যুদ্ধের কারণে মিয়ানমারের অর্থনীতি ধসে পড়েছে। সাধারণ মানুষের স্বাভাবিক উপার্জনে চলছে না সংসার। তাই পারিবারিক আর্থিক সংকট মোকাবিলায় বাড়তি আয়ের জন্য ডাক্তার, নার্স, শিক্ষক, শিক্ষার্থীদের একটি অংশ নেমেছে পতিতাবৃত্তিতে। নিউইয়র্ক টাইমসের ‘Myanmar's War Has Forced Doctors and Nurses into Prostitution’ শীর্ষক প্রতিবেদনে এ তথ্য উঠে এসেছে।
প্রতিবেদনটি লিখেছেন গণমাধ্যমটির দক্ষিণ-পূর্ব এশীয় সংবাদদাতা সুই-লি উই। তিনি দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়ার ১১টি দেশের রাজনীতি, অর্থনীতি, সমাজনীতি এবং পররাষ্ট্রনীতির সংবাদ পরিবেশনের পাশাপাশি এতদাঞ্চলের বিভিন্ন বিষয়ে বিশ্লেষণধর্মী নিবন্ধও লিখে থাকেন। নিবন্ধটিতে তিনি তুলে ধরেছেন যুদ্ধকবলিত ও বিধ্বস্ত মিয়ানমারের অর্থনৈতিক পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার এক হৃদয়বিদারক চিত্র। নিবন্ধটি এখানে তুলে ধরা হলো।
এক দিকে গৃহযুদ্ধ, অন্য দিকে ভেঙে পড়া অর্থনীতি। এই সংকটাপন্ন পরিস্থিতিতে সাধারণ মানুষ দুবেলা দুমুঠো খাবার জোগাড় করতে হিমশিম খাচ্ছে। পেটের জ্বালায় অনেকেই বেছে নিচ্ছেন বেআইনি পথ। সংসারের জন্য দেহব্যবসায় নেমেছেন নারীদের একাংশ। মার্কিন গণমাধ্যম নিউইয়র্ক টাইমসের প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিগত তিন-চার বছরে মিয়ানমারে যৌনকর্মীর সংখ্যা কয়েক গুণ বেড়েছে। বেশি আয়ের আশায় এই পথে নামছেন মহিলা চিকিৎসক, নার্স থেকে শুরু করে স্কুল-কলেজের শিক্ষিকারাও। অধিকাংশই এ কাজ করছেন পেটের জ্বালায়। তবে এ ব্যাপারে কোনো হেলদোল নেই সেখানকার জান্তা সরকারের।
২০২১ সালের ফেব্রুয়ারিতে সেনা অভ্যুত্থানের মাধ্যমে মিয়ানমারের ক্ষমতা দখল করে জান্তা। ২০২০ সালে শুরু হওয়া কোভিড অতিমারির ধাক্কা তখনও কাটিয়ে উঠতে পারেনি বিশ্ব। ওই সময়ে এমনিতেই দেশের আর্থিক অবস্থা ছিল নড়বড়ে। তার মধ্যে সেনাবাহিনী ক্ষমতা দখল করায় সাবেক বার্মায় বেঁধে যায় গৃহযুদ্ধ।
ঘরোয়া কোন্দল আর কোভিডের গুঁতোয় গত তিন বছরে হু হু করে নেমেছে অর্থনীতির সূচক। মুদ্রাস্ফীতির হার বাড়তে বাড়তে পৌঁছে গিয়েছে ২৬ শতাংশে। ফলে বাজারে আগুন দামে বিক্রি হচ্ছে নিত্যপ্রয়োজনীয় সামগ্রী। আগামী বছর অর্থাৎ ২০২৫ সালে মিয়ানমারের আর্থিক বৃদ্ধির লেখচিত্র ঋণাত্মক হতে পারে বলে আশঙ্কা প্রকাশ করেছে বিশ্বব্যাংক।
দেশের এই দুর্বিষহ অবস্থার কথা নিউইয়র্ক টাইমসের কাছে তুলে ধরেছেন সদ্য চিকিৎসায় ডিগ্রি পাওয়া ২৬ বছর বয়সী বর্মীকন্যা মে। তার কথায়, ‘৪১৫ ডলার হাতে থাকলে মুহূর্তে তা উবে যাবে। ওই টাকায় আজকাল আর পানি পর্যন্ত গরম হচ্ছে না। পরিবারের নিত্যদিনের খরচ চালানোই দায়! আমাদের কাছে রোজগারের একমাত্র রাস্তা হলো যৌন ব্যবসা।’
মিয়ানমারের খারাপ আর্থিক অবস্থার নেপথ্যে আরও কয়েকটি কারণের কথা বলেছেন আর্থিক বিশ্লেষকরা। তার মধ্যে রয়েছে বর্ষা-পরবর্তী ঋতুতে অতিবৃষ্টির জেরে বন্যা। এতে কৃষির মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এ ছাড়া চীন এবং থাইল্যান্ড সীমান্তে বিদ্রোহীরা অতিরিক্ত সক্রিয় থাকায় আন্তঃসীমান্ত বাণিজ্য এক রকম বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
চলতি বছরে ডলারের নিরিখে দুই-পঞ্চমাংশ দর কমেছে মিয়ানমারের স্থানীয় মুদ্রা ‘কিয়াট’-এর। বিশ্বব্যাংকের রিপোর্ট অনুযায়ী, দেশটির অর্ধেকের বেশি নাগরিক দারিদ্র্যসীমার নিচে চলে গিয়েছেন। ২০১১-’২১ সালের মধ্যে চলা গণতান্ত্রিক সরকারের আমলে সাবেক বার্মায় একটি মধ্যবিত্ত শ্রেণি তৈরি হয়েছিল। ওই শ্রেণির জনসংখ্যা ৫০ শতাংশ কমেছে বলে জানিয়েছে বিশ্বব্যাংক।
মিয়ানমারের দ্বিতীয় বৃহত্তম শহর হলো মান্দালয়। যৌনকর্মীর সংখ্যা সেখানে উত্তরোত্তর বাড়ছে বলে খবর পাওয়া গেছে। নিউইয়র্ক টাইমসকে মে বলেছেন, ‘আমাদের এখানে দেহব্যবসা আইনত সিদ্ধ নয়। শহরাঞ্চলে, বিশেষত যেখানে বিদেশি পর্যটকদের ভিড় লেগে থাকে, সেখানে "ডেট গার্ল"দের দেখা মিলবে। এরা প্রত্যেকেই যৌনকর্মী। পেটের জ্বালায় ডেটিংয়ের নামে এই পেশায় নেমেছেন তারা।’
সাবেক বার্মায় গত তিন বছরে ঠিক কতজন যৌনকর্মীর জীবন বেছে নিয়েছেন, সেই সংখ্যা এখনও প্রকাশ্যে আসেনি। তবে সবচেয়ে উদ্বেগের বিষয় হলো, তথাকথিত ভালো চাকরি বা কাজ ছেড়ে এতে নাম লেখাচ্ছেন তরুণীদের একাংশ। অনেকে আবার উপরি রোজগারের জন্য যৌনকর্মীর পেশা বেছে নিয়েছেন। শিক্ষিত মেয়েদের এ দিকে ঝোঁকার প্রবণতা বেশি বলে জানা গিয়েছে।
তাৎপর্যপূর্ণ বিষয় হল, সেনা অভ্যুত্থানের পর গণতন্ত্র ফেরানোর দাবিতে মেয়েরাই প্রথম রাস্তায় নেমেছিলেন। জান্তা সৈনিকদের সামনে দাঁড়িয়ে কাপড় উড়িয়ে বিক্ষোভে সামিল হন তারা। এতে মিয়ানমারের পিতৃতান্ত্রিক অচলায়তন ভেঙে যাবে বলে মনে করা হয়েছিল। যদিও বাস্তবে তা হয়নি। উল্টো ক্ষমতার একেবারে শিকড়ে পৌঁছে যায় সেনা।
সাম্প্রতিক সময়ে মিয়ানমারের বেশ কয়েকটি এলাকার উপর নিয়ন্ত্রণ হারিয়েছে জান্তা সরকার। সেগুলোর দখল নিয়েছে বিদ্রোহীরা। তবে দেশের মূল শহরগুলির জান্তাদের দখলেই রয়েছে। আর সেখানে দিন দিন বাড়ছে যৌনপল্লীর সংখ্যা। কারাওকে পানশালা, নাইটক্লাব এবং হোটেলে চুটিয়ে চলছে এই দেহব্যবসা।
এই ব্যাপারে গণমাধ্যমের কাছে আরও খোলামেলাভাবে কথা বলেছেন ২৫ বছর বয়সী বর্মী তরুণী জার। তার কথায়, ‘এতে এক রাতে ৮০ ডলার পর্যন্ত উপার্জনের সুযোগ রয়েছে। মাসের হিসাবে টাকাটা অনেকটাই বেশি। আমাদের খদ্দেরদের অধিকাংশই চীনা নাগরিক। ভাঙা ইংরেজি এবং বার্মিজ ভাষায় কথা বলতে পারেন তারা। অবশ্যই কাজটা ভালো নয়। প্রথম প্রথম এর জন্য লজ্জাও পেতাম। তবে এখন টাকাটা প্রয়োজন।’
মান্দালয়ের একটি সেনা হাসপাতালে নার্স ছিলেন জার। ধনী খদ্দেরের হদিস পেতে বিভিন্ন সমাজমাধ্যমকে ব্যবহার করা হচ্ছে বলে জানিয়েছেন তিনি। এই পেশায় পদে পদে রয়েছে পুলিশের হাতে ধরা পড়ার ভয়। অভিষোগ, তখন ঘুষ দিয়ে শাস্তি এড়ান মিয়ানমারের যৌনকর্মীরা।
মিয়ানমারের জনসংখ্যা ৫ কোটি ৫০ লাখ। দেশটিতে সেনা শাসনের দীর্ঘ ইতিহাস রয়েছে। জাতিসংঘের উন্নয়নমূলক কর্মসূচির রিপোর্ট অনুযায়ী, ২০২১ সালের অভ্যুত্থানের পর ডিম ও দাঁত মাজার পেস্টের মতো সামগ্রীগুলোর দাম প্রায় তিন গুণ হয়েছে। অন্য দিকে কমেছে সাধারণ মানুষের আয়-রোজগার। আন্তর্জাতিক খাদ্যনীতি গবেষণা প্রতিষ্ঠান জানিয়েছে, মিয়ানমারে সাধারণ খাবারের খরচ ১৬০ শতাংশ বেড়েছে। এ বছরের এপ্রিল থেকে জুনের মধ্যে চলা একটি সমীক্ষায় বলা হয়েছে, দেশটির মহিলা শ্রমিকরা দিনে গড়ে মাত্র পাঁচ ডলার উপার্জন করেন। সেখানে একই কাজ করে পুরুষদের আয়ের পরিমাণ ৪০ শতাংশ বেশি।
বর্মী মহিলাদের কর্মসংস্থানের একটি বড় জায়গা ছিল দেশের বস্ত্রশিল্প। ২০২৬ সালের মধ্যে সেখানকার মিল ও কাপড়ের কারখানাগুলোতে ১৬ লাখ মহিলা কর্মী নিয়োগ হবে বলে আশা করা হয়েছিল। কিন্তু সেনা অভ্যুত্থানের পর গৃহযুদ্ধ লেগে যাওয়ায় সেই কারখানাগুলির অধিকাংশই বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
দ্বিতীয়ত, জান্তা সরকারের আমলে সরকারি চাকরির সংখ্যা উল্লেখ্যযোগ্য হারে কমেছে। গত তিন বছরে বাহিনী ছাড়া আর কোনো দপ্তরে সে ভাবে নিয়োগ করেননি জান্তা প্রধান সিনিয়র জেনারেল মিন অং হ্লাইং। ফলে সব দিক থেকেই দেশটির বাসিন্দাদের আয়ের রাস্তা প্রায় বন্ধ হয়ে গিয়েছে।
সমীক্ষা রিপোর্ট বলছে, সবচেয়ে খারাপ অবস্থা সেনা বা পুলিশের গুলিতে নিহতদের পরিবারের। সেনা অভ্যুত্থানের পর আন্দোলনে অংশ নিতে গিয়ে প্রাণ গিয়েছে বহু নিরীহ মিয়ানমারবাসীর। তাদের স্ত্রী বা মেয়েদের ঘরের শেষ সম্বলটুকু পর্যন্ত বিক্রি করে দিতে হয়েছে। তারপরও দুবেলা পেট ভরে খাবার জুটছে না তাদের। ফলে যৌনকর্মীর জীবন বেছে নিতে বাধ্য হচ্ছেন তারা।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য