মাত্র ২৫৫ টাকা চুরির অভিযোগ। এরপর থানা-পুলিশ। অতপর কারাগারের নির্জন প্রকোষ্ঠ। শেষ পর্যন্ত ৪ বছর ৮ মাস কারাভোগের পর মুক্ত। এ ঘটনা মৌলভীবাজারের শ্রীমঙ্গল উপজেলার শহীদবাগ আবাসিক এলাকার দুলাল মিয়ার ছেলে রাজন মিয়ার।
তার কারামুক্তির পেছনে ছিল একটি মানবাধিকার সংগঠন। রাজধানীর দক্ষিণ দনিয়ার দিনমজুর কাজল প্রতি দিনকার মতো কাজ শেষে দনিয়ার কবরস্থানের পাশ দিয়ে বাসায় ফিরছিলেন। তখন রাত সাড়ে ১০টা।
পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে প্রথমে থানা হাজতে ও পরে কারাগারে পাঠায়। এরপরই কাজল জানতে পারে সে একটি ছিনতাই মামলার আসামি। হতদরিদ্র এই কাজলের পাশে দাঁড়ায় একটি মানবাধিকার সংগঠন। অতপর দুই বছর ১৭ দিন কারাভোগের পর মুক্ত।
গোপালগঞ্জের কাশিয়ানি থানার খন্দকার আব্দুল নোয়ারুল হকের ছেলে খন্দকার এনামুল হক মিতুল। বিদেশে যাবার জন্য গ্রামের শেষ সম্বল একটি জমি বিক্রির ৪৫ হাজার টাকা নিয়ে ঢাকার মিরপুর-১২ একটি ট্রাভেল এজেন্সিতে যাবার সময় মিরপুরের কাজিপাড়া এলাকায় পুলিশের হাতে আটক হয়।
এ নিয়ে পুলিশের সঙ্গে বাগবিতণ্ডা। শেষ পর্যন্ত বিস্ফোরক দ্রব্য আইনের মামলায় কারাবাস। টানা ৪ বছর দুই মাস কারাভোগের পর মুক্তি। অপরাধ প্রমাণের আগেই বিনা বিচারে তাদের এই দীর্ঘ কারাবাস। শুধুই রাজন, কাজল বা মিতুল নয়, যশোরের শার্শা উপজেলার বাসিন্দা ট্রাক হেলপার সুরুজ মিয়ার ১৩ বছরের বন্দিজীবনের অবসান ঘটে ওই স্বেচ্ছাসেবী মানবাধিকার সংগঠনটির বদৌলতে।
সুরুজ মিয়া, রাজন, কাজল, আর মিতুলের মতো আর্থিকভাবে অসচ্ছল, অসহায় ব্যক্তিদের বিনা টাকায় আইনি সহায়তা দিচ্ছে লিগ্যাল এসিসট্যান্স টু হেলপ্লেস প্রিজনার্স অ্যান্ড পার্সনস (এলএএইচপি) নামের মানবাধিকার সংগঠনটি। গত এক যুগে সংগঠনটি আইনি সহায়তা দিয়ে প্রায় সাড়ে ৬শ ব্যক্তিকে কারামুক্ত করেছে।
বিনা বিচারে প্রায় তিন বছর পর কারাগার থেকে জামিনে মুক্তি পান মিলন নামের আরেক যুবক। গাঁজাভরা একটি সিগারেটসহ মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয় বলে পুলিশের অভিযোগ। তেজগাঁও রেললাইন থেকে তাকে গ্রেপ্তার করার পর ম্যাজিস্ট্রেট আদালতের নির্দেশে পাঠানো হয় কারাগারে।
ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার হয়ে কাশিমপুর-২ কারাগারে। এভাবেই জামিনে মুক্তির আগ পর্যন্ত প্রায় তিন বছর কারাগারে জীবন কাটে মিলনের। ফুটপাতে জন্ম, ফুটপাতেই বেড়ে ওঠা মিলনের কোনো অভিভাবক না থাকায় তার জামিনের আবেদন নিয়ে কেউ এগিয়ে যায়নি।
যে অভিযোগে মিলনকে গ্রেপ্তার করা হয়, তাতে সর্বোচ্চ শাস্তি দুই বছর কারাদণ্ড। অথচ মিলনকে প্রায় তিন বছর কারাগারে থাকতে হয়েছে। এই মিলনের কারামুক্তিতে কাজ করেছে এলএএইচপি।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ঢাকা, নারায়নগঞ্জ, নরসিংদী, গাজীপুর, কিশোরগঞ্জ, টাঙ্গাইল, খুলনা, বরিশাল, চট্টগ্রাম, ব্রাহ্মণবাড়ীয়া, নোয়াখালী, কক্সবাজার, ময়মনসিংহ, জামালপুর, শেরপুর, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, রংপুর, সিলেট, সুনামগঞ্জ, মৌলভীবাজার ও হবিগঞ্জ-এই ২২ জেলায় এলএএইচপি প্যানেল আইনজীবীদের মাধ্যমে অসহায় কারাবন্দিদের বিনা টাকায় আইনি সহায়তা দিয়ে আসছে।
প্রাপ্ত তথ্যানুযায়ী, ৪২ হাজার ৬শ বন্দির ধারণক্ষমতা সম্পন্ন দেশের ৬৮টি কারাগারে বন্দি আছে ৮৪ হাজারেরও বেশি। তাদের মধ্যে মাত্র ১৬ হাজার বন্দি সাজাপ্রাপ্ত। বাকি প্রায় ৬৮ হাজার হাজতি আসামি। এই হাজতি আসামিদের কেউ কেউ বিনা বিচারে বন্দি আছেন বছরের পর বছর। বিচারে দীর্ঘসূত্রতার কারণেই আসামিদের বেশি দিন কারাগারে থাকতে হয়।
বন্দিদের মধ্যে কে কোন মামলায় কত দিন ধরে কারাগারে রয়েছে, এর হিসাব রয়েছে কারা কর্তৃপক্ষের কাছে। দেশের সব কারাগার থেকে প্রতিদিনই হিসাব পাঠানো হয় কারা অধিদপ্তরে। এরপর প্রতি মাসেই বন্দির একটি তালিকা স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে পাঠায় কারা কর্তৃপক্ষ।
সংগঠনটির চেয়ারম্যান সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তৌফিকা করিম জানান, ২০০৯ সাল থেকে সংগঠনটির যাত্রা। সংগঠনটি প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ পর্যন্ত গত ১২ বছরে একেবারে অসহায় ৬৪৪ জন কারাবন্দিকে আইনি সহায়তা দিয়ে কারামুক্ত করা হয়েছে। তিনি বলেন, বিনা ফি-তে এই সহযোগিতা দেওয়া অব্যাহত রয়েছে।
তিনি বলেন, সংগঠনের আর্থিক অসচ্ছলতার কারণে মাত্র ২২টি জেলায় তাদের কার্যক্রম চলছে। যেসব ব্যক্তিকে সন্দেহভাজন হিসেবে গ্রেপ্তার করা হয়েছে কিংবা যাদেরকে অন্যায়ভাবে ফাঁসিয়ে দেওয়া হয়েছে বলে তথ্য পাওয়া যায় শুধুমাত্র তাদেরকেই আইনগত সহায়তা দিয়ে থাকে এলএএইচপি।
জঙ্গিবাদ, হত্যা বা বড় ধরনের মাদক মামলায় কোনো বন্দিকে সহায়তা দেয় না এলএএইচপি। নিরাপরাধ কোনো ব্যক্তিকে আসামি বানিয়ে কারাগারে পাঠালে কেবল সেক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তির জামিনের জন্য কাজ করে সংগঠনটি।
তিনি বলেন, এলএএইচপি শুধুই অসহায় ব্যক্তিদের জামিনে মুক্ত করেছে তা নয়, সংগঠনটির উদ্যোগে গত দুই বছর অতিমারি করোনার মধ্যে রাজধানী ঢাকা ও কুমিল্লায় অসহায় প্রায় ২ হাজার মানুষকে খাদ্য সহায়তা দেওয়া হয়েছে।
দেশের বিভিন্ন জেলায় মাস্ক বিতরণ করা হয়েছে। জনগনের মধ্যে করোনা সম্পর্কে সচেতনতা সৃষ্টির জন্য বিভিন্ন কর্মসূচি বাস্তবায়ন করা হয়েছে। তিনি বলেন, সংগঠনটির কাজের স্বীকৃতি হিসেবে ২০১৫ সালের ডিসেম্বরে সুপ্রিম কোর্ট লিগ্যাল এইড কমিটিতে বেসরকারি সংস্থার সদস্য হিসেবে মনোনয়ন দিয়েছে জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা। শুধু তাই নয়, সরকারের
জাতীয় আইনগত সহায়তা প্রদান সংস্থা কর্তৃক ২০১৯ সালে ‘সেরা দেশীয় বেসরকারি সংস্থা-২০১৯’ হিসেবে স্বীকৃতি পেয়ে এলএএইচপি। সংগঠনটির প্রধান সমন্বয়ক অঞ্জন কর জানান, এলএএইচপি অসহায় ও সুবিধাবঞ্চিত নাগরিকদের বিনামূল্যে আইনি সহায়তার পাশাপাশি সময়োপযোগী বহুমুখী মানবিক সহায়তা কার্যক্রম পরিচালনা করে এলএএইচপি একটি মানবকল্যাণ ও সেবামূলক সংস্থা।
মন্তব্য