কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান খেলাপী ঋণ আদায়ের জন্য কোনো ব্যক্তির বিরুদ্ধে চেক ডিজঅনারের (চেক অনাদায়ী) মামলা করতে পারবে না বলে রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। একইসঙ্গে বিচারিক আদালতে নেগোশিয়েবল ইনস্ট্রুমেন্ট অ্যাক্ট, ১৮৮১-এর অধীনে দায়ের সকল চেক ডিজঅনার মামলার কার্যক্রম বন্ধ রাখার নির্দেশ দেয়া হয়েছে। তবে ঋণ আদায়ের জন্য ২০০৩ সালের অর্থঋণ আইনে মামলা করা যাবে বলে অভিমত দিয়েছেন হাইকোর্ট। এছাড়া আপিল দায়েরের সময় মোহাম্মদ আলীর জমাকৃত অর্থ ফেরত দিতেও সরকারের সংশ্লিষ্টদের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
আদালত বলেছেন, ব্যাংক ঋণের বিপরীতে যে চেক নেয়া হচ্ছে, সেটা জামানত। সেটা বিনিময়যোগ্য দলিল নয়। জামানত হিসেবে রাখা সেই চেক দিয়ে চেক ডিজঅনার মামলা করা যাবে না।
আদালত বলেন, ঋণের বিপরীতে একটি ফাঁকা চেক নেওয়াটাই বেআইনি ও অবৈধ। ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানগুলি দীর্ঘদিন ধরে এই অবৈধ কার্যকলাপ করে আসছে। তাদের ব্যবহার দাদন ব্যবসায়ীদের মতো।
বিচারপতি মো. আশরাফুল কামালের একক হাইকোর্ট বেঞ্চ বুধবার এ রায় দিয়েছেন। ঋণ আদায়ে এক ব্যক্তির বিরুদ্ধে ব্র্যাক ব্যাংকের করা চেক ডিজঅনার মামলায় নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে এ রায় দিয়েছেন হাইকোর্ট। ব্র্যাক ব্যাংকের চেক ডিজঅনার মামলার আসামি ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলীর করা আপিল আবেদনের শুনানি শেষে এ রায় দেন হাইকোর্ট। মোহাম্মদ আলীর পক্ষে ছিলেন আইনজীবী আবদুল্লাহ আল বাকী, ওয়াহিদা আফরোজ চৌধুরী ও মো. আসাদুজ্জামান এবং ব্র্যাক ব্যাংকের পক্ষে আইনজীবী ছিলেন সাইফুজ্জামান তুহিন। রাষ্ট্রপক্ষে ছিলেন ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আশেক মোমিন।
এদিকে হাইকোর্টের এ রায়ের বিরুদ্ধে আপিল করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে ব্র্যাক ব্যাংক। এবিষয়ে ব্যাংকটির আইনজীবী সাইফুজ্জামান তুহিন জানান, হাইকোর্টের এই রায়ে দেশের সবধরনের ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান ক্ষতিগ্রস্ত হবে। এজন্য আমরা সিএমপি করব।
ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. আশেক মোমিন বলেন, সারাদেশে নিম্ন আদালতে চেক ডিজঅনারের লক্ষাধিক মামলা বিচারাধীন। হাইকোর্টের রায় কার্যকর হলে এসব মামলার বিচার কার্যক্রম প্রভাবিত হবে।
জানা যায়, ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলার নবীনগর উপজেলার ব্যবসায়ী মোহাম্মদ আলী ২০১১ সালে ব্র্যাক ব্যাংকের নবীনগর শাখা থেকে ৪ লাখ টাকা ঋণ নেন। এরপর তিনি ৩৬টি কিস্তির মধ্যে ২২টি কিস্তিতে ৩ লাখ ১৮ হাজার টাকা পরিশোধ করেন। পরবর্তীতে তিনি অবশিষ্ট ঋণ ও তার বকেয়া সুদ পরিশোধ করতে পারেননি। এরপর বকেয়া বাবদ ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকার চেক দিলেও তা বাউন্স হয়ে যায়। এই প্রেক্ষাপটে ব্র্যাক ব্যাংক অবশিষ্ট ঋণ ও সুদ আদায়ের জন্য ২০১৫ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে একটি মামলা করে। মামলার পরিপ্রেক্ষিতে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ আদালত এক রায়ে মোহাম্মদ আলীকে দোষী সাব্যস্ত করে ছয় মাসের বিনাশ্রম কারাদণ্ড ও ২ লাখ ৯৫ হাজার টাকা জরিমানা করে। এ রায়কে চ্যালেঞ্জ করে ২০১৮ সালে হাইকোর্টে আপিল করেন মোহাম্মদ আলী। এই আপিলের ওপর শুনানি শেষে নিম্ন আদালতের রায় বাতিল করে রায় দিলেন হাইকোর্ট।
রায়ে নিম্ন আদালতের প্রতি দেয়া নির্দেশনায় বলা হয়েছে, আজ থেকে কোনো ব্যাংক বা আর্থিক প্রতিষ্ঠান যদি চেক ডিজঅনার মামলা করে, তাহলে আদালত তা সরাসরি খারিজ করে দেবেন। একইসঙ্গে তাদের ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আদালতে পাঠিয়ে দিতে হবে।
আদালত আরো বলেন, ব্যাংক হওয়ার কথা ছিল গরিবের বন্ধু, কিন্তু তা না হয়ে ব্যাংক ও বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠান গরিবের রক্ত চুষছে। এটা হতে পারে না। আদালত বলেন, কিছু দুর্নীতিবাজ এবং অসাধু কর্মকর্তা তাদের নিজস্ব স্বার্থে এবং তাদের গোপন এজেন্ডা বাস্তবায়নের জন্য চেকের অপব্যবহার করে এসব ডিজঅনারের মামলা করেন। তারা ঋণ আদায়ের জন্য অর্থঋণ আইনে মামলা দায়ের না করে চেক ডিজঅনার মামলা করছে। এ কারণে আমাদের ক্রিমিনাল সিস্টেম প্রায় অকার্যকর হয়ে গেছে।
হাইকোর্টের একই বেঞ্চ এর আগে গত ২৮ আগস্ট চেক ডিজঅনারের মামলায় কোনো আসামিকে কারাগারে পাঠানো যাবেনা বলে রায় দেন। রায়ে বলা হয়, সংবিধান পরিপন্থী। এই রায়ের রাষ্ট্রপক্ষের করা আপিলের পরিপ্রেক্ষিতে গত ৬ সেপ্টেম্বর হাইকোর্টের রায় স্থগিত করেন আপিল বিভাগ।
ভোরের আকাশ/আসা
মন্তব্য