরায়েলি প্রতিরক্ষা বাহিনী-আইডিএফের কর্মকর্তাদের উদ্ধৃতি দিয়ে হার্টৎজ লিখেছে, ইরান থেকে ১৮০টির মত ক্ষেপণাস্ত্র এসেছে। এগুলোর বেশিরভাগই ক্ষেপণাস্ত্রবিধ্বংসী অস্ত্র দিয়ে আকাশেই বিস্ফোরণ ঘটানো হয়েছে। রেডিও তেহরান বলেছে, সামাজিক মাধ্যমে ছড়িয়ে পড়া ভিডিওতে দেখা গেছে বৃষ্টির মত ইসরাইলের বিভিন্ন স্থানে আঘাত হানছে ক্ষেপণাস্ত্র। পুরো ইসরাইল ইরানি ক্ষেপণাস্ত্রের আওতায় এসেছে এবং দেশটির রাজধানী তেল আবিবসহ বিভিন্ন শহরে বিকট বিস্ফোরণের শব্দ শোনা গেছে। আইআরজিসি বলেছে, আত্মরক্ষার তাগিদে তারা এই হামলা চালিয়েছে। ক্ষেপণাস্ত্র উৎক্ষেপণের পরপরই আইআরজিসি এক সংক্ষিপ্ত বিবৃতিতে বলে ‘ক্ষেপণাস্ত্র হামলা শুরু’।
মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ভাইস প্রেসিডেন্ট কামালা হ্যারিস এরই মধ্যে বৈঠক করেছেন। বাইডেন ইসরাইল অভিমুখী ক্ষেপণাস্ত্র ভূপাতিত করার জন্য মার্কিন সেনাদের নির্দেশ দেন। ক্ষেপণাস্ত্র হামলার পর ইসরাইলের সমস্ত বিমানবন্দর বন্ধ করে দেওয়া হয়। জর্ডান ও ইরাকের বিমানবন্দরেও বিমান ওঠানামা সাময়িকভাবে স্থগিত রাখা হয়।
সেনা নিহতের ঘোষণা ইসরায়েলের: ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ এক বিবৃতিতে বলেছে, লেবাননে লড়াইয়ের সময় ২২ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন ইতান ইতঝাক ওস্তার নিহত হয়েছেন। লেবাননে স্থলযুদ্ধে হিজবুল্লাহ যোদ্ধাদের সঙ্গে মুখোমুখি লড়ছে ইসরায়েলের সেনারা। এই লড়াইয়ে ইসরায়েল বুধবার তাদের প্রথম এক সেনা নিহতের খবর জানিয়েছে। ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা বাহিনী আইডিএফ এক বিবৃতিতে বলেছে, লেবাননে লড়াইয়ের সময় ২২ বছর বয়সী ক্যাপ্টেন ইতান ইতঝাক ওস্তার নিহত হয়েছেন। তিনি ছিলেন সেনাবাহিনীর অভিজাত কমান্ডো ইউনিট ‘ইগোজ’ এর স্কোয়াড কমান্ডার।
হিজবুল্লাহ জানিয়েছে, তাদের যোদ্ধারা মারুন আল রেস সীমান্ত শহরে ইসরায়েলি সেনাদের সঙ্গে সংঘর্ষে লিপ্ত হয়েছে। লেবাননের মাটিতে সংঘর্ষ হওয়ার কথা এই প্রথম জানাল হিজবুল্লাহ। আরেকটি সীমান্ত শহরে ইসরায়েলি বাহিনীকে পিছু হটিয়ে দেওয়ার কথাও জানায় তারা। তাছাড়া, ইসরায়েলের ভেতরে সামরিক ফাঁড়িগুলোতে রকেট ছোড়া হয়েছে বলেও হিজবুল্লাহ জানিয়েছে। হিজবুল্লাহর মিডিয়া চিফ মোহাম্মদ আফিফ বলেন, এটি সংঘর্ষের শুরু মাত্র। ইসরায়েলকে পিছু হটিয়ে দিতে হিজবুল্লাহর যথেষ্ট যোদ্ধা, অস্ত্র ও গোলাবারুদ আছে। ওদিকে, ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বলেছে, তাদের নিয়মিত পদাতিক বাহিনী এবং সাঁজোয়া ইউনিট লেবাননে স্থল অভিযানে যোগ দিচ্ছে। গোলানি ব্রিগেড, ১৮৮ সাঁজোয়া ব্রিগেড এবং ষষ্ঠ পদাতিক ব্রিগেডসহ ৩৬ তম ডিভিশন থেকে ইসরায়েলের আরও পদাতিক বাহিনী এবং সশস্ত্র সেনা সংঘর্ষে যোগ দেওয়া মানে এই অভিযান আর সীমিত কমান্ডো অভিযানে সীমাবদ্ধ নাও থাকতে পারে।
যদিও ইসরায়েলের সেনাবাহিনী বলছে, লেবাননে তাদের ঢুকে পড়ে যুদ্ধ করার লক্ষ্য হচ্ছে সীমান্তে সুড়ঙ্গ ও অন্যান্য অবকাঠামো ধ্বংস করা। রাজধানী বৈরুত কিংবা লেবাননের দক্ষিণাঞ্চলের অন্যান্য বড় নগরী লক্ষ্য করে বৃহত্তর অভিযান চালানোর পরিকল্পনা তাদের নেই।
ইরানে হামলার ছক কষছে ইসরায়েল: ইসরায়েলের বিমানবন্দর ও ডিমোনা এলাকার পারমাণবিক গবেষণা কেন্দ্রের মতো স্পর্শকাতর কৌশলগত স্থাপনাগুলো লক্ষ্য করে ব্যালিস্টিক ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়েছে ইরান। এসব ক্ষেপণাস্ত্রের অধিকাংশকে আকাশেই ধ্বংস করে দেওয়া হলেও এটিকে সংঘাতের উল্লেখযোগ্য বৃদ্ধি হিসেবে বিবেচনা করছে ইসরায়েল। ইসরায়েলি বিমান বাহিনী, তাদের আকাশ প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা ও যুক্তরাষ্ট্রের সেন্ট্রাল কমান্ডের (সেন্টকম) মধ্যে নিবিড় সমন্বয়কেই ইরানের হামলা ব্যর্থ করে দেওয়ার কৃতিত্ব দেওয়া হচ্ছে। এ হামলায় অল্প কয়েকজন আহত হওয়া ছাড়া বড় ধরনের কোনো ক্ষয়ক্ষতি হয়নি বলে দাবি ইসরায়েলের। এই নিয়ে দ্বিতীয়বারের মতো ইসরায়েলে সরাসরি হামলা চালাল ইরান। তেহরানের দাবি, তারা ইসরায়েলের প্রতিরক্ষা ব্যবস্থা অকার্যকর করে দিতে দেশটির বিমান ঘাঁটি ও রাডার সিস্টেমগুলোকে লক্ষ্যস্থল করেছে।
ইসরায়েলের বহুদর্শী যুদ্ধ সাংবাদিক রন বেন-ইশাই ওয়াইনেট নিউজে এক মতামত কলামে লিখেছেন, ইরান এখন গাজা, লেবাবন ও পশ্চিম তীরের মতো ইসরায়েলের এক প্রাথমিক মনোযোগে পরিণত হয়েছে। প্রায় এক টন ওজনের বোমা যুক্ত ক্ষেপণাস্ত্র ছুড়ে কৌশলগত স্থাপনাগুলোকে লক্ষ্যস্থল করার পাশাপাশি ইসরায়েলজুড়ে আতঙ্ক ছড়িয়েছে ইরান। তাই ইসরায়েলকে অবশ্যই তাদের প্রতিক্রিয়া বৃদ্ধি করতে হবে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য