-->

হাতি-গাধার লড়াইয়ে শেষ হাসি কার

কে যাচ্ছেন হোয়াইট হাউসে?

সিরাজুল ইসলাম
হাতি-গাধার লড়াইয়ে শেষ হাসি কার

বিপুল উৎসাহ-উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে গতকাল মঙ্গলবার মার্কিন নির্বাচনে ভোটগ্রহণ অনুষ্ঠিত হলো। এদিন গভর্নর ও সিনেটর নির্বাচন হলেও মূল আলোচনায় রয়েছে প্রেসিডেন্ট পদটি। আগেই হাড্ডা-হাড্ডি লড়াইয়ের আভাস দিয়েছিল বিভিন্ন জরিপের ফল। কে যাচ্ছেন হোয়াইট হাউসে- রিপাবলিকান প্রার্থী ডোনাল্ড ট্রাম্প নাকি ডেমোক্র্যাট প্রার্থী কমলা হ্যারিস; তা জানার জন্য অপেক্ষা করতে হবে। কোনো সংকট না হলে আজকের মধ্যেই চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে। এ নির্বাচনে শুধু মার্কিনিদের নয়; ভবিষ্যৎ নির্ধারণ হবে সারা বিশ্বের। কেননা, অভিবাসী, জলবায়ু ও যুদ্ধবিগ্রহের মতো সংকট নিয়েই বেঁচে আছে বিশ্ববাসী। শান্তিপ্রিয় মানুষ ডেমোক্র্যাটদের সমর্থন করেন। কেননা, রিপাবলিকান শাসনামলে যুক্তরাষ্ট্রের যুদ্ধে জড়িয়ে পড়ার ইতিহাস পুরনো। তবে এর ব্যতিক্রমও রয়েছে।

সাবেক প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প জয়ের ব্যাপারে আশা প্রকাশ করে বলেছেন, তিনি কমলার বিরুদ্ধে নয়, লড়ছেন ডেমোক্র্যাটদের বিশেষ করে বর্তমান প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের ভুল নীতির বিরুদ্ধে। তরুণ ভোটাররাই তার ভরসা। কারণ তরুণরা পরিবর্তন দেখতে চান। অপর দিকে কমলা হ্যারিস বলছেন, আমরা যখন লড়ি; তখন জয়ী হই। এ নির্বাচনেও তিনি জয়ী হবেন। তবে ট্রাম্প-কমলার ভাগ্য নির্ধারণ হবে দোদুল্যমান সাত অঙ্গরাজ্য- পেনসিলভানিয়া, অ্যারিজোনা, নেভাদা, উইসকনসিন, নর্থ ক্যারোলাইনা, মিশিগান ও জর্জিয়ায়। এই রাজ্যের কোনোটিতে কমলা আবার কোনোটিতে ট্রাম্প এগিয়ে রয়েছেন। তবে জরিপে কমলা এগিয়ে রয়েছেন। দেশজুড়ে তাকে ৪৯ শতাংশ এবং ট্রাম্পকে ৪৮ শতাংশ মানুষ সমর্থন করেছেন। অনেকেই এটাকে হাতি ও গাধার লড়াই বলছেন। কারণ, রিপাবলিকান পার্টির প্রতীক হাতি এবং ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রতীক গাধা। হাতিকে শক্তি আর গাধাকে পরিশ্রমের প্রতীক ধরা হয়। এ নির্বাচনে ট্রাম্প লড়ছেন হাতি প্রতীকে আর কমলা লড়ছেন গাধা প্রতীকে। গতকাল যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও ওয়াশিংটন ডিসির ভোটাররা ভোট দিয়েছেন। বিশাল দেশ যুক্তরাষ্ট্রে ছয়টি টাইম জোন রয়েছে। ফলে বিভিন্ন অঙ্গরাজ্যে সময়ের ব্যবধান রয়েছে। তাই সব রাজ্যে সময়কে সমন্বয় করে ভোট শুরু এবং শেষ হয়। ৭ কোটি ৮০ লাখ ভোটার আগাম ভোট দিয়েছেন। আলোচনার মূলে রয়েছেন বড় দুই দলের প্রার্থী কমলা ও ট্রাম্প। ঐতিহ্যগতভাবে তারাই মূল প্রতিদ্বন্দ্বী। কমলার ভাইস প্রেসিডেন্ট হিসেবে লড়ছেন টিম ওয়ালজ আর ট্রাম্পের ভাইস প্রেসিডেন্ট থাকছেন জে ডি ভান্স। এবার আরও চারজন প্রেসিডেন্ট প্রার্থী রয়েছেন। তারা হলেন- গ্রিন পার্টির জিল স্টেইন, লিবার্টারিয়ান পার্টির চেজ অলিভার, স্বতন্ত্র প্রার্থী কর্নেল ওয়েস্ট ও রবার্ট কেনেডি জুনিয়র। বিজয়ী হতে কেউ কম প্রচারণা চালাননি। তারা সবাই দেশটির ৪৭তম প্রেসিডেন্ট হিসেবে অধিষ্ঠিত হতে চান। শুরুতে ডেমোক্র্যাটিক পার্টির প্রার্থী ছিলেন বর্তমান প্রেসিডেন্ট ৮১ বছর বয়সী জো বাইডেন। তবে ট্রাম্পের সঙ্গে বিতর্কে খারাপ করার পর বয়সজনিত কারণে দলীয় চাপে তাকে সরে দাঁড়াতে হয়। গত জুলাইয়ে তার স্থানে আসেন ভাইস প্রেসিডেন্ট কমলা হ্যারিস।

নানা জরিপের ফল বলছে, দুজনের লড়াই হবে হাড্ডা-হাড্ডি। নির্বাচনে জয়-পরাজয় ঠিক করে দিতে পারে দোদুল্যমান সাত অঙ্গরাজ্য। তাই শেষ মুহূর্তে দুজন চষে বেড়িয়েছেন এসব অঙ্গরাজ্য। সোমবার পেনসিলভানিয়ায় নির্বাচনি সমাবেশ করার কথা ছিল কমলার। এর আগে মিশিগান স্টেট ইউনিভার্সিটিতে ভাষণ দেন তিনি। মিশিগানে আরব বংশোদ্ভূত মার্কিন মুসলিম ভোটারদের কাছে টানতে তিনি বলেন, গাজা যুদ্ধ বন্ধে নিজের ক্ষমতার আওতায় সবকিছু করবেন তিনি। এদিন নর্থ ক্যারোলাইনা, পেনসিলভানিয়া ও মিশিগানে সমাবেশ করেন ৭৮ বছর বয়সী ট্রাম্প। নর্থ ক্যারোলাইনার কিনস্টোন শহরে সমাবেশে তিনি সমর্থকদের উদ্দেশে বলেন, আমরা যেসব সমস্যার মুখে পড়েছি, সেগুলো সমাধান করা সম্ভব। দেশের ভাগ্য এখন আপনাদের হাতে।

জনপ্রিয়তায় কে এগিয়ে: ২০২০ সালে জো-বাইডেন ক্ষমতায় বসার সময় চলছিল করোনা মহামারি। তখন মহামারি পরিস্থিতি শক্ত হাতে সামলেছিলেন তিনি। তবে এ করোনাই পরে গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়ায়। মার্কিন অর্থনীতিতে চাপ আসায় বেড়ে যায় দ্রব্যমূল্য। দেখা দেয় কর্মসংস্থানের অভাব। অভিবাসীদের নিয়েও শক্ত পদক্ষেপ নিতে পারেননি তিনি। এসবের জেরে তার জনপ্রিয়তা কমতে থাকে। মূলত এসব কারণেই বাইডেন ক্ষমতায় আসার কিছু সময় পর থেকে ডেমোক্র্যাটদের দীর্ঘদিনের আধিপত্য কমতে থাকে। এবারের নির্বাচনি প্রচারে নামার পর ট্রাম্পকে দুবার হত্যাচেষ্টা করা হয়েছে। এটিও তার জনপ্রিয়তা কিছুটা বাড়াতে সহায়তা করেছে। তবে রোববার সংবাদমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমস বলেছে, নানা ফৌজদারি মামলা ঘাড়ে নিয়ে চলা ট্রাম্প নির্বাচনে জিতলেও সে কৃতিত্ব তার নিজের হবে না। বাইডেন প্রশাসনের প্রতি মানুষের অসন্তোষই তার জয়ের পেছনে কাজ করবে। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্যের ৪৩টিতে কমলা নাকি ট্রাম্প- কে জিতবেন, তা অনেকটা নিশ্চিত। সমস্যা দোদুল্যমান সাত অঙ্গরাজ্য- পেনসিলভানিয়া, অ্যারিজোনা, নেভাদা, উইসকনসিন, নর্থ ক্যারোলাইনা, মিশিগান ও জর্জিয়াকে নিয়ে। এই সাত অঙ্গরাজ্যের ফল কমলা-ট্রাম্পের ভাগ্য নির্ধারণ করে দেবে। নিউইয়র্ক টাইমস-এর জনমত জরিপে দেখা গেছে, দেশজুড়ে ৪৯ শতাংশ মানুষ কমলা ও ৪৮ শতাংশ ট্রাম্পের প্রতি সমর্থন জানিয়েছেন। এ ছাড়া দোদুল্যমান অঙ্গরাজ্যগুলোর মধ্যে পেনসিলভানিয়ায় ট্রাম্প ১ শতাংশ, অ্যারিজোনায় ৪ শতাংশ, নেভাদায় ১ শতাংশ, নর্থ ক্যারোলাইনা ও জর্জিয়ায় ১ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন। কমলা উইসকনসিনে ১ শতাংশ ও মিশিগানে ১ শতাংশ ব্যবধানে এগিয়ে রয়েছেন।

কবে জানা যাবে ফল: সবকিছু ঠিকঠাক থাকলে আজই নির্বাচনের চূড়ান্ত ফলাফল জানা যাবে। তবে ঝামেলা হলে ফল জানতে কয়েক দিন লাগতে পারে। যেমন ২০২০ সালের নির্বাচনে চার দিন পর চূড়ান্ত ফল জানা গিয়েছিল। সে বছর কয়েকটি অঙ্গরাজ্যে বাইডেন ও ট্রাম্পের মধ্যে তুমুল লড়াই হয়েছিল। আবার ২০১৬ সালে ৫ নভেম্বর রাতের মধ্যেই ফল জানা যায়। ভোটাররা মূলত ইলেকটোরাল কলেজ নির্বাচিত করবেন। আগামী ১৭ ডিসেম্বর তাদের ভোটে প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবেন। যুক্তরাষ্ট্রে মোট ইলেকটোরাল কলেজের ভোটের সংখ্যা ৫৩৮। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে একজন প্রার্থীকে ২৭০টি ভোট পেতে হয়। এই ভোট আবার ২০২৫ সালের ৬ জানুয়ারি যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের প্রতিনিধি পরিষদে গণনা করা হবে। সেদিন আনুষ্ঠানিকভাবে নির্বাচিত হবেন নতুন প্রেসিডেন্ট। এরপর ২০ জানুয়ারি শপথ নিয়ে পাকাপাকিভাবে হোয়াইট হাউসে বসবেন তিনি।

জয় যেভাবে নির্ধারিত: যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্সিয়াল পদ্ধতির গণতান্ত্রিক ব্যবস্থায় এ নির্বাচনে সবচেয়ে বেশি ভোট পাওয়া প্রার্থীই যে জয়ী হবেন, এমন নিশ্চয়তা নেই। একজন প্রার্থী তুলনামূলক কম ভোট পেয়েও প্রেসিডেন্ট হতে পারেন। এর মূলে আছে দেশটির নির্বাচন ব্যবস্থায় ‘ইলেকটোরাল কলেজ’ নামের ২০০ বছর পুরনো একটি বিশেষ পদ্ধতি। এই ইলেকটোরাল কলেজে যিনি ভালো ফল করেন তার হাতেই যায় হোয়াইট হাউসের চাবি। এ নির্বাচন ব্যবস্থায় ভোটারদের সরাসরি ভোটে না বরং প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হন পরোক্ষ ভোটে। দেশটির প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে জয়ী হতে প্রার্থীকে সাধারণত দুই ধরনের ভোটে জিততে হয়। এর একটি নাগরিকদের সরাসরি ভোট; যা ‘পপুলার ভোট’ হিসেবে পরিচিত। আরেকটি হচ্ছে ইলেকটোরাল কলেজ ভোট। এই দুটির মধ্যে ইলেকটোরাল কলেজের ভোটেই প্রার্থীর চূড়ান্ত জয়-পরাজয় নির্ধারিত হয়। এ ব্যবস্থায় প্রার্থীদের জয়-পরাজয় জাতীয়ভাবে না হয়ে নির্ধারিত হয় একেকটি অঙ্গরাজ্যের নির্বাচনি লড়াইয়ের মাধ্যমে। দুটি ব্যতিক্রম ছাড়া কোনো অঙ্গরাজ্যে পপুলার ভোটে জয়ী হওয়ার অর্থ একজন প্রার্থী সেই অঙ্গরাজ্যের সব ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পাবেন। চার বছর আগে ডেমোক্র্যাট পার্টির প্রার্থী জো-বাইডেন নির্বাচনে জয়ী হয়েছিলেন, প্রতিদ্বন্দ্বী রিপাবলিকান পার্টির প্রার্থী তৎকালীন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প হেরেছিলেন। ওই নির্বাচনে বাইডেন ৩০৬টি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে যুক্তরাষ্ট্রের ৪৬তম প্রেসিডেন্ট হন। হেরে যাওয়া ট্রাম্প পেয়েছিলেন ২৩২টি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট।

বাইডেন আট কোটি ১২ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেয়েছিলেন; যা যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে কোনো প্রার্থীর পাওয়া সর্বোচ্চ ভোট। এর বিপরীতে ট্রাম্প পেয়েছিলেন সাত কোটি ৪২ লাখের বেশি ভোট। কিন্তু এর আগেরবার ২০১৬ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ডেমোক্র্যাট প্রার্থী হিলারি ক্লিনটন রিপাবলিকান প্রতিদ্বন্দ্বী ডোনাল্ড ট্রাম্পের চেয়ে ৩০ লাখের বেশি পপুলার ভোট পেলেও ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে হেরে পরাজিত হয়েছিলেন।

ইলেকটোরাল ভোট: যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভোটাররা তাদের ভোট প্রয়োগের মাধ্যমে একদল কর্মকর্তাকে নির্বাচিত করে থাকেন। তাদের বলা হয় ইলেকটর। এই ইলেকটররাই নির্বাচকের ভূমিকা পালন করেন। একটি রাজ্যের ইলেকটরদের একসঙ্গে ইলেকটোরাল কলেজ বলা হয়। যুক্তরাষ্ট্রের ৫০টি অঙ্গরাজ্য ও রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিসহ (ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়া) দেশটিতে মোট ইলেকটোরাল কলেজ ৫১টি। এই ইলেকটোরাল কলেজই যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ও ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে আনুষ্ঠানিক কর্তৃপক্ষের ভূমিকা পালন করে। এক একটি রাজ্যে ইলেকটরের সংখ্যা একেক রকম। এটি নির্ধারিত হয় মার্কিন কংগ্রেসে রাজ্যের কতজন প্রতিনিধি ও সিনেটর আছেন সে হিসেবে। জনসংখ্যার ওপর রাজ্যগুলোর প্রতিনিধির সংখ্যা নির্ভর করে; প্রতি ১০ বছর পর পর আদমশুমারির মাধ্যম এটি নির্ধারণ করা হয়। এতে ১০ বছর পর পর অঙ্গরাজ্যগুলোর ইলেকটরের সংখ্যাও হ্রাস-বৃদ্ধি পায়। সাংবিধানিকভাবে যুক্তরাষ্ট্রের কংগ্রেসের দুই কক্ষে থাকা আসনের (প্রতিনিধি পরিষদে ৪৩৫, সিনেটে ১০০) বিপরীতে রাজ্যগুলো তাদের জন্য নির্ধারিত ইলেকটর পায়। কংগ্রেসে রাজধানী অঞ্চল ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার কোনো প্রতিনিধি না থাকলেও সেখান থেকে আসেন তিনজন ইলেকটর। নির্বাচনের দিন ভোটাররা পছন্দের প্রার্থীকে ভোট দিলেও আসলে তারা ৫১টি ইলেকটোরাল কলেজের ৫৩৮ জন ইলেকটর নির্বাচিত করে তাদের হাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের দায়িত্ব তুলে দেন। প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হতে হলে একজন প্রার্থীকে এই ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে অন্তত ২৭০টি নিশ্চিত করতে হয়। অর্ধশত রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ার ৫৩৮ ইলেকটোরাল ভোটের মধ্যে ২৭০টি পেলেই হাতে আসে হোয়াইট হাউসের চাবি।

কোন রাজ্যে কত ইলেকটোরাল ভোট: ২০২০ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী এবারও সবচেয়ে বেশি ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে ক্যালিফোর্নিয়ায় ৫৪টি। এরপর রয়েছে টেক্সাস ৪০, ফ্লোরিডায় ৩০, নিউইয়র্ক ২৮, ইলিনয় ও পেনসিলভানিয়ায় ১৯টি করে। এছাড়া ওহাইওতে ১৭, জর্জিয়ায় ১৬ ও নর্থ ক্যারোলাইনায় ১৬, মিশিগান ১৫, নিউ জার্সিতে ১৪, ভার্জিনিয়াতে ১৩, ওয়াশিংটনে ১২, আরিজোনা, টেনেসি, ম্যাসাচুসেটস ও ইন্ডিয়ানায় ১১, মিনেসোটা, উইসকনসিন, ম্যারিল্যান্ড, মিজৌরি ও কলোরাডোতে ১০, অ্যালবামা ও সাউথ ক্যারোলাইনায় ৯, কেন্টাকি, অরেগন ও লুইজিয়ানায় ৮, কনেটিকাট ও ওকলাহোমায় ৭, মিসিসিপি, আরকানস, ক্যানজাস, আইওয়া, নেভাডা ও ইউটায় ৬; নিউ মেক্সিকো ও নেব্রাস্কায় ৫; ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া, নিউ হ্যাম্পশায়ার, মেইন, রোড আইল্যান্ড, আইডাহো ও হাওয়াইতে ৪; মন্টেনা, নর্থ ডেকোটা, ভার্মন্ট, ডেলাওয়ার, ওয়াইওমিং, সাউথ ডেকোটা, আলাস্কা ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় ৩টি করে ইলেকটোরাল ভোট রয়েছে।

উইনার-টেইক-অল: বেশিরভাগ রাজ্যে নিয়ম হলো- ‘উইনার-টেইক-অল’। মানে কোনো রাজ্যে যদি দশটি ইলেকটোরাল ভোট থাকে, তার মধ্যে যে দল অন্তত ছয়টি, অর্থাৎ সংখ্যাগরিষ্ঠ ইলেকটোরাল ভোট পাবে, ওই রাজ্যের সবগুলো অর্থাৎ দশটি ইলেকটোরাল ভোটই সেই দলের বলে গণ্য হবে। যুক্তরাষ্ট্রের ৪৮টি রাজ্য ও ডিস্ট্রিক্ট অব কলম্বিয়ায় এই নিয়ম অনুসরণ কর হয়। কিন্তু নেব্রাস্কা ও মেইন রাজ্যে ‘উইনার-টেইক-অল’ নিয়ম অনুসরণ করা হয় না, এখানে প্রার্থীদের পাওয়া ভোটের অনুপাতে ইলেকটোরাল ভোট ভাগ করে দেওয়া হয়। জনগণের সরাসরি ভোটে এগিয়ে থেকেও ইলেকটোরাল ভোটে হেরে যাওয়ার নজির আছে যুক্তরাষ্ট্রে। ২০১৬ সালের নির্বাচনে প্রত্যক্ষ ভোটের হিসাবে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী হিলারি রিপাবলিকান ট্রাম্পের চেয়ে প্রায় ৩০ লাখ ভোট বেশি পেলেও ইলেকটোরাল ভোটের হিসাবে হেরে যান। তার আগে ২০০০ সালে ডেমোক্র্যাটিক প্রার্থী আল গোরের কাছে সরাসরি ভোটে হেরে যাওয়ার পরও রিপাবলিকান প্রার্থী জর্জ ডব্লিউ বুশ ইলেকটোরাল ভোটে জিতে হোয়াইট হাউসের টিকিট পেয়েছিলেন।

যেকারণে এই পদ্ধতি: ১৭৮৭ সালে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান যখন প্রণয়ন করা হয় তখন একটি জাতীয় নির্বাচনের মাধ্যমে দেশের প্রেসিডেন্ট নির্বাচন করা বাস্তবে অসম্ভব ছিল। এর কারণ ছিল দেশটির আয়তন ও যোগাযোগ ব্যবস্থার পশ্চাৎপদতা।

আর যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধান প্রণেতারা চাননি রাজধানী ওয়াশিংটন ডিসিতে থাকা আইনপ্রণেতাদের হাতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের মতো গুরুত্বপূর্ণ বিষয়টি সীমাবদ্ধ হয়ে পড়ুক। তারা এই ক্ষমতা দেশব্যাপী ছড়িয়ে থাকা অঙ্গরাজ্যগুলোর হাতে তুলে দিতে চাইলেন। তাই সংবিধান প্রণেতারা ইলেকটোরাল কলেজ সৃষ্টি করলেন, প্রতিটি অঙ্গরাজ্যকে ইলেকটর দিয়ে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনে ভূমিকা রাখার সুযোগ দেওয়া হলো। সরাসরি ভোটে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হলে বেশি জনসংখ্যার অঙ্গরাজ্যগুলো এক্ষেত্রে প্রভাব বিস্তার করবে এই বিবেচনায় প্রতিটি রাজ্যে অন্তত তিনজন ইলেকটর থাকার নিয়ম বেঁধে দেওয়া হয়। ইলেকটরের এই ন্যূনতম সংখ্যা অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার আকারের ওপর নির্ভর করে না। তবে এর বেশি ইলেকটরের সংখ্যা অঙ্গরাজ্যগুলোর জনসংখ্যার অনুপাত বিবেচনায় নির্ধারিত হয়। দেশজুড়ে ভোটে জনপ্রিয়তা যাচাইয়ের মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চেয়ে এ পদ্ধতিতে ছোট অঙ্গরাজ্যগুলোর বেশি বক্তব্য রাখার সুযোগ থাকায় তারা ইলেকটোরাল কলেজ পদ্ধতি সমর্থন করল। ইলেটোরাল ভোটের সংখ্যা অঙ্গরাজ্যের জনসংখ্যার আকারের ভিত্তিতে নির্ধারিত হতো বিধায় দক্ষিণাঞ্চলীয় অঙ্গরাজ্যগুলো সরাসরি ভোটের চেয়ে এ পদ্ধতিতে প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের ক্ষেত্রে বেশি প্রভাব রাখার সুযোগ পাওয়ায় তারাও এ পদ্ধতি সমর্থন করল। কারণ এখানে জনসংখ্যার বড় একটি অংশ ছিল দাসরা। দাসদের ভোটাধিকার না থাকলেও আদমশুমারিতে একজন পূর্ণাঙ্গ মানুষের তিন-পঞ্চমাংশ ধরে তাদেরও গণনা করা হতো।

জয়ী প্রার্থীকেই কী ইলেকটোরাল ভোট দিতে হবে: ভোটাররা কাকে বেশি ভোট দিলেন তা বিবেচনা না করেই কিছু রাজ্যের ইলেকটররা তাদের পছন্দমতো যেকোনো প্রার্থীকে ভোট দিতে পারেন। কিন্তু বাস্তবে ইলেকটররা তাদের রাজ্যে যে প্রার্থী বেশি ভোট পেয়েছেন প্রায় সবসময় তাকেই ভোট দেন। প্রেসিডেন্ট হিসেবে রাজ্যের বেছে নেওয়া প্রার্থীর বিরুদ্ধে ভোট দিলে ওই ইলেকটরকে ‘ধবিশ্বস্ত’ বলা হয়। ২০১৬ সালে এ রকম সাতটি ইলেকটোরাল কলেজ ভোট পড়েছিল; কিন্তু অবিশ্বস্ত ইলেকটররা ফলাফল পরিবর্তন করতে পারেননি।

কোনো প্রার্থীই সংখ্যাগরিষ্ঠতা না পেলে কী হবে: এরকম কোনো পরিস্থিতি হলে যুক্তরাষ্ট্রের সংবিধানের দ্বাদশ সংশোধনী অনুযায়ী কংগ্রেসের নিম্নকক্ষ- প্রতিনিধি পরিষদে ভোটা-ভুটির মাধ্যমে প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হবে আর সেনেট ভাইস প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত করবে। তবে যুক্তরাষ্ট্রের ইতিহাসে এ পর্যন্ত মাত্র একবার এমনটি ঘটেছিল। ১৮২৪ সালে চার জন প্রার্থীর মধ্যে ইলেকটোরাল ভোট ভাগাভাগি হওয়ার পর তাদের মধ্যে কেউ সংখ্যাগরিষ্ঠতা পায়নি। কিন্তু বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রের নির্বাচন পদ্ধতিতে দুই রাজনৈতিক দলের আধিপত্য তৈরি হওয়ায় এখন আর তেমনটি হবে না বলে ধরে নেওয়া হয়।

ইলেকটোরাল ভোটের অসম বণ্টন: যদিও একটি রাজ্যের ইলেকটোরাল ভোটের সংখ্যায় সেই রাজ্যের জনসংখ্যার প্রতিফলন ঘটে; কিন্তু রাজ্যপ্রতি অন্তত ৩টি ভোট থাকার নিয়মের কারণে যুক্তরাষ্ট্রজুড়ে ইলেকটোরাল ভোটের আপেক্ষিক প্রতিনিধিত্বের মান বিভিন্ন হয়। এই নিয়মের কারণে নর্থ ও সাউথ ডাকোটা এবং নিউ ইংল্যান্ডের ছোট রাজ্যগুলো তাদের ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর তুলনায় বেশি ইলেকটোরাল ভোট পেয়ে গেছে। অপরদিকে ক্যালিফোর্নিয়া, টেক্সাস ও ফ্লোরিডার মতো বেশি জনসংখ্যার রাজ্যগুলো তুলনামূকভাবে কম ইলেকটোরাল ভোটের অধিকারী। ওয়াইওমিংয়ের প্রতি এক লাখ ৯২ হাজার লোকের জন্য একটি ইলেকটোরাল ভোট আছে, তুলনায় ক্যালিফোর্নিয়ার প্রতিটি ইলেকটোরাল ভোট সাত লাখ ২০ হাজার নাগরিকের প্রতিনিধিত্ব করছে। এর অর্থ ক্যালিফোর্নিয়ার একটি ইলেকটোরাল ভোট ওয়াইওমিংয়ের একটি ভোটের তিনগুণেরও বেশি লোকের প্রতিনিধিত্ব করছে। দেশজুড়েই এই অসমতা বিরাজমান। বর্তমানে ক্যালিফোর্নিয়া যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যার ১১ দশমিক ৬ শতাংশের প্রতিনিধিত্ব করলেও ইলেকটোরাল কলেজের ভোটে তাদের প্রতিনিধিত্ব ১০ শতাংশ। যদি যুক্তরাষ্ট্রের মোট জনসংখ্যা অনুপাতে ৫৩৮টি ইলেকটোরাল ভোট বরাদ্দ করা হতো তাহলে ক্যালিফোর্নিয়ার বর্তমান ইলেকটোরাল ভোট ৯টি বেড়ে ৬৩টি হতো।

ফল কখন পাওয়া যাবে: প্রতিটি ভোট গণনা করতে কয়েক দিনও লেগে যেতে পারে। তবে সাধারণত যেদিন ভোট হয়, তার পরের দিন সকালেই জয়ী কে তা স্পষ্ট হয়ে যায়। ২০১৬ সালে নির্বাচনে জয়ের পর ডোনাল্ড ট্রাম্প রাত ৩টাতেই নিউ ইয়র্কের মঞ্চে সমর্থকদের সামনে বিজয়ীর ভাষণ দিতে উঠেছিলেন। কিন্তু ২০২০ সালের প্রেসিডেন্ট নির্বাচনের চারদিন পর নিশ্চিত হয় জো-বাইডেন হোয়াইট হাউসে যাচ্ছেন।

কেবল কি প্রেসিডেন্টই নির্বাচিত হচ্ছেন: নির্বাচনের সব মনোযোগ ট্রাম্প না হ্যারিস জিতছেন, তার ওপর নিবদ্ধ থাকলেও এই নির্বাচনে ভোটাররা আসলে প্রেসিডেন্টের পাশাপাশি কংগ্রেসের নতুন সদস্যদেরকেও বেছে নেন। একইদিন অঙ্গরাজ্যগুলোর গভর্নর ও আইন পরিষদ নির্বাচনের ভোটও গ্রহণ করা হয়। মার্কিন প্রতিনিধি পরিষদ রিপাবরিকানদের নিয়ন্ত্রণে আছে। তারা এবারের নির্বাচনে তা ধরে রাখার পাশাপাশি সিনেটেও নিয়ন্ত্রণও করায়ত্ব করার চেষ্টা করছেন। অপরদিকে ডেমোক্র্যাটরা সিনেটের নিয়ন্ত্রণ ধরে রাখার পাশাপাশি প্রতিনিধি পরিষদে নিজেদের নিয়ন্ত্রণ প্রতিষ্ঠার চেষ্টা করছে। দুই কক্ষেই রিপাবলিকানরা সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করতে পারলে নির্বাচিত প্রেসিডেন্ট যদি ডেমোক্র্যাট হন, সেক্ষেত্রে তার পরিকল্পনায় বাধ সাধা কিংবা তাতে বিলম্ব ঘটাতে পারবে কংগ্রেস। প্রতিনিধি পরিষদের ৪৩৫ আসনের সবগুলোতে এবং সিনেটের ১০০ আসনের মধ্যে ৩৩টিতে এ বছর ভোট হলো।

 

ভোরের আকাশ/রন

মন্তব্য

Beta version