-->
শিরোনাম

সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মামলায় বিচার এখনো শুরু হয়নি

রাজন ভট্টাচার্য
সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের মামলায় বিচার এখনো শুরু হয়নি

ঢাকা: গত বছর দুর্গোৎসবে কথিত ধর্ম অবমাননাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে পূজামণ্ডপ, মন্দিরে হামলাসহ সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ঘটনায় দায়ের করা মামলার বিচারকাজ এখনো শুরুই হয়নি। এ নিয়ে ক্ষোভ আছে হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মনে। এর মধ্যেই আজ শনিবার মহাষষ্ঠীর মধ্য দিয়ে পাঁচ দিনব্যাপী সনাতন ধর্মাবলম্বীদের সবচেয়ে বড় ধর্মীয় উৎসব শারদীয় দুর্গাপূজা শুরু হচ্ছে।

 

যদিও বাংলাদেশ পূজা উদযাপন পরিষদের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নিরাপত্তার দিক বিবেচনায় সারাদেশের মণ্ডপে প্রস্তুতি সম্পন্ন। এদিকে আওয়ামী লীগের পক্ষ থেকেও সারাদেশে পূজামণ্ডপ পাহারা দিতে দলের নেতাকর্মীদের নির্দেশ দেয়া হয়েছে। সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাস প্রতিরোধে জেলা-উপজেলায় অনুষ্ঠিত হয়েছে সম্প্রীতি সমাবেশ। গঠন করা হয়েছে বিশেষ কমিটিও।

 

গত বছরের ১৩ অক্টোবর কুমিল্লার নানুয়া দীঘিরপাড় পূজামণ্ডপে পবিত্র কোরআন অবমাননাকে কেন্দ্র করে দেশের বিভিন্ন স্থানে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় সরকারের উচ্চপর্যায় থেকে দুষ্কৃতকারীদের দ্রুত খুঁজে বের করে ব্যবস্থা নেয়ার আশ্বাস দেয়া হয়েছিল। সব মিলিয়ে ২০টির বেশি জেলায় সাম্প্রদায়িক সন্ত্রাসের ঘটনা ঘটে। তবে কুমিল্লার সেই নানুয়ার দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে এবারও দুর্গোৎসবের আয়োজন করা হয়েছে। মনের ক্ষত না শুকালেও উৎসবের সার্বিক প্রস্তুতি চূড়ান্ত হওয়ার কথা জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

 

গত বছর কথিত ধর্ম অবমাননার অভিযোগে কুমিল্লা, নোয়াখালী ও চাঁদপুরের হামলার ঘটনায় সব মিলিয়ে ৫৪টি মামলা হয়। এর মধ্যে নোয়াখালীর ৩২টি মামলায় ২৪টিতে, কুমিল্লায় ১২টির মধ্যে ৬টি ও চাঁদপুরে ১০টি মামলার মধ্যে ৬টিসহ মোট ৩৬টি মামলায় অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়া হয়েছে। বাকি ১৮ মামলা এখনো তদন্ত পর্যায়ে রয়ে গেছে। অর্থাৎ ঘটনার এক বছরেও ৩৩ শতাংশ মামলার তদন্তকাজ এখনো শেষ হয়নি।

 

বিচার না পাওয়ার বেদনা নিয়েই এ বছর সারা দেশে ৩২ হাজার ১৬৮টি মণ্ডপে পূজা উদযাপন হবে বলে জানিয়েছে বাংলাদেশ পূজা উদ্যাপন পরিষদ। এবার পূজার আগে, পরে ও পূজার দিন তিন স্তরের নিরাপত্তা ব্যবস্থা নিয়েছে পুলিশ। সম্প্রতি পুলিশ সদর দপ্তর থেকে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, দেশের সব পূজামণ্ডপে সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন এবং প্রবেশপথে মেটাল ডিটেক্টর ও আর্চওয়ে গেট স্থাপন করবে পুলিশ।

 

কুমিল্লা নগরের নানুয়াদীঘির উত্তরপাড়ে দর্পণ সংঘ পূজামণ্ডপের সভাপতি ও কুমিল্লা মহানগর পূজা উদ্যাপন কমিটির সাধারণ সম্পাদক অচিন্ত্যদাস টিটু বলেন, ‘এবার কড়া নিরাপত্তায় পূজা হবে। আমরা শক্তিশালী সিসিটিভি ক্যামেরা স্থাপন করেছি। ২৪ ঘণ্টা পাহারা থাকবে। স্বেচ্ছাসেবক, আনসার ও পুলিশ পালা করে থাকবে। কুমিল্লা নগরের কান্দিরপাড় নজরুল অ্যাভিনিউ কাত্যায়নী কালীবাড়ি মন্দিরেও শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি চলছে। বরুড়া উপজেলার মহেশপুর রাধারানী মন্দিরেও চলছে প্রতিমায় রংতুলির আঁচড়ের কাজ।

 

ভয় ছাপিয়ে উৎসবের প্রস্তুতি নিচ্ছেন নোয়াখালীর হিন্দু ধর্মাবলম্বীরা। মণ্ডপে মণ্ডপে চলছে দুর্গোৎসবের শেষ মুহূর্তের প্রস্তুতি। রাধা মাধব জিওর মন্দিরের সভাপতি মধুসূদন ভৌমিক বলেন, গত বছর পূজামণ্ডপে তাণ্ডবের পর মনের ভেতর যে ক্ষতের সৃষ্টি হয়েছে, সেটি সহজে যাবে না। তবে প্রশাসনের নানামুখী পদক্ষেপে তারা শান্তিপূর্ণভাবে পূজা উদযাপনে আশ্বস্ত হয়েছেন। সে কারণে প্রস্তুতিতে কোনো ধরনের কমতি নেই। একই কথা বললেন জেলা হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বিনয় কিশোর রায়। প্রশাসন স্থানে স্থানে সম্প্রীতি সমাবেশ করায় তারা আশ্বস্ত হয়েছেন।

 

কুমিল্লার ঘটনার জের ধরে গত বছর চাঁদপুরের হাজীগঞ্জ বাজারে বিক্ষোভ মিছিল বের হয়। তখন হাজীগঞ্জ পৌর এলাকাসহ উপজেলার আশপাশে কয়েকটি মন্দির ও মণ্ডপে হামলা ও ভাঙচুরের ঘটনা ঘটে। সেই হাজীগঞ্জে এবার ২৯টি মণ্ডপে দুর্গাপূজার প্রস্তুতি নেয়া হয়েছে। এ জন্য প্রশাসন সম্প্রীতি সমাবেশসহ মণ্ডপে মণ্ডপে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করেছে বলে জানা গেছে।

 

মন্দির-মণ্ডপে হামলা, ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনায় কুমিল্লার চার থানায় গত বছর ১২টি মামলা হয়। এর মধ্যে ছয়টি মামলার অভিযোগপত্র আদালতে দাখিল করা হয়েছে। চারটি মামলার তদন্ত শেষ, দুটি মামলার তদন্ত চলছে। ছয় মামলায় ২৪১ জনের নামে অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। এ অবস্থায় হিন্দু ধর্মাবলম্বীদের মধ্যে চাপা ক্ষোভ রয়েছে। তারা দ্রুত বিচার শুরু করার দাবি জানিয়েছেন।

 

পুলিশ সূত্রে জানা গেছে, গত বছরের ১৩ অক্টোবর সকালে কুমিল্লা নগরের নানুয়াদীঘির উত্তরপাড়ে শারদীয় দুর্গাপূজা উপলক্ষে দর্পণ সংঘের উদ্যোগে আয়োজিত পূজামণ্ডপ থেকে পবিত্র কোরআন শরিফ উদ্ধার করা হয়। এরপর এ ঘটনাকে কেন্দ্র করে ওই দিনই নগরের চারটি মন্দির, সাতটি পূজামণ্ডপ ভাঙচুর ও অগ্নিসংযোগের ঘটনা ঘটে। এতে আহত হন অন্তত ৩০ জন। পরে সিসিটিভির ফুটেজ দেখে ঘটনার মূল হোতাকে গ্রেপ্তার করে পুলিশ।

 

এ ১২ মামলার ছয়টির তদন্ত করছে সিআইডি। এর মধ্যে পাঁচটির অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। পিবিআইয়ের কাছে থাকা চারটির মধ্যে একটি মামলার অভিযোগপত্র দেয়া হয়েছে। আর পুলিশের কাছে থাকা দুটি মামলার এখনো কোনো অভিযোগপত্র দেয়া হয়নি।

 

জানতে চাইলে কুমিল্লার জেলা পুলিশ সুপার মো. আবদুল মান্নান বলেন, কোতোয়ালি মডেল থানার দুটি মামলার তদন্ত শেষ হয়েছে। অভিযোগপত্র প্রস্তুত। পুলিশ সদর দপ্তর থেকে প্রশাসনিক অনুমোদন আসার পর আদালতে অভিযোগপত্র উপস্থাপন করা হবে।

 

গত বছরের ১৪ ও ১৫ অক্টোবর নোয়াখালীর পূজামণ্ডপে হামলা-ভাঙচুর, লুটপাট ও দুই মৃত্যুর ঘটনায় দায়ের হওয়া ৩২টি মামলার মধ্যে ২৪টির অভিযোগপত্র আদালতে জমা দেয়া হয়েছে। পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ সিআইডির কাছে থাকা সাতটি মামলার তদন্ত শেষ পর্যায়ে রয়েছে। এ ছাড়া জেলা পুলিশের কাছে থাকা ১০টি মামলার মধ্যে একটি মামলার তদন্ত এখনো শেষ হয়নি বলে জানা গেছে।

 

চাঁদপুরের হাজীগঞ্জে ১০টি মামলার ৬টিতে অভিযোগপত্র জমা দেয়া হয়েছে। চাঁদপুরের অতিরিক্ত পুলিশ সুপার সুদীপ্ত রায় গণমাধ্যমকে বলেন, এসব মামলার মধ্যে পুলিশ দুটি, ডিবি পুলিশ দুটি, সিআইডি একটি ও পিবিআই একটি মামলার অভিযোগপত্র ইতোমধ্যে জমা দিয়েছে। তবে এখনো চারটি তদন্তাধীন আছে। শিগগির এগুলোর অভিযোগপত্র জমা দেয়া হবে।

 

হতাশা ছাপিয়ে আশার কথা শোনালেন নোয়াখালী হিন্দু বৌদ্ধ খ্রিস্টান ঐক্য পরিষদের সভাপতি বিনয় কিশোর রায়। তিনি বলেন, প্রতিটি পূজামণ্ডপে পর্যাপ্ত আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্য মোতায়েন করা হয়েছে। নিরাপত্তা নিয়ে এখন পর্যন্ত কোনো সমস্যা নেই। এবারের পূজা উৎসবে পরিণত হোক। সেই প্রস্তুতিই নিয়েছেন তারা।

 

তবে নানুয়ার দীঘির পাড়ের পূজামণ্ডপে কোরআন শরিফ উদ্ধারের পর সারা দেশে সাম্প্রদায়িক সহিংসতার ক্ষত না শুকালেও সব ভুলে দুর্গাপূজার আনন্দে মেতে উঠতে চান কুমিল্লার সনাতন ধর্মাবলম্বীরা।

 

কুমিল্লা সদর আসনের সংসদ সদস্য ও মহানগর আওয়ামী লীগের সভাপতি আ ক ম বাহাউদ্দিন বাহার এরই মধ্যে ঘোষণা দিয়েছেন, এ বছর নানুয়ার দীঘির পাড়ের ওই অস্থায়ী দুর্গাপূজা মণ্ডপসহ প্রতিটি স্থানে সর্বোচ্চ সতর্কতায় পূজা উদযাপন করা হবে।

 

এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে এমপি বাহার বলেন, এ বছর আমরা সর্বোচ্চ সতর্ক আছি। নানুয়ার দীঘির পাড়ে এবার অবশ্যই জাঁকজমকভাবে পূজা হবে। এবার যদি কেউ কোনো পূজামণ্ডপে হামলা করে, সে পালিয়ে বাঁচতে পারবে না। এবার কোনো ষড়যন্ত্র হলে ষড়যন্ত্রকারীদের কঠোর হাতে দমন করা হবে। আওয়ামী লীগ ও অঙ্গসংগঠনের পক্ষ থেকে কুমিল্লা নগরীর প্রতিটি পূজামণ্ডপ এলাকায় স্বেচ্ছাসেবী কাজ করবে।

 

ভোরের আকাশ/আসা

মন্তব্য

Beta version