-->

মামলাবাজ সিন্ডিকেট

রেহাই পাচ্ছে না পুলিশও

এমদাদুল হক খান
মামলাবাজ সিন্ডিকেট
প্রতীকী ছবি

রাজধানীতে গড়ে উঠেছে মামলাবাজ সিন্ডিকেট চক্র। এ সিন্ডিকেটে রয়েছে বেশ কয়েকজন নারী সদস্য। তারা রাজধানীর বিভিন্ন থানায় ভুয়া মামলা দিয়ে হয়রানি করছে সাধারণ মানুষকে। এ চক্রের হাত থেকে রেহাই পাচ্ছে না সরকারি চাকরিজীবী, শিক্ষাবিদ, ব্যবসায়ী এমনকি পুলিশের বাঘা বাঘা কর্মকর্তারাও। চক্রের নারী সদস্যদের দিয়ে ধর্ষণ মামলা করিয়ে ফাঁদে ফেলে হাতিয়ে নেওয়া হচ্ছে লাখ লাখ টাকা। এ রকম মামলাবাজ সিন্ডিকেটের নারী সদস্যরা হলেন রিজিয়া বেগম, সীমা বেগম, মুক্তা আক্তার নদী, রুমানা আক্তার পুতুল, ঝর্ণা, তাহমিনা, সাথী, লিপি, আরজু, তামান্না ও পিংকি অন্যতম। গোটা রাজধানীতে নারীদের দিয়ে যেসব ভুয়া মামলা করা হচ্ছে, সেসব মামলার বাদী হলেন এরাই।

#থানা মামলা নিতে না চাইলে আদালতে পুলিশের বিরুদ্ধে মামলা

#মামলার পর বাদী ও বিবাদী দুই পক্ষের কাছে চাঁদাবাজি করে মামলাবাজ সিন্ডিকেট

#নারী সদস্যদের দিয়ে ধর্ষণ মামলা দিয়ে হাতিয়ে নিচ্ছে লাখ লাখ টাকা

এ রকম মামলাবাজ সিন্ডিকেট গোটা রাজধানীতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে। এরা বিভিন্ন পেশার মানুষকে টার্গেট করে। টার্গেট করা ব্যক্তির কাছে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে আদালতে মামলা ঠুকে দেয়। এরপর চাঁদার পরিমাণ বেড়ে যায়।

গত ৯ মার্চ রাজধানীর ডেমরার স্টাফ কোয়ার্টার এলাকার ‘হোটেল ফেসী ইন’ নামে একটি আবাসিক হোটেলে এক তরুণীকে আটকে রেখে ধর্ষণের অভিযোগ ওঠে। হোটেল ম্যানেজার বলেন, এমন কোনো ঘটনা ঘটেনি। এমনকি এই নামে কোনো গেস্টও আসেনি। সেলিম নামে একজন হোটেলে চাঁদা দাবি করে। চাঁদা না দিলে ওই ব্যক্তি এক তরুণীকে দিয়ে হোটেলের নামে মিথ্যা মামলা করেছে বলে অভিযোগ করেন তিনি। অবশ্য হোটেল ফেসী ইন-এর বিরুদ্ধে অভিযোগ রয়েছে, নারীদের দিয়ে সেখানে অনৈতিক বাণিজ্য করা হয়। যদিও হোটেল কর্তৃপক্ষ তা অস্বীকার করেন।

মামলার বাদী ভুক্তভোগী ওই তরুণী বলেন, সাবেক প্রেমিকের বিরুদ্ধে আইনি ব্যবস্থা নিতে তিনি যাত্রাবাড়ী থানায় যান। সেখানে পুলিশ তার বিরুদ্ধে মামলা নিতে অপরাগতা প্রকাশ করে। থানা থেকে বেরিয়ে সামনে সেলিম নামে এক ব্যক্তির সঙ্গে পরিচয় হয়। ওই ব্যক্তি তাকে জানায় যে, তোমাকে সব সহযোগিতা করব, যদি তুমি আমার কথা শোন। সে বলে, তোমার সাবেক প্রেমিকের বিরুদ্ধে একাধিক ধর্ষণ মামলা করতে হবে। ওই ব্যক্তি ডেমরা স্টাফ কোয়ার্টার রোডের একটি আবাসিক হোটেলের ঠিকানা জানিয়ে দেয়। ওই হোটেলের ঠিকানা ধরে তিনি যাত্রাবাড়ী থানায় মামলা করতে যান। পরে পুলিশ মামলা না নিলে তিনি আদালতে গিয়ে যাত্রাবাড়ী থানার পুলিশের কয়েক কর্মকর্তার নাম ও তার সাবেক প্রেমিকার নাম উল্লেখ করে মামলা করেন।

পরে তিনি কথিত ওই সাংবাদিকের সিন্ডিকেটের লিপি নামে এক নারীর সহায়তায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের ওয়ান স্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি হন।

ডেমরা থানায় করা মামলায় যে সময়ের ধর্ষণের অভিযোগ করা হয়েছে, ওই সময়ের হোটেলের সিসি ক্যামেরার ভিডিও ফুটেজ পর্যবেক্ষণ করে দেখা গেছে, এমন কেউ হোটেলে প্রবেশ করেনি।

মামলায় অভিযুক্ত যুবক, ভুক্তভোগী তরুণী, সহায়তাকারী নারী কেউই ঘটনার আগে পড়ে এক সপ্তাহে ডেমরা এলাকায় যাননি। ভুক্তভোগী তরুণী জানায়, সাবেক প্রেমিকের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তিনি যাত্রাবাড়ী থানায় যান। সেখান থেকে বের হয়ে সেলিম নামক একজনের সঙ্গে পরিচয় হয়। ন্যায়বিচার পাইয়ে দেওয়ার মিথ্যা প্রলোভনে পড়ে সাবেক প্রেমিককে শায়েস্তা করতে তিনি এই মামলা করেন।

তিনি বলেন, আমি তাদের কথামতো কাজ করতে শুরু করলে তারা বলল যে, ছেলেটার নামে একাধিক ধর্ষণের মামলা করলে শাস্তি পাবে। কোনো কারণে এই মামলা যদি থানায় না নেয়, তাহলে পুলিশের বিরুদ্ধে দায়িত্বে অবহেলার অভিযোগ এনে আদালতে মামলাও করা যাবে।

লিপি নামে নারী ওই তরুণীকে ঢামেক হাসপাতালের ওয়ানস্টপ ক্রাইসিস সেন্টারে ভর্তি করেন। ওই লিপিও সেলিমের সিন্ডিকেট সদস্য।

এ ব্যাপারে পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপ-কমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, ওই তরুণীর সাবেক প্রেমিককে শায়েস্তা করতে একটি প্রতারক চক্রের সহায়তায় মিথ্যা মামলা করেন।

এ ব্যাপারে ফেসী ইন হোটেলের মালিক জয় বলেন, উল্লিখিত ঘটনার কয়েক দিন আগে সেলিম হোটেলে ২ লাখ টাকা চাঁদা দাবি করে। চাঁদা দিতে অস্বীকার করলে সে হুমকি দেয় যে, এই হোটেলের নামে সংঘবদ্ধ ধর্ষণের ঘটনা সাজিয়ে আদালতে মামলা করা হবে। ওই ব্যক্তি এক তরুণীকে দিয়ে মিথ্যা মামলা করায়।

একইভাবে এ রকম আরেকটি মামলাবাজ সিন্ডিকেট দিয়ে হাতিরঝিল থানার ওসিসহ ১৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে ধর্ষণ মামলার আবেদন করে। মামলার আবেদনের বলা হয়েছে, হাতিরঝিলের উলন রোডের একটি বাড়িতে পুতুল নামের তরুণীকে কয়েকজন মিলে গণধর্ষণ করে।

এ ব্যাপারে হাতিরঝিল থানার ওসি আবদুর রশিদ বলেন, কয়েক দিন আগে পুতুল নামে এক তরুণী একটি ধর্ষণ মামলা করতে আসেন। কিন্তু তার কথাবার্তায় অসংলগ্নতা পরিলক্ষিত হয়। পরে তাকে বলা হয় যে, আপনি এ ব্যাপারে পর্যাপ্ত প্রমাণ নিয়ে আসেন, আমরা মামলা নেব। তখন ওই তরুণী একটু মন খারাপ করে থানা থেকে চলে যায়। পরে ওই তরুণী ডিএমপি কমিশনারের কাছে পুলিশের বিরুদ্ধে লিখিত অভিযোগ করেন। পরে তিনি ১৬ মার্চ হাতিরঝিল থানার ওসিসহ পাঁচ পুলিশ কর্মকর্তার নাম উল্লেখ করে ১৩ জনের বিরুদ্ধে আদালতে একটি ধর্ষণ মামলা করেন।

এ রকম এক ভুক্তভোগী পাভেল হোসেন পাপন বলেন, পাঁচ বছর আগে রিজিয়া বেগম নামে এক নারীকে দিয়ে আদালতে তার বিরুদ্ধে মানব পাচারের মামলা করে। এরপর আমাকে গ্রেপ্তার করা হয়। জামিন পাওয়ার পর সেলিম নামে এক ব্যক্তি জানায়, ৩ লাখ টাকা দিলে মানব পাচারের মামলা তুলে নেওয়া হবে। পরে বাধ্য হয়ে রাজি হই। এরপর এই পাভেল হোসেন পাপন প্রকৃত আসামি নয় বলে আদালতে মুচলেকা দেয়। এরপরই ওই মামলা থেকে তিনি রেহাই পান। এরপর কয়েকদিন আগে আবারো রিজিয়া বেগম নামে ওই নারী ফোন দিয়ে জানায় যে, তার বিরুদ্ধে হাতিরঝিল থানা এলাকায় গণধর্ষণের অভিযোগে আদালতে মামলা হয়েছে। এই মামলায়ও পুলিশ তাকে গ্রেপ্তার করে। পরে জামিনে মুক্তি পান।

মাদারীপুরে বিআইডব্লিউটিএ’র রেকর্ড কিপার সঞ্জীব কুমার দাশসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে আদালতে ধর্ষণের মামলা করে মামলাবাজ সিন্ডিকেটের সদস্য রিজিয়া বেগম। এই মামলা দায়েরের তিন মাস পর সীমা বেগম নামে আরেক নারী বাদী হয়ে সঞ্জীব কুমার দাসসহ কয়েকজনকে আসামি করে আদালতে গণধর্ষণের মামলা করেন। মামলায় অভিযোগ করা হয়, খিলগাঁও থানা এলাকার একটি বাড়িতে ওই নারী গণধর্ষণের শিকার হয়েছেন।

এই মামলার পরপরই সঞ্জীব কুমার গ্রেপ্তার হয়। তাকে চাকরি থেকে সাময়িক বরখাস্ত করা হয়। গতকাল শুক্রবার সঞ্জীব কুমার ভোরের আকাশকে বলেন, ‘আমার বিরুদ্ধে ধর্ষণের মামলা করে সামাজিকভাবে আমার মানসম্মান শেষ করে দিয়েছে। আমি লজ্জায় কোথাও যেতে পারি না। ভাই-বোনদের মুখ দেখাতে পারছি না।

মামলার তদন্তকারী কর্মকর্তা খিলগাঁও থানার পরিদর্শক নুরুল ইসলাম সুমন বলেন, এই দুই মামলার বাদী রিজিয়া বেগম ও সীমা বেগমকে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। তাদের মোবাইল ফোনও বন্ধ। এ ব্যাপারে মামলায় উল্লিখিত বাদীর ঠিকানায় গিয়ে তাদের খুঁজে পাওয়া যায়নি। শাহাবুদ্দিন নামে এক নিরাপত্তা প্রহরী বলেন, আমি একটা অভিযোগ নিয়ে যাত্রাবাড়ী থানায় গিয়েছিলাম। পরে সীমা বেগম নামে এক নারী ফোন করে জানায় যে, তুই থানায় গেলি ক্যান? তোর বিরুদ্ধে আদালতে ধর্ষণের মামলা করব। এরপর সীমা বেগম আদালতে তার বিরুদ্ধে ধর্ষণ মামলা করে।

এ ব্যাপারে গতকাল শুক্রবার যাত্রাবাড়ী থানার ওসি মাজহারুল ইসলাম বলেন, মামলাবাজ এই চক্রটি এর আগেও পুলিশের বিরুদ্ধে মিথ্যা মামলা করেছে। যাত্রাবাড়ী থানার সাবেক ওসি কাজী ওয়াজেদ আলী মিয়ার বিরুদ্ধে মামলা করেছে। এই চক্রটি দীর্ঘদিন ধরে এ রকম মামলা করে আসছে। পুলিশের ওয়ারী বিভাগের উপকমিশনার শাহ ইফতেখার আহমেদ বলেন, এসব মামলাবাজ সিন্ডিকেটের মিথ্যা মামলার শিকার ব্যক্তিরা থানায় অভিযোগ করলে পুলিশ ব্যবস্থা নেবে।

মন্তব্য

Beta version