হিরোশিমা আর নাগাসাকিতে পারমাণবিক বোমা হামলার ধ্বংসযজ্ঞ থেকে বেঁচে যাওয়া মানুষের হাত ধরে যে তৃণমূল সংগঠনের সূচনা হয়েছিল, সেই ‘নিহোন হিদাংকিয়ো’ পাচ্ছে এবারের শান্তির নোবেল। নরওয়ের নোবেল ইনস্টিটিউট গতকাল শুক্রবার অসলোতে এক সংবাদ সম্মেলনে ১০৫তম নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য এ সংগঠনের নাম ঘোষণা করে। এ পুরস্কারের অর্থমূল্য এবার ১ কোটি ১০ লাখ সুইডিশ ক্রোনার।
পুরস্কারের ঘোষণায় নোবেল কমিটি বলেছে, পারমাণবিক অস্ত্রমুক্ত বিশ্ব গড়ার লড়াইয়ে যে ভূমিকা নিহোন হিদাংকিয়ো রেখে চলেছে, তার স্বীকৃতিতেই শান্তির নোবেল দেয়া হচ্ছে এ সংগঠনকে। প্রত্যক্ষদর্শীদের সাক্ষ্য তুলে ধরে তারা দেখিয়েছে, এই পৃথিবীতে কেন আর কখনো পারমাণবিক অস্ত্র ব্যবহার করা চলবে না। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের শেষভাগে ১৯৪৫ সালের ৬ অগাস্ট জাপানের হিরোশিমায় একটি পারমাণবিক বোমা ফেলে যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিনিরা সেই বোমার নাম দিয়েছিল ‘লিটল বয়’। প্রায় ১২ থেকে ১৫ হাজার টন টিএনটির সমান শক্তির ওই বোমার বিস্ফোরণে দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে যত স্থাপনা ছিল সবই মাটির সঙ্গে মিশে যায়। চোখের নিমিশে পুড়ে ছাই হয়ে যায় শহরের অধিকাংশ স্থান। বিশ্বের প্রথম সেই পারমাণবিক বোমা হামলায় ১ লাখ ৪০ হাজার মানুষের প্রাণ যায়। তিনদিন পর প্রায় ৩০০ কিলোমিটার দূরে নাগাসাকি শহরে আরেকটি পারমাণবিক বোমার বিস্ফোরণ ঘটায় যুক্তরাষ্ট্র, যার নাম তারা দিয়েছিল ফ্যাট ম্যান। ৪ হাজার ৬৩৩ কেজি ওজনের ওই বোমার বিস্ফোরণে নাগাসাকি শহরও পুড়ে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়। মৃত্যু হয় আরও প্রায় ৭৬ হাজার মানুষের। মূলত ওই হামলার মধ্য দিয়ে সমাপ্তি ঘটে দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের। কিন্তু পারমাণবিক বোমার তেজস্ক্রিয়ায় বিভিন্ন রোগে ভুগে দুই শহরে চার লাখের মত মানুষ মারা যায়। বহু বছর পরও দুই শহরে জন্ম নেয় বিকলাঙ্গ শিশু। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ শেষে ১৯৪৯ সালে হিরোশিমাকে ঘোষণা করা হয় ‘শান্তির শহর’। নির্মিত হয় শান্তি স্মৃতি পার্ক।
হিরোশিমা ও নাগাসাকিতে যারা পারমাণবিক বোমার ক্ষত নিয়েও বেঁচে গিয়েছিলেন, জাপানি ভাষায় তাদের বলা হয় ‘হিবাকুশা’। এর অর্থ, বিস্ফোরণে বিক্ষত মানুষ। ২০০৭ সাল পর্যন্ত আড়াই লাখের বেশি হিবাকুশাকে তালিকাভুক্ত করেছিল জাপান সরকার।
এই হিবাকুশারাদের একটি স্থানীয় সংগঠন প্রশান্ত মহাসাগরীয় অঞ্চলে পারমাণবিক বোমার পরীক্ষায় ক্ষগ্রিস্ততের সঙ্গে নিয়ে ১৯৫৬ সালে প্রতিষ্ঠা কর্র জাপান কনফেডারেশন অব এÑ অ্যান্ড এইচ-বম্ব সাফারারস অর্গানাইজেশন, যাকে জাপানি ভাষায় সংক্ষেপে বলা হয় ‘নিহোন হিদাংকিয়ো’। তারপর থেকে হিরোশিমা ও নাগাসাকির বোমা হামলায় ক্ষগ্রিস্তদের সহায়তার পাশাপাশি পারমাণবিক অস্ত্র বিলোপের পক্ষে জোরালো আন্দোলন চালিয়ে আসছে এ সংগঠন।
নরওয়ের নোবেল ইনস্টিটিউট বলছে, ‘নিহোন হিদাংকিয়ো’ পরে পরিণত হয় একটি বৈশ্বিক আন্দোলনে। পারমাণিক বোমার ব্যবহার যে ভয়ঙ্কর পরিণতি ডেকে আনে, সে বিষয়ে সচেতনতা তৈরিতে নিরলস কাজ করে যাচ্ছেন এ সংগঠনের কর্মীরা। তাদের আন্দোলনে শক্তিশালী একটি আন্তর্জাতিক চেতনা তৈরি হয়েছে। পারমাণবিক বোমার ব্যবহার এখন আর নৈতিকভাবে সমর্থনযোগ্য নয়। সেই চেতনা পরিচিতি পেয়েছে ‘নিউক্লিয়ার ট্যাবু’ হিসেবে।
নোবেল কমিটি বলেছে, হিবাকুশাদের অভিজ্ঞতার যে মর্মস্পর্শী বয়ান ‘নিহোন হিদাংকিয়ো’ বিশ্বের সামনে তুলে ধরেছে, সেইসব টুকরো গল্প পারমাণবিক বোমার বিরুদ্ধে একটি শক্তিশালী জনমত গড়ে তুলতে ভূমিকা রেখেছে। যা বলা যায় না, তা বলতে; যা ভাবা যায় না, তা ভাবতে আমাদের সাহায্য করেছেন এই হিবাকুশারা। পারমাণবিক বোমার কারণে যে অবর্ণনীয় যন্ত্রণা আর দুর্ভোগের জন্ম হয়েছে, তা প্রশমিত করতে সহায়ক হয়েছে হিবাকুশাদের উদ্যোগ।
তারপরও বিশ্বের শক্তিশালী দেশগুলো যে ক্রমাগত পারমাণবিক বোমার উন্নয়ন ঘটিয়ে নিজেদের অস্ত্র ভাণ্ডার সমৃদ্ধ করে চলেছে, নতুন নতুন দেশ যে এই অস্ত্রের মালিক হওয়ার চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে, এমনকি যুদ্ধের মধ্যে পারমাণবিক বোমা ব্যবহার হুমকিও য়ে দেয়া হচ্ছে, সেই সত্যও মনে করিয়ে দিয়েছে নোবেল কমিটি।
ইনস্টিটিউটের বিবৃতিতে বলা হয়েছে, মানব ইতিহাসের এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আমাদির উচিত নিজেদের মনে করিয়ে দেয়া যে পারমাণবিক অস্ত্রই হলো বিশ্বের ইতিহাসে সবচেয়ে ধ্বংসাত্মক অস্ত্র।
আগামী বছর যে হিরোশিমা-নাগাসাকির ধ্বংসযজ্ঞের ৮০ বছর পূর্ণ হচ্ছে, সে কথা মনে করিয়ে দিয়ে নোবেল কমিটি বলেছে, এখনকার পারমাণবিক অস্ত্রের ধ্বংসক্ষমতা বহুগুণ বেশি। সে সব অস্ত্র কোটি মানুষের প্রাণহানি ঘটাতে পারে, প্রকৃতিতে ডেকে আনতে পারে দুর্যোগ। এমনকি একটি পারমাণবিক যুদ্ধ এই মানব সভ্যতা ধ্বংসের কারণ হয়ে উঠতে পারে। আলফ্রেড নোবেলের দর্শনের মূল কথা ছিল, প্রতিজ্ঞাবদ্ধ মানুষ এই পৃথিবীর সত্যিকারের পরিবর্তন ঘটাতে পারে। চলতি বছরের নোবেল শান্তি পুরস্কারের জন্য ‘নিহোন হিদাংকিয়ো’র নাম ঘোষণার মধ্য দিয়ে নরওয়ের নোবেল কমিটি সেই সব বোমার বিক্ষত মানুষকে সম্মান জানাতে চায়, যারা শারীরিক কষ্ট আর ভয়ঙ্কর স্মৃতিকে পাশে রেখে শান্তি প্রতিষ্ঠা আর আশা জাগিয়ে রাখার চেষ্টায় নিজেদের অভিজ্ঞতাকে নিয়োজিত করেছেন। একদিন ইতিহাসের সাক্ষী এই হিবাকুশাদের কেউ আর আমাদের মাঝে থাকবেন না। কিন্তু জাপানের নতুন প্রজন্ম সেই অভিজ্ঞতা আর শান্তির বার্তা বয়ে নিয়ে যাবে। পুরো বিশ্বের মানুষকে তারা উৎসাহ যোগাবে, শান্তির বাণী শেখাবে। আর এভাবেই তারা নিউক্লিয়ার ট্যাবুকে জাগিয়ে রাখবেন, যা এই মানবজাতির শান্তিপূর্ণ ভবিষ্যতের জন্য জরুরি।
বিবিসি জানিয়েছে, চলতি বছরের শান্তি পুরস্কারের জন্য ২৮৬টি মনোনয়ন পেয়েছিল নরওয়ের নোবেল ইনস্টিটিউট। তার মধ্যে ১৯৭ জন ব্যক্তি এবং ৮৯টি সংগঠন বা সংস্থা। এর মধ্যে ‘নিহোন হিদাংকিয়ো’র কাজকে শান্তি পুরস্কারের জন্য আলফ্রেড নোবেলের উইলের নির্দেশনার সঙ্গে পুরোপুরি সাযুজ্যপূর্ণ বলে মনে করেছে নোবেল কমিটি। ইরানে নারী নিপীড়নের বিরুদ্ধে লড়াই ও সবার জন্য মানবাধিকার ও স্বাধীনতার প্রচারে ভূমিকার জন্য গতবছর শান্তিতে নোবেল পেয়েছিলেন দেশটির কারাবন্দি অধিকার কর্মী নার্গিস মোহাম্মদী।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য