-->
শিরোনাম
ইমাম, নুসরাত ও মিতুসহ আলোচিত হত্যাকাণ্ডের অপরাধী চিহ্নিত

পাঁচ হাজার ক্লুলেস মামলায় পিবিআইয়ের সফলতা

হাতে এক লাখ মামলা

ইদ্রিস আলম হৃদয়
পাঁচ হাজার ক্লুলেস মামলায় পিবিআইয়ের সফলতা

মাত্র ছয় শব্দের ছোট্ট একটি চিরকুট। আর তাতেই লুকানো ছিল মাত্র ২ মাস বয়সি এক শিশুকে হত্যার আসল রহস্য। এই চিরকুটের সূত্র ধরেই পুলিশ ব্যুারো অব ইনভেস্টিগেশন-পিবিআই হত্যাকাণ্ডের রহস্য উদঘাটন করেছে। একটি শিশুর সবচেয়ে নিরাপদ আশ্রয়স্থল মায়ের কোল। মায়ের কোলেই ঘুমিয়ে ছিল দুই মাস বয়সি ছোট্ট ইমাম।

রাত ১২টার দিকে মা নিজের ছেলেকে ঘুমন্ত অবস্থায় পুকুরে ফেলে দেয়। পরে নিজেই চিৎকার-চেঁচামেচি করে বলেছিল, তার ছেলেকে কে বা কারা চুরি করে নিয়ে গেছে। দুই দিন পর পুকুরে ভেসে ওঠে ইমামের মরদেহ। গত বছরের ১৯ মার্চ রাতে নারায়ণগঞ্জের বন্দরথানা এলাকায় ঘটনাটি ঘটেছিল।

যেখানে থানা-পুলিশ ব্যর্থ সেখানে প্রতিষ্ঠিত হওয়ার মাত্র নয় বছরের মাথায় প্রায় পাঁচ হাজার ক্লুলেস মামলার সফল তদন্ত করেছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)। যেখানে বৃহত্তর পুলিশ বাহিনী নিয়ে সমালোচনার শেষ নেই। সেখানে এরই মধ্যে এই বাহিনীর নতুন একটি বিভাগ ব্যতিক্রমী স্বতন্ত্র ভাবমূর্তি গড়ে তুলেছে।

বিস্মৃতপ্রায় চাঞ্চল্যকর অপরাধের ঘটনাসহ বহু জটিল মামলার জট খুলে অল্পসময়ে নজর কেড়েছে পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন। এই সংস্থার বয়স মাত্র নয় বছর। আমেরিকার তদন্ত সংস্থা এফবিআই-এর আদলে তৈরি সংস্থাটি সংক্ষেপে পরিচিত হয়ে উঠছে পিবিআই নামে। পিবিআইয়ের প্রতিষ্ঠা ২০১২ সালে। তদন্তের যাত্রা শুরু ষোলতে।

বেশ কয়েক যুগের পুরোনো এবং সাম্প্রতিক চাঞ্চল্যকর মামলার রহস্যের জট খুলে হইচই ফেলেছে তদন্ত সংস্থা। যার মধ্যে আছে তিন দশকের বেশি পুরোনো ঢাকার সগিরা মোর্শেদ এবং সাম্প্রতিক ফেনীতে নুসরাত ও চট্টগ্রামে মিতু হত্যাকাণ্ড। প্রত্যন্ত গ্রামীণ জনপদের এমন বহু অপরাধ মামলার রহস্য উদ্ঘাটন ও আসামি গ্রেপ্তার করেছে সংস্থাটি।

এদিকে পিবিআই সূত্র বলছে, এখন পর্যন্ত প্রায় এক লাখ মামলা পেয়েছে সংস্থাটি। ৯০ হাজারের তদন্ত শেষ করে আদালতে জমা দিয়েছে। তার মধ্যে হত্যা মামলা তিন হাজারের বেশি। বিচারিক আদালতের রায় বিবেচনায় পিবিআইয়ের তদন্তের সফলতা ৯০ শতাংশের বেশি। কিছু মামলা আপস নিষ্পত্তি হয়েছে।

তবে, সংস্থাটির তদন্ত করা বেশ কয়েকটি মামলা উচ্চ আদালতে বিচারাধীন রয়েছে। পিবিআইয়ের তদন্তের চূড়ান্ত সফলতা নির্ভর করবে সর্বোচ্চ আদালত সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগের রায়ে টিকলে। গত বছর নিজের গর্ভজাত শিশুসন্তানকে সুনিপুণ কৌশলে নিজের হাতে হত্যা করে বিচারের জন্য বিলাপ করেছিলেন মা।

এমন হত্যার রহস্য উদঘাটন যেন অসাধ্যসাধন। অবিশ্বাস্য ঠেকলেও তেমনই এক চাঞ্চল্যকর অপরাধ উদঘাটন করে সবাইকে তাক লাগিয়ে দেয় পিবিআই। প্রত্যক্ষদর্শীরা বলেন, শিশু ইমামের বাবা রুবেল বন্দর থানায় হত্যা মামলা করেন। থানা-পুলিশ তিন মাসে তদন্তের কুলকিনারা করতে ব্যর্থ হয়। পুলিশ সদর দপ্তর তদন্তভার দেয় পিবিআইকে।

৫ মাস পর তদন্তকারী কর্মকর্তা জানতে পারেন ঘটনার দিন একটি চিরকুট পাওয়া গিয়েছিল। বহু চেষ্টার পর সেই চিরকুট নিহত শিশু ইমামের নানির কাছ থেকে উদ্ধার করে পিবিআই কর্মকর্তা। ঘটনাস্থলের আশপাশের বহু জনের হাতের লেখা সংগ্রহ করে। মিল খুঁজতে থাকে চিরকুটের লেখার সঙ্গে।

অবাক করে দিয়ে একপর্যায়ে মিল পায় নিহত শিশুর মা খাদিজা আক্তার পিংকির হাতের লেখার সঙ্গে। গ্রেপ্তার হন মা। স্বীকার করেন, স্বামীর সঙ্গে বিরোধের ক্ষোভ থেকে নিজের শিশুসন্তানকে হত্যা করেছেন। পিবিআইয়ের তদন্তে এমন জটিল আরো অনেক মামলার রহস্য উন্মোচন আশা জাগাচ্ছে হাল ছেড়ে দেওয়া অনেক বিচারপ্রার্থীর বুকে।

ফেনীর মাদ্রাসাছাত্রী নুসরাতকে ২০১৯ সালে আগুনে পুড়িয়ে হত্যা করা হয়। ঘাতকরা এবং তাদের সুরে থানা পুলিশও আত্মহত্যার গল্প ছড়ায়। এ ঘটনায় থানা পুলিশের ভূমিকা বরাবরই ছিল বিতর্কিত। তাই নুসরাত হত্যার তদন্তভার পিবিআইয়ে। সংস্থাটি দ্রুত রহস্য উদঘাটন করে, নুসরাতকে হত্যার জন্য ১৬ আসামিকে অভিযুক্ত করে।

বিচারে তাদের মৃত্যুদণ্ড দিয়েছেন নিম্ন আদালত। পুলিশের অভিযুক্ত ওসি মোয়াজ্জেম পেয়েছেন পাঁচ বছরের কারাদণ্ড। পুলিশ কর্মকর্তা বাবুল আখতার নিজের স্ত্রী মিতুকে হত্যা সন্দেহে গ্রেপ্তার হয়েছেন পিবিআইয়ের হাতে। জটিল, পুরোনা বহু মামলার তদন্তে সবাই যেখানে আশা ছেড়ে দিয়েছিল, সেখানে পিবিআইয়ের সাফল্য চমকে দিচ্ছে।

অন্যদিকে, আস্থা ও বিশ্বাসযোগ্যতা দ্রুত অর্জন করলেও পুলিশের একজন সাবেক প্রধান মনে করেন পিবিআইকে দক্ষতার আরো প্রমাণ দিতে হবে এবং এজন্য দীর্ঘ পথ যেতে হবে। একই পুলিশ বাহিনীতে একসময়ের ব্যর্থতা কী করে পিবিআইয়ের সাফল্য হচ্ছে?

এ নিয়ে বাংলাদেশ পুলিশের সাবেক আইজি শহিদুল হক বলেন, প্রযুক্তির উৎকর্ষতা বৃদ্ধির সঙ্গে সঙ্গে এই তদন্ত সংস্থার আধুনিকায়ন, প্রশিক্ষণ ও জ্ঞান বৃদ্ধির একটি নিয়মিত প্রক্রিয়া থাকতে হবে। তিনি আরো বলেন, পুলিশের অপরাধ তদন্তকে নিয়মিতভাবে সফল করতে তাদের আছে নানা পরামর্শও।

যেকোনো ধরনের প্রভাব এবং লোভ-দুর্নীতির ঊর্ধ্বে থেকে পিবিআইকে এগিয়ে নেওয়ার পরামর্শও দিয়েছেন তিনি।

সদ্য অতিরিক্ত আইজিপি পদে পদোন্নতি প্রাপ্ত পুলিশ ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (পিবিআই)-এর প্রধান বনজ কুমার মজুমদার বলেন, ‘প্রতিটি মামলার ঠিকমতো তদারকি করতে হবে। ঠিকমতো কাগজপত্র গোছাতে হবে। এবং ঠিকমতো সময় দিতে হবে, তাহলেই একটি মামলার সঠিক ঘটনাটি উদ্ঘাটন করা সহজ হবে।’

তিনি আরো বলেন, ‘আমরা মূলত বিশেষ করে মামলার ভেতরে যাওয়ার চেষ্টা করে থাকি। আমরা একটি বিষয় গুরুত্বের সঙ্গে লক্ষ্য রাখি শুধু মামলার বাদীই নন, মামলার যিনি আসামি সেও যেন সঠিক বিচার পান সেই দিকটাও নিশ্চিত করে তদন্ত করা হয়।’

 

 

মন্তব্য

Beta version