দক্ষিণ কোরিয়ায় একটি যাত্রীবাহী উড়োজাহাজ বিধ্বস্ত হয়ে ১৭৯ জন নিহত হয়েছে। গতকাল রোববার স্থানীয় সময় সকাল ৯টা ৩ মিনিটে দেশটির মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে অবতরণের সময় এটি বিধ্বস্ত হয়। এটি দেশটির ইতিহাসে সব চেয়ে ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা। এর কারণ নিয়ে এখনো ধন্দে আছেন সংশ্লিষ্টরা। কেউ বলছেন, পাখির সঙ্গে ধাক্কা খাওয়ায় এ দুর্ঘটনা ঘটেছে। আবার কেউ বলছে যান্ত্রিক ত্রুটির কারণে এমনটা হয়েছে। খবর রয়টার্স, আলজাজিরা, সিএনএন ও বিবিসির।
রয়টার্স জানিয়েছে, জেজু এয়ারের ওই ফ্লাইটে ১৭৫ জন যাত্রী এবং ৬ জন ক্রু ছিলেন। তাদের মধ্যে কেবল দুজন ক্রুকে জীবিত উদ্ধার করতে পেরেছেন ফায়ার সার্ভিস কর্মীরা। নেমে আসার সময় পাখির সঙ্গে সংঘর্ষে উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ারে জটিলতা তৈরি হয়। চাকা না খোলায় অবতরণের পর বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজটি রানওয়েতে ছেঁচড়ে গিয়ে বিমানবন্দরের দেয়ালে ধাক্কা খায় এবং অগ্নিগোলকে পরিণত হয়। ফ্লাইট ৭সি২২১৬ এর যাত্রীদের মধ্যে ১৭৩ জনই ছিলেন দক্ষিণ কোরিয়ার নাগরিক, দুজন থাইল্যান্ডের। মুয়ান আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর রাজধানী সিউল থেকে ২৮৮ কিলোমিটার দূরে। দুর্ঘটনার পর সেখানে সব ধরনের ফ্লাইট ওঠানামা বন্ধ করে দেয় কর্তৃপক্ষ।
উড়োজাহাজটি থাইল্যান্ড থেকে যাত্রী নিয়ে দক্ষিণ কোরিয়া যাচ্ছিলেন। দক্ষিণ কোরিয়ার এক কর্মকর্তার বরাত দিয়ে বিবিসি লিখেছে, উড়োজাহাজটি বিমানবন্দরে অবতরণের প্রস্তুতি নেওয়ার সময় এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল থেকে পাখির সঙ্গে সংঘর্ষের সতর্কবার্তা দেওয়া হয়। ফলে পাইলট না নেমে আকাশে ভেসে থাকতে বাধ্য হন। দুই মিনিট পর পাইলট ‘মে ডে’ ঘোষণা করলে (বিপদে পড়ার সংকেত) এয়ার ট্রাফিক কন্ট্রোল অবতরণের অনুমতি দেয়। উড়োজাহাজটি উল্টো দিক থেকে রানওয়েতে নেমে এলেও ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ না করায় চাকা ছাড়াই সেটি নেমে আসে।
স্থানীয় সংবাদমাধ্যমে প্রকাশিত ভিডিওতে দেখা যায়, জোড়া ইঞ্জিনের উড়োজাহাজটি চাকা ছাড়াই রানওয়ে দিয়ে অনেক দূর পর্যন্ত ছেঁচড়ে যায়। তারপর রানওয়ে থেকে বেরিয়ে গিয়ে বিমানবন্দরের দেয়ালে ধাক্কা খায়। সঙ্গে সঙ্গে বিস্ফোরণে উড়োজাহাজটিতে আগুন ধরে যায় এবং এর ধ্বংসাবশেষ ছড়িয়ে পড়ে বিভিন্ন দিকে।
মুয়ানের ফায়ার সার্ভিস প্রধান লি জুং-হিউন বলেন, দুর্ঘটনার পর কেবল লেজের কিছুটা অংশ আস্ত আছে, বাকি অংশ আর চেনার উপায় নেই।
জেজু এয়ার এক বিবৃতিতে বলেছে, মুয়ান বিমানবন্দরের দুর্ঘটনায় যারা ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন আমরা জেজু এয়ারের পক্ষ থেকে তাদের প্রত্যেকের কাছে মাথানত করে ক্ষমা প্রার্থনা করছি। এই ঘটনায় সাড়া দিয়ে যা যা করতে পারবো তার সবাই করবো আমরা। এই বিপর্যয়ের জন্য আমরা দুঃখিত।
বিবিসি লিখেছে, ২০০৫ সালে প্রতিষ্ঠিত জেজু এয়ার দক্ষিণ কোরিয়ার অন্যতম শীর্ষ বাজেট এয়ারলাইন। তাদের কোনো উড়োজাহাজ এই প্রথম প্রাণঘাতী দুর্ঘটনায় পড়ল। এমন এক সময়ে এই দুর্ঘটনা ঘটল, যখন দক্ষিণ কোরিয়া দক্ষিণ কোরিয়া ব্যাপক রাজনৈতিক অস্থিরতার মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। নতুন ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট চোই সুং-মককে দায়িত্ব নেওয়ার দুই দিনের মাথায় এই সংকট মোকাবিলা করতে হচ্ছে।
তার কার্যালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, ভারপ্রাপ্ত প্রেসিডেন্ট সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তাদের সঙ্গে জরুরি বৈঠক করেছেন এবং জরুরি ত্রাণ ও উদ্ধার কার্যক্রম পরিচালনার নির্দেশ দিয়েছেন। দক্ষিণ কোরিয়ায় ইতিহাসে সবচেয়ে ভয়াবহ উড়োজাহাজ দুর্ঘটনার আসল কারণ কি তা নিয়ে ধন্দে পড়েছেন বিশেষজ্ঞরা। দুর্ঘটনার কারণ সম্পর্কে প্রাথমিকভাবে পাখির আঘাতের কারণে হয়ে থাকতে বলে যে ব্যাখ্যা দেওয়া হচ্ছে তা নিয়ে গতকাল রোববার প্রশ্ন তুলেছেন তারা। দুর্ঘটনার কারণের প্রাথমিক তদন্তে বলা হচ্ছে, পাখির সঙ্গে সংঘর্ষে উড়োজাহাজের ল্যান্ডিং গিয়ারে জটিলতা তৈরি হয়। চাকা না খোলায় অবতরণের পর বোয়িং ৭৩৭-৮০০ উড়োজাহাজটি রানওয়েতে ছেঁচড়ে গিয়ে বিমানবন্দরের দেয়ালে ধাক্কা খায় এবং অগ্নিগোলকে পরিণত হয়। কিন্তু উড়োজাহাজটি বিধ্বস্তের আসল কারণ কি তা নিয়ে এখনও রয়ে গেছে সংশয়। বিশ্লেষকদের কেউ কেউ উড়োজাহাজটির যান্ত্রিক ত্রুটিসহ অন্যান্য আরও কিছু কারণের কথা উল্লেখ করেছেন। যেমনÑ উড়োজাহাজের দুটো ইঞ্জিন কাজ না করা এবং গতি নিয়ন্ত্রণের জন্য দুইপাশে থাকা ব্রেক কাজ না করা। তাদের মতে, কেবল পাখির সঙ্গে ধাক্কা লাগার কারণে উড়োজাহাজের সব গুরুত্বপূর্ণ যন্ত্র এভাবে একসঙ্গে বিকল হতে পারে না। তাছাড়া, পাখির আঘাতের কারণে ল্যান্ডিং গিয়ার বিকল হওয়ার সম্ভাবনাও নেই বলে মনে করেন বিশেষজ্ঞরা। এয়ারলাইন নিউজ সম্পাদক জিওফ্রি থমাস বলেন, পাখির সঙ্গে ধাক্কা সচরাচর ঘটেই থাকে। আবার উড়োজাহাজের চাকায় সমস্যা হওয়ার ঘটনাও বিরল নয়। পাখির সঙ্গে ধাক্কার ঘটনা আরও ঘন ঘনই হয়। তবে তাতে সাধারণত গোটা উড়োজাহাজ নিয়ন্ত্রণ হারায় না।
অস্ট্রেলিয়ার উড়োজাহাজ চলাচলবিষয়ক নিরাপত্তা বিশেষজ্ঞ জিওফ্রি ডেল বলেন, পাখির আঘাত ল্যান্ডিং গিয়ার বন্ধ করতে পারে, এমন নজির আমি দেখিনি।
বিশেষজ্ঞরা বেশিরভাগই একমত যে, ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ না করাই উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার প্রত্যক্ষ কারণ। ভিডিওতে দেখা গেছে ল্যান্ডিং গিয়ার বের হয়নি। বিমানের গতিও অনেক বেশি ছিল। দক্ষিণ কোরিয়ার ইনহা বিশ্ববিদ্যালয়ের অ্যাভিয়েশন বিশেষজ্ঞ চৈ কি-ইয়ং বলেন, একটি উড়োজাহাজের একাধিক ব্রেক থাকে। আর ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ না করলে উল্টোদিকে চালিত ইঞ্জিন পাখা বের হতে সাহায্য করে; যেটি ব্রেকের কাজ করে। কিন্তু এই উড়োজাহাজটির ক্ষেত্রে সেই ব্যবস্থা কাজ করতে দেখা যায়নি।
বিশেষজ্ঞদের মতে, পাখির ধাক্কায় উড়োজাহাজের একটি ইঞ্জিনও যদি বিকল হয়ে থাকে, তারপরও দ্বিতীয় আরেকটি ইঞ্জিনের সাহায্যে ল্যান্ডিং গিয়ার কাজ করতে পারত। কিন্তু তা না হওয়ায় যন্ত্রিক ত্রুটি বিমান দুর্ঘটনার কারণ হয়ে থাকতে পারে তেমনটিও ধারণা করা হচ্ছে।
তাছাড়া, কোনো উড়োজাহাজের বেলি ল্যান্ডিংয়ের ক্ষেত্রে সেটি ধীর গতিতে পাখার সাহায্যে চলার কথা। এরকম কিছুও জেজু এয়ারের উড়োজাহাজের ক্ষেত্রে দেখা যায়নি। বিশেষজ্ঞ ইয়ং বলেন, তার ধারণা, দুটো ইঞ্জিনই বিকল হয়েছিল। দুই ইঞ্জিন বিকল হয়ে গোটা উড়োজাহাজই নিয়ন্ত্রণ হারায়। সেক্ষেত্রে পাইলটের কমান্ডও আর কাজে আসে না। দক্ষিণ কোরিয়ার এই উড়োজাহাজ দুর্ঘটনা নিয়ে কয়েকটি প্রশ্ন তুলেছেন এয়ারলাইন নিউজ এডিটর থমাস। তিনি বলেন, রানওয়েতে ফোম কেন ছড়ানো হয়নি? আগুন নিয়ন্ত্রণ দল কেন উপস্থিত ছিল না? বিমানটি রানওয়ের এতদূরে কেন অবতরণ করল? রানওয়ের শেষে ইটের দেয়াল কেন ছিল?
আবার অস্ট্রেলিয়ার বিশেষজ্ঞ জিওফ্রি ডেল বলেন, পাখি ইঞ্জিনে আঘাত করলেও ইঞ্জিন কিছুটা ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে, কিন্তু তৎক্ষণাৎ বন্ধ হয়ে যাওয়ার কথা নয়। আর তখন পাইলটও পরিস্থিতি সামাল দেওয়ার কিছুটা সময় পাওয়া কথা। তাই উড়োজাহাজটি বিধ্বস্ত হওয়ার কারণ আসলেই কি ছিল, তা আরও পুঙ্ঘানুপুঙ্খভাবে খতিয়ে দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
কোরিয়ান এয়ারোস্পেস বিশ্ববিদ্যালয়ের ফ্লাইট এডুকেশন সেন্টারের পরিচালক কিম-ইন গিউ বলেন, আমাদেরকে কারণ বিশ্লেষণ করে দেখতে হবে। একটি উড়োজাহাজের তিনটি ল্যান্ডিং গিয়ারই কাজ না করা খুবই বিরল ব্যাপার। কেবল পাখির ধাক্কাতেই সেটি হয়েছে এমন উপসংহার টানা কঠিন। উড়োজাহাজটির আগে থেকেই কোনো সমস্যা ছিল কিনা সেটিও আমাদের খতিয়ে দেখা দরকার। দক্ষিণ কোরিয়ার কর্মকর্তারা বলেছেন, তারা তদন্ত চালিয়ে যাচ্ছেন এবং পাখির ধাক্কাসহ সব সম্ভাব্য কারণ পরীক্ষা করে দেখছেন। তবে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ জানতে আরও তথ্য প্রয়োজন, বলছেন বিশেষজ্ঞরা। দক্ষিণ কোরিয়ার পরিবহন মন্ত্রণালয় জানিয়েছে, দুর্ঘটনার প্রায় আড়াই ঘণ্টা পর ফ্লাইট ডেটা রেকর্ডার এবং ককপিট ভয়েস রেকর্ডার উদ্ধার হয়েছে। এগুলো বিশ্লেষণের মাধ্যমে দুর্ঘটনার প্রকৃত কারণ নির্ধারণ করা সম্ভব হতে পারে।
ভোরের আকাশ/রন
মন্তব্য