বহুল আলোচিত সেই মো. জালাল ওরফে জজ মিয়াকে পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দেয়ার প্রশ্নে রুল জারি করেছেন হাইকোর্ট। রুলে ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলার ঘটনায় জজ মিয়াকে ‘ভুলভাবে গ্রেপ্তার, আটক ও বন্দি রাখা’ কেন অবৈধ ও আইনগত কর্তৃত্ববহির্ভূত ঘোষণা করা হবে না এবং অন্যায়ভাবে চিহ্নিত করে আটক রাখায় জজ মিয়ার মৌলিক অধিকার গুরুতরভাবে লঙ্ঘিত হওয়ায় তাকে কেন পর্যাপ্ত ক্ষতিপূরণ দিতে নির্দেশ দেয়া হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
বিচারপতি মো. মজিবুর রহমান মিয়া ও বিচারপতি কাজী মো. ইজারুল হক আকন্দের হাইকোর্ট বেঞ্চ মঙ্গলবার এ আদেশ দিয়েছেন। স্বরাষ্ট্র সচিব, আইজিপি, সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক আইজিপি খোদা বকশ্ চৌধুরীসহ ১১ জনকে চার সপ্তাহের মধ্যে রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় বেআইনিভাবে আটক রাখা ও তার কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায় করায় ১০ কোটি টাকা ক্ষতিপূরণ চেয়ে জজ মিয়ার করা রিট আবেদনের ওপর প্রাথমিক শুনানি নিয়ে এ আদেশ দেন আদালত। রিট আবেদনকারীর পক্ষে আইনজীবী ছিলেন ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল অরবিন্দু কুমার রায়।
জজ মিয়ার পক্ষে ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব গত ১২ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টে রিট আবেদন দাখিল করেন। রিট আবেদনে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক আইজিপি খোদা বকশ্ চৌধুরী, সাবেক এএসপি আব্দুর রশিদ, মুন্সি আতিকুর রহমান ও সাবেক বিশেষ পুলিশ সুপার রুহুল আমিনের সম্পদ রাষ্ট্রের অনুকূলে বাজেয়াপ্ত করে সেখান থেকে ওই ক্ষতিপূরণের টাকা আদায় করে দেয়ার নির্দেশনা চাওয়া হয়। একই সঙ্গে জজ মিয়াকে এই মামলায় গ্রেপ্তার করে ৪ বছর কারাগারে রাখার ঘটনায় জড়িতদের চিহ্নিত করতে আপিল বিভাগের একজন অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতির নেতৃত্বে একটি কমিটি গঠনের নির্দেশনা চাওয়া হয়।
ক্ষতিপূরণ চেয়ে জজ মিয়ার পক্ষে আইনি নোটিশ পাঠানোর পর কোনো পদক্ষেপ না নেয়ায় এই রিট আবেদন দাখিল করা হয়। ক্ষতিপূরণ আদায় করে দিতে ও তদন্ত কমিটি গঠন করতে ১৫ দিন সময় দিয়ে গত ১১ আগস্ট সংশ্লিষ্টদের আইনি নোটিশ দিয়েছিলেন ব্যারিস্টার মোহাম্মদ হুমায়ন কবির পল্লব ও ব্যারিস্টার মোহাম্মদ কাউসার।
রিট আবেদনে জজ মিয়াকে বেআইনিভাবে আটক রাখা ও তার কাছ থেকে জোর করে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি আদায়ে বাবর, খোদা বকশ্ চৌধুরী, আব্দুর রশিদ, মুন্সি আতিক, রুহুল আমিন ছাড়াও আরো কেউ ছিল কিনা তা খুঁজে বের করা ও তাদের দায় নিরূপণ করতে একটি তদন্ত কমিটি গঠন করতে বলা হয়।
রিট আবেদনে বলা হয়, ২০০৫ সালের ১০ জুন জজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয়। এই মামলায় জড়িত থাকার অভিযোগে অন্য ২০ জনসহ তাকে গ্রেপ্তার করা হয়। এরপর কোনো অপরাধ ছাড়াই তাকে প্রায় চার বছর কারাগারে রাখা হয়। এ সময়ে তার মাকে প্রতি মাসে ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকা দেয়া হতো। এভাবে তার মৌলিক অধিকার হরণ করা হয়েছে। ২০০৯ সালের জুনে তিনি মুক্তি পান। নোটিশে বলা হয়, প্রকৃত অপরাধীদের আড়াল করতেই জজ মিয়া নাটক সাজানো হয়।
বিএনপির নেতৃত্বাধীন চারদলীয় জোট ক্ষমতায় থাকাকালে ২০০৪ সালের ২১ আগস্ট ঢাকার গুলিস্তানের বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে তৎকালীন বিরোধীদলীয় নেতা শেখ হাসিনার সমাবেশে গ্রেনেড হামলা চালানো হয়। এতে সাবেক রাষ্ট্রপতি জিল্লুর রহমানের স্ত্রী আইভি রহমানসহ আওয়ামী লীগের ২৪ জন নেতাকর্মী নিহত হন। অসংখ্য ব্যক্তি আহত হন। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় নোয়াখালীর সেনবাগ থেকে জজ মিয়াকে গ্রেপ্তার করা হয় ২০০৫ সালের ৯ জুন। তাকে বেশ কয়েকদিন রিমান্ডে রাখা হয়। এ অবস্থায় ২৬ জুন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দেন জজ মিয়া।
জবানবন্দিতে তিনি বলেন, ৫ হাজার টাকার বিনিময়ে বড়ভাইদের নির্দেশে তিনি এই হামলায় অংশ নেন। জবানবন্দিতে বড়ভাই হিসেবে পুলিশের তালিকাভুক্ত শীর্ষ সন্ত্রাসী সুব্রত বাইন, জয়, মোল্লা মাসুদ, মুকুলের নাম বলা হয়। এরপর পুলিশ হরকাতুল জিহাদ নেতা মুফতি আব্দুল হান্নান, সুব্রত বাইনসহ ২২ জনকে আসামি করে আদালতে অভিযোগপত্র দেয়। কিন্তু চারদলীয় জোট সরকারের বিদায়ের পর জজ মিয়া অভিযোগ করেন, তাকে জোর করে অর্থের বিনিময়ে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিতে বাধ্য করা হয়েছে। এ ঘটনায় মামলায় নতুন মোড় নেয়। পুলিশ অধিকতর তদন্ত শেষে জজ মিয়াকে সাক্ষী করে বাবর, তারেক রহমান, জামায়াতে ইসলামীর সে সময়কার সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মুহাম্মদ মুজাহিদসহ ৩০ জনের বিরুদ্ধে ২০০৮ সালের ১১ জুন সম্পূরক অভিযোগপত্র দাখিল করে। এ ঘটনায় দায়ের করা মামলায় পৃথক দুটি অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়। একটি হত্যা এবং অপরটি বিস্ফোরক দ্রব্য আইনে। এরপর বিচার শেষে ২০১৮ সালের ১০ অক্টোবর রায় দেয় ঢাকার দ্রুত বিচার ট্রাইব্যুনাল-১।
রায়ে সাবেক স্বরাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী লুৎফুজ্জামান বাবর, সাবেক শিক্ষা উপমন্ত্রী আবদুস সালাম পিন্টুসহ ১৯ জনকে মৃত্যুদণ্ড এবং বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান, সাবেক প্রধানমন্ত্রীর (খালেদা জিয়া) রাজনৈতিক সচিব হারিছ চৌধুরী ও সাবেক সংসদ সদস্য কাজী শাহ মোফাজ্জল হোসেন কায়কোবাদসহ ১৯ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেয়া হয়েছে। দুটি মামলায় তাদের অভিন্ন সাজা দেয়া হয়েছে। এরপর মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্তদের সাজা অনুমোদনের জন্য ২০১৮ সালের ২৭ নভেম্বর হাইকোর্টে ডেথ রেফারেন্স পাঠানো হয়। এরপর কারাবন্দি আসামিরা ওই রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করেন, যা বিচারাধীন।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য