-->

কারাগারে বসে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জঙ্গিদের

ইমরান আলী
কারাগারে বসে পরিকল্পনা বাস্তবায়ন জঙ্গিদের

ইমরান আলী: রাজধানীর আদালত থেকে জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় আবারো আলোচনায় এসেছে কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগার। এ কারাগারে থাকা জঙ্গিদের পরিকল্পনায় ঘটেছে মৃত্যুদÐপ্রাপ্ত জঙ্গি আনসার আল ইসলামের সামরিক শাখার প্রধান সাকিব ও শামীমকে ছিনিয়ে নেয়ার ঘটনা। শুধু এ পরিকল্পনাই নয়, কারাগারে থাকা জঙ্গিদের নিয়ে চাঞ্চল্যকর তথ্য মিলেছে। কারাগারজুড়েই জঙ্গিরা অবাধ বিচরণ করে; এমনকি আফগানিস্তানে তালেবান সরকার ক্ষমতায় আসার পর সেখানে ভ‚রিভোজ বা বিশেষ খানারও আয়োজন করেছিল জঙ্গিরা।

 

মনে করা হচ্ছে কারাগারের বাইরের চাইতে হাইসিকিউরিটি কারাগার তাদের জন্য হাইসিকিউর। সেখানে বসে হত্যা, ডাকাতি, ছিনতাইসহ নানা পরিকল্পনা করছে তারা। এদিকে কারাগার কর্তৃপক্ষ সবকিছু জেনেই নীরব দর্শকের ভ‚মিকায় থাকে। নিয়মিত তাদের নিকট থেকে মেলে মাসোহারা। কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারা জঙ্গি ছিনতাইয়ের পর ওই কারাগারে থাকা কয়েক জঙ্গিকে জিজ্ঞাসাবাদও করেছেন। কারাগারের এসব দুর্বলতা সামনে আসায় হাইসিকিউরিটি কারা কর্মকর্তাদের বদলিও করা হয়েছে।

 

ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা কারাগারে : দুই জঙ্গিকে ছিনিয়ে নেয়ার পরিকল্পনার কথা আগেই জানানো হয় কারাগারে আটক শামীম ওরফে সামির ওরফে ইমরান ও সাকিব ওরফে সাজিদ ওরফে শাহাবসহ চারজনকে। গত ২১ নভেম্বর ছিনতাইয়ের পরিকল্পনা বাস্তবায়নের আগেই কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে তাদের সঙ্গে দেখা করে এ পরিকল্পনার কথা জানান জঙ্গিদের দুই স্বজন। তাদের খোঁজা হচ্ছে। পাশাপাশি ঘটনার সময় তাদের কি করণীয় থাকবে তারও নির্দেশনা দেয়া হয়। ধারণা করা হচ্ছে, পরিকল্পনা অনুযায়ী, ঘটনার দিন দুপুরে আদালতে অপারেশন চলে। জঙ্গিদের লক্ষ্য ছিল চারজনকে ছিনিয়ে নেয়া।

 

কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা ইমরান ও সাকিবকে ছিনিয়ে নিতে সক্ষম হয়। শাহিন আলম ওরফে কামাল ও শাহ আলম ওরফে সালাউদ্দিনকে ছিনিয়ে নিতে ব্যার্থ হয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা যায়, জঙ্গি ছিনতাইয়ের ঘটনায় গ্রেপ্তারদের জিজ্ঞাসাবাদে মিলে চাঞ্চল্যকর তথ্য। এমনকি কাউন্টার টেররিজমের কর্মকর্তারাও ছুটে যান কারাগারে। সেখানে থাকা জঙ্গিদের জিজ্ঞাসাবাদও করেন তারা। ছিনতাইয়ের ঘটনায় কারাগারে থাকা জঙ্গিদের সম্পৃক্ততার তথ্যের প্রমাণও তারা পায়।

 

তালেবানদের ক্ষমতা দখল ও কারাগারে ভ‚রিভোজ : আফগানিস্তান থেকে আমেরিকান সেনা প্রত্যাহারের ঘোষণার পরপরই সক্রিয় হয়ে ওঠা তালেবনারা মাসখানেকের মধ্যে ২০২১ সালের ১৫ আগস্ট আফগানিস্তানের পুরো ক্ষমতা দখল করে নেয়। এ খবর গাজীপুরের কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারে থাকা জঙ্গিরাও পায়। এর একদিন পর ১৬ আগস্ট সেখানে ভ‚রিভোজ বা বিশেষ খানার আয়োজন করে জঙ্গিরা।

 

এদিন তারা আনন্দ উল্লাসও করে। তাদের এ উল্লাসে যোগ দেন যুদ্ধাপরাধের দায়ে আমৃত্যু কারাদÐপ্রাপ্ত জামায়াত নেতা দেলোয়ার হোসেন সাঈদি ও ফাঁসির দÐপ্রাপ্ত মোবারক হোসেন। আর এ আয়োজন করে দুর্ধর্ষ জঙ্গি বিল্লাল। এদিকে স¤প্রতি হাইসিকিউরিটি কারাগার নিয়ে গোয়েন্দা প্রতিবেদনও দেয় গোয়েন্দারা।

 

প্রতিবেদন সূত্রে জানা যায়, কাশিমপুর কারাগার পার্ট-১ দুর্ধর্ষ জঙ্গি নেতা, যুদ্ধাপরাধের দায়ে অভিযুক্ত দÐপ্রাপ্তসহ অনেক খুনি আসামিরা এ কারাগারে রয়েছেন। বিশেষ করে নব্য জেএমবির দুর্ধর্ষ বিল্লালও রয়েছে এ কারাগারেই। মূলত বিল্লালের নেতৃত্বেই কারাগারে থাকা জঙ্গিরা একজোট। মাঝেমধ্যেই তারা একসঙ্গে হয়ে মিটিং করে থাকে। এছাড়া বাইরে থেকে দর্শণার্থীদের সঙ্গে নিয়মিত দেখাশুনা; এমনকি বিভিন্ন নির্দেশনাও দিয়ে যাচ্ছে।

 

ঝিমিয়ে পড়া জঙ্গিদের সক্রিয় করতে কারাগারে বসেই ভয়ংকর পরিকল্পনা করছে জঙ্গি নেতারা। বাইরে থাকা অনুসারীদের নানা নির্দেশনা দিচ্ছে তারা। মোবাইলে বিভিন্ন সিক্রেট অ্যাপসের মাধ্যমে এসব নির্দেশনা পাঠানো হচ্ছে। কিছু অসাধু কারারক্ষীর মাধ্যমে মোবাইল ফোন ম্যানেজ করে জঙ্গি নেতারা।

 

গোয়েন্দা কর্মকর্তারা জানান, জেএমবি, হরকাতুল জিহাদ ও আনসার আল ইসলামের শীর্ষ চার নেতার মধ্যে কারাগারে যোগসাজশ হয়। তারা হলেনÑ জেএমবির নাহিদ তাসনিম ও আবু সাঈদ, আনসার আল ইসলামের আল আমিন ও হরকাতুল জিহাদের ফয়সল। তিন সংগঠনের আদর্শ প্রায় একই ধরনের হওয়ায় তারা জেলে বসেই ভয়ংকর মিশন বাস্তবায়নের অভিন্ন পরিকল্পনা করে। মোবাইলে ভার্চুয়াল মাধ্যমে কারাগারের বাইরে থাকা অনুসারীদের অর্থ সংগ্রহের নির্দেশনা দেয়।

 

নির্দেশনা অনুসারে তাদের সহযোগীরা পেশাদার ডাকাত দলের সঙ্গে মিশে শুরু করে ডাকাতি। ডাকাতির অর্থের একটি অংশ চলে যায় কারাবন্দি শীর্ষ জঙ্গি নেতাদের কাছে। কারাবন্দি নেতাদের নির্দেশনায় ডাকাতির টাকায় ‘হালাল ও ফ্রেশ’ নামে একটি ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়ে তোলে জঙ্গিরা। আর বাকি অংশ ব্যয় করা হতো সংগঠনের কথিত দাওয়াতি কাজে।

 

সুবিধা পাচ্ছে জঙ্গি নেতা ও ফাঁসির আসামি : কাশিমপুর পার্ট-১ এ নব্য জেএমবির প্রধান বিল্লালের সঙ্গে বিশেষ সখ্য রয়েছে যুদ্ধাপরাধের দায়ে ফাঁসির আসামি মোবারক হোসেনের। ফাঁসির আসামিরা বিশেষ সেলে থাকার কথা। কিন্তু মোবারক হোসেন ফাঁসির আসামি হওয়া সত্তে¡ও পুরো কারাগার ঘুরে বেড়ান, তার সঙ্গে থাকে বিল্লাল। মূলত কারাগারে এ দুজনই প্রভাবশালী। কারাগারের ভেতরে তারা ব্যবসাও করছেন। মোবারকের সহায়তায় বিল্লালের নেতৃত্বে কারাগারের ভেতরে সিগারেট ব্যবসা করছেন। কারাগারের ভেতরে যত সিগারেট যায় এগুলো বিল্লালই দেখাশুনা করেছেন।

 

এ কাজে দুই কারারক্ষী ইউসুফ ও হান্নান তাদের কাজে সহযোগিতা করছেন। এছাড়া ক্যান্টিন নিয়ন্ত্রণ, বিভিন্ন কয়েদি রাইটার নিয়োগও তারাই দিয়ে থাকেন। এ খাত থেকে মাসে কয়েক লাখ টাকা আসে। আর এ টাকা কারাগারের বাইরে থাকা বিভিন্ন জঙ্গিদের নিকট যায়। এছাড়া যেসব জঙ্গি কারাগারে রয়েছে তাদের পরিবারের নিকটও যায়। এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক এয়ার কমোডর (অব.) ইশফাক ইলাহী চৌধুরী বলেন, আইনের দীর্ঘসূত্রতার কারণে জঙ্গিরা বছরের পর বছর কারাগারেই বন্দি থাকে। বিভিন্ন পন্থায় কারাগার থেকে তারা নিজ নিজ সংগঠনের সদস্যদের বার্তা পাঠানোর খবর প্রায়ই পাওয়া যাচ্ছে।

 

ফলে বাইরের জঙ্গিরা আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর দৃঢ়তায় দুর্বল হয়ে পড়লেও কারাগারে থাকা জঙ্গিরা বড় হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। এছাড়া সাক্ষী ও উপযুক্ত প্রমাণের অভাবে জামিনে বের হয়ে কারাগারে থাকা শীর্ষ নেতাদের দেয়া নির্দেশ পালন করছে অনেকে। এ অপতৎপরতা দমনে দ্রæত বিচার কার্যকর করা, রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবীদের এ বিষয়ে আরো গুরুত্ব দেয়া এবং কারাগারে সংশোধনাগারের ব্যবস্থা করতে হবে। তিনি আরো বলেন, কারাগারে যে ব্যবস্থায় জঙ্গিদের রাখা হয়, সেখানে তাদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নতুন জঙ্গি তৈরি হওয়া সম্ভব। যেহেতু জঙ্গি কার্যক্রম পরিচালনায় হাতেগোনা কয়েকজনই যথেষ্ট, সেহেতু কারাগারে বন্দি জঙ্গিরাই বড় হুমকি হয়ে দাঁড়াবে।

 

সিটিটিসির প্রধান ও অতিরিক্ত কমিশনার আসাদুজ্জামান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে গ্রেপ্তার বেশ কয়েকজন জঙ্গির কাছ থেকে তথ্য পাওয়া গেছে তারা কারাগারে থাকা শীর্ষনেতাদের কাছ থেকে নির্দেশনা পেত। আবার অনেকে কারাগার থেকে জামিনে বের হয়ে নাশকতায় অংশও নিয়েছে। এটিকে আমরা বড় ধরনের হুমকি মনে করছি না। তবে কারাগারে থেকে যাতে কোনো জঙ্গি তথ্য আদানপ্রদান করতে না পারে, সেদিকে আমাদের নজরদারি রয়েছে।

 

সিনিয়র জেল সুপার বদলি : কাশিমপুর হাইসিকিউরিটি কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার মো. আব্দুল আজিজকে রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার এবং রাজশাহী কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার সুব্রত কুমার বালাকে হাইসিকিউরিটি কেন্দ্রীয় কারাগারের সিনিয়র জেল সুপার হিসেবে বদলি করা হয়েছে। মনে করা হচ্ছে, সাম্প্রতিক এ ঘটনায় অনেকটা তোপের মুখেই তাকে বদলি করা হলো।

 

ভোরের আকাশ/নি 

মন্তব্য

Beta version