ভুয়া ঠিকানা দিয়ে কাগুজে কোম্পানি খুলে তিনটি ইসলামী ব্যাংক থেকে ঋণ নেয়ার অভিযোগ তদন্ত করতে দুদক, সিআইডি, বাংলাদেশ ব্যাংক ও বিএফআইইউর প্রতি নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। চার মাসের মধ্যে এই তদন্ত সম্পন্ন করতে বলা হয়েছে।
একই সঙ্গে এই ঋণ প্রদান প্রক্রিয়ায় সম্পৃক্ত ব্যাংক কর্মকর্তাদের নাম-ঠিকানা এই সময়ের মধ্যে দাখিল করতে ব্যাংক তিনটির প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। এ ছাড়া ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নেয়ার অভিযোগের বিষয়ে ব্যাখ্যা এবং ঋণ নেয়ার বিষয়ে প্রয়োজনীয় ডকুমেন্ট দাখিল করতে এস আলম গ্রুপের চেয়ারম্যানের প্রতি নির্দেশ দেয়া হয়েছে। আগামী ৫ এপ্রিলের মধ্যে আদালতে এসব প্রতিবেদন দাখিল করতে বলা হয়েছে।
বিচারপতি মো. নজরুল ইসলাম তালুকদার ও বিচারপতি খিজির হায়াতের হাইকোর্ট বেঞ্চ গতকাল রোববার স্বপ্রণোদিত হয়ে এ আদেশ দিয়েছেন। আগামী ৫ এপ্রিল এ মামলার পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করা হয়েছে। আদালত অন্তর্বর্তীকালীন নির্দেশনার পাশাপাশি রুল জারি করেছেন।
গত ২৪ নভেম্বর প্রথম আলো পত্রিকায় ‘ইসলামী ব্যাংকে ভয়ংকর নভেম্বর’, ২৯ নভেম্বর ইংরেজি দৈনিক ডেইলি স্টার পত্রিকায় “টাকা ৭২৪৬ ক্রোর লোনস্ টু নাইন ফার্মস : বিবি প্রবিং ‘বিচ অব রুলস’ অ্যাট ইসলামী ব্যাংক” এবং ৩০ নভেম্বর আরেক ইংরেজি দৈনিক নিউ এইজ পত্রিকায় ‘এস আলম গ্রুপ লিফটস টাকা ৩০০০০ ক্রোর লোন ফ্রম আইবিবিএল অ্যালন’ শিরোনামে প্রকাশিত পৃথক তিনটি প্রতিবেদন নজরে নিয়ে এ আদেশ দেন আদালত।
এ সময় দুদকের পক্ষে অ্যাডভোকেট খুরশীদ আলম খান ও রাষ্ট্রপক্ষে ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল একেএম আমিন উদ্দিন মানিক উপস্থিত ছিলেন।
রুলে ঋণ বিতরণে অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ব্যক্তিদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কেন নির্দেশ দেয়া হবে না এবং জড়িতদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেয়ার ক্ষেত্রে সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষের নিষ্ক্রিয়তা কেন অবৈধ ঘোষণা করা হবে না, তা জানতে চাওয়া হয়েছে।
অর্থ, আইন ও স্বরাষ্ট্র সচিব, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) চেয়ারম্যান, বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইউনিট (বিএফআইইউ) ও পুলিশের অপরাধ তদন্ত বিভাগ (সিআইডি) প্রধান, ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড (আইবিবিএল), সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক লিমিটেড (এসআইবিএল) ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক এবং এস আলম গ্রুপকে চার সপ্তাহের মধ্যে এই রুলের জবাব দিতে বলা হয়েছে।
আদালত বলেছেন, আমরা কোনো পক্ষ না। আমরা স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে অভিযোগ যাচাইয়ের জন্য আদেশ দিচ্ছি। আদালত বলেন, আমরা সংবিধান অনুযায়ী শপথ নিয়েছি। রাগ-বিরাগের ঊর্ধ্বে থেকে আমরা আদেশ দেব। এ কারণেই আমাদের দায়িত্ব দুর্নীতি হচ্ছে কিনা দেখা। দুর্নীতির বিরুদ্ধে যদি কোনো বিষয় থাকে সেটা আমরা দেখব।
এর আগে গত ৩০ নভেম্বর বিষয়টি একই হাইকোর্ট বেঞ্চের নজরে আনেন অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির। তিনি আদালতের কাছে আদেশ প্রার্থনা করেন। তবে আদালত সেদিন আদেশ দেননি।
গত ২৪ নভেম্বর দৈনিক প্রথম আলোতে “ইসলামী ব্যাংকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর” শিরোনামে একটি প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ভুয়া ঠিকানা ও কাগুজে কোম্পানি খুলে ইসলামী ব্যাংক বাংলাদেশ লিমিটেড থেকে দুই হাজার কোটি টাকা তুলে নিয়েছে একটি অসাধু চক্র। সবমিলিয়ে বিভিন্ন উপায়ে ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাত হাজার কোটি টাকা তুলে নেয়া হয়েছে।
আটটি প্রতিষ্ঠানের নামে চলতি বছরেই এ অর্থ নেয়া হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি অর্থ তোলা হয়েছে চলতি মাসের ১ থেকে ১৭ নভেম্বর সময়ে। যার পরিমাণ ২ হাজার ৪৬০ কোটি টাকা। এ জন্যই ব্যাংকটির কর্মকর্তারা চলতি মাসকে ‘ভয়ংকর নভেম্বর’ বলে অভিহিত করছেন। একইভাবে বেসরকারি খাতের সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকেও ২ হাজার ৩২০ কোটি টাকা তুলে নিয়েছে কোম্পানিগুলো।
ফলে এ তিন ব্যাংকের কাছে প্রতিষ্ঠানগুলোর সুদসহ দেনা বেড়ে হয়েছে সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকা। এমন সময়ে এসব অর্থ তুলে নেয়া হয়, যখন ব্যাংক খাতে ডলার সংকটের পর টাকার সংকট বড় আলোচনার বিষয়।
গত ২৯ নভেম্বর ডেইলি স্টার পত্রিকায় প্রকাশিত প্রতিবেদনে ৯টি কোম্পানির নামে ৭২৪৬ কোটি টাকা তুলে নেয়ার অভিযোগ প্রকাশিত হয়। এ ছাড়া গত ৩০ নভেম্বর নিউ এইজ পত্রিকার এক প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলম গ্রুপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি টাকা ঋণ নিয়েছে।
এর আগে ঋণ নেয়ার ঘটনা তদন্ত করতে গত ২৭ নভেম্বর দুদক ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরকে চিঠি দেন ইসলামী ব্যাংকের পাঁচজন গ্রাহক অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ শিশির মনির, অ্যাডভোকেট মোহাম্মদ আব্দুল ওয়াদুদ, অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ সাদিক, শাইখুল ইসলাম ইমরান ও যায়েদ বিন আমজাদ। চিঠিতে বলা হয়, ‘আমরা সবাই ইসলামী ব্যাংক, বাংলাদেশ লিমিটেডের নিয়মিত গ্রাহক।
ইসলামী ব্যাংকের বিভিন্ন শাখায় আমাদের ব্যাংক অ্যাকাউন্ট রয়েছে। আমরা সাধ্যমতো ইসলামী ব্যাংকের সঙ্গে লেনদেন করে থাকি। ব্যাংকের আমানতকারী হিসেবে আমরা উদ্বিগ্ন। স্বীকৃত মতে, বর্তমানে বাংলাদেশ অর্থনৈতিক সংকট মোকাবিলা করছে।’ চিঠিতে আরো বলা হয়, ‘এ ধরনের সন্দেহজনক আর্থিক লেনদেনে আমরা সংক্ষুব্ধ। বিষয়টি আমলে নিয়ে গভীরভাবে খতিয়ে দেখার জন্য বিনীত অনুরোধ জানাচ্ছি। একই সঙ্গে তদন্তসাপেক্ষে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে কার্যকর আইনগত দৃষ্টান্তমূলক পদক্ষেপ গ্রহণ করার অনুরোধ করছি।’
এরও আগে গত ২৪ নভেম্বর ‘ইসলামী ব্যাংকে ভয়ংকর নভেম্বর’ শিরোনামে দুই হাজার চারশ ষাট কোটি টাকা ‘অসাধু চক্র’ তুলে নেয়ার অভিযোগ বিষয়ে প্রতিবেদন প্রকাশিত হয়। ওই প্রতিবেদনে ইসলামী ব্যাংক, সোশ্যাল ইসলামী ব্যাংক ও ফার্স্ট সিকিউরিটি ইসলামী ব্যাংক থেকে প্রায় সাড়ে ৯ হাজার কোটি টাকার ঋণ নেয়ার তথ্য তুলে ধরা হয়েছে।
এ ছাড়া ৩০ নভেম্বর নিউ এইজ পত্রিকায় ‘এস আলম গ্রুপ লিফটস টাকা ৩০০০০ ক্রোর লোন ফ্রম আইবিবিএল অ্যালন’ শিরোনামে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, এস আলম গ্রæপ একাই ইসলামী ব্যাংক থেকে ৩০ হাজার কোটি ঋণ নিয়েছে।
২৭ নভেম্বর ইংরেজি দৈনিক বিজনেস স্ট্যান্ডার্ড পত্রিকায় ‘লোন ডিজভারসমেন্ট ট্রেন্ড অব ইসলামী ব্যাংক’ প্রকাশিত প্রতিবেদনে অস্তিত্বহীন প্রতিষ্ঠানের নামে ইসলামী ব্যাংকের ২ হাজার ৭০০ কোটি টাকা ঋণ প্রদানে অনিয়ম।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য