এম বদি-উজ-জামান: গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলী মো. শামীম আখতারের বিরুদ্ধে ব্যাপক দুর্নীতি ও অনিয়মের অভিযোগ তদন্তের নির্দেশ দিয়েছে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়। একইসঙ্গে তদন্ত রিপোর্টের ভিত্তিতে এ বিষয়ে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিয়ে তা প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়কে জানাতে নির্দেশ দেয়া হয়েছে। গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের সচিবের প্রতি এ নির্দেশ দেয়া হয়েছে।
প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের পরিচালক-৩ আব্দুল্লাহ আল খায়রুমের স্বাক্ষরে গত ১৯ ডিসেম্বর এ নির্দেশনা দেয়া হয়েছে। শামীম আখতারের বিরুদ্ধে অভিযোগ, তিনি যোগ্যতা, দক্ষতা ও স্বচ্ছতার চেয়ে বেশি প্রাধান্য দেন নিজের লোকদের। তিনি মুরিদদের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দেন। সুযোগ দেন অনিয়ম-দুর্নীতির।
শামীম আখতারের বিরুদ্ধে সম্প্রতি প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় এবং গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে ১০ পাতার অভিযোগ দেয়া হয়। এতে দেশের বিভিন্ন এলাকায় গণপূর্তের কাজে অনিয়ম ও দুর্নীতিতে জড়িত শামীম আখতারের অনুসারীরা। শামীম আখতারের বিরুদ্ধে গণপূর্ত অধিদপ্তরের কাজ কমিশনের মাধ্যমে পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ রয়েছে। এমনকি নিয়োগ-বাণিজ্যের অভিযোগও রয়েছে তার বিরুদ্ধে। এ অভিযোগনামা পাওয়ার পরই প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় তা তদন্তের নির্দেশ দিল।
শামীম আখতার নারায়ণগঞ্জের ভুঁইগড়ের হাকিমাবাদ খানকা-ই-মোজাদ্দেদিয়ার ‘পীর সাহেব’। পীর হিসেবে তার নাম আল্লামা হজরত মোহাম্মদ শামীম আখতার (মাদ্দাজিল্লুহুল আলিয়াহ)। কম্বোডিয়াসহ বাংলাদেশের কয়েকটি স্থানেও রয়েছে এ খানকার শাখা। পীরের মুরিদরা গণপূর্ত অধিদপ্তরের তালিকাভুক্ত ঠিকাদার। বাস্তবায়ন করছেন মোটা অঙ্কের উন্নয়নকাজ। নিয়মের ব্যত্যয় ঘটিয়ে গণপূর্ত অধিদপ্তরসহ গৃহায়ন ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন সংস্থা থেকে সুযোগ-সুবিধাও আদায় করে নিচ্ছেন।
শামীম আখতার ২০২০ সালের ডিসেম্বরে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর চেয়ারে বসার আগে হাউজিং অ্যান্ড বিল্ডিং রিসার্চ ইনস্টিটিউটের (এইচবিআরআই) মহাপরিচালক ছিলেন। সেখানে প্রকল্প পাস না করে টেন্ডার হওয়ার আগে কোটি কোটি টাকার উন্নয়নকাজ মুরিদ ঠিকাদারদের পাইয়ে দেয়ার অভিযোগ ওঠে। মাসে লাখ টাকা বেতনে প্রকল্পের পরামর্শক, কর্মকর্তা-প্রকৌশলী থেকে বাবুর্চি-মালির মতো পদগুলোয় তাদের নিয়োগ দেয়া হয়। মুরিদদের এসব সুবিধা দেয়ার অভিযোগ ওঠার পর এইচবিআরআই তদন্ত কমিটি গঠন করে।
এ তদন্ত কমিটি মুরিদদের ঠিকাদারিসহ নানা সুযোগ-সুবিধা প্রদানসহ আর্থিক ও প্রশাসনিক অনিয়মের প্রমাণ পায়। সুনির্দিষ্ট ১১টি অভিযোগসংবলিত এইচবিআরআইয়ের এ তদন্ত প্রতিবেদন প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয় ও গণপূর্ত মন্ত্রণালয়ে জমা পড়ে। জানা যায়, এইচবিআরআইতে যেসব মুরিদ নিয়মবহিভর্‚তভাবে সুবিধা পেয়েছেন, তারা এখন গণপূর্ত অধিদপ্তরে সক্রিয়। শামীম আখতার গণপূর্তের শীর্ষ পদে বসার পর গণপূর্ত প্রশিক্ষণ একাডেমি, একটি পূর্ত ভবনের উন্নয়ন, প্রধান প্রকৌশলীর বাসভবন সংস্কারসহ একাধিক প্রকল্পের কাজ পেতে শুরু করেন মুরিদরা।
এরই মধ্যে তারা জায়গা করে নিয়েছেন গণপূর্ত অধিদপ্তর ঠিকাদার সমিতিতে। অভিযোগ রয়েছে, খানকার মুরিদদের নিয়ে একটি সিন্ডিকেট গড়ে তুলেছেন শামীম আখতার। সিন্ডিকেটের নিয়ন্ত্রণে অধিদপ্তরের কোটি কোটি টাকার ঠিকাদারি কাজ। ঠিকাদারির পাশাপাশি নিয়ম ভেঙে মুরিদদের নানা সুযোগ-সুবিধাও দিচ্ছেন গণপূর্তের প্রধান প্রকৌশলী।
এইচবিআরআইয়ে যেসব দুর্নীতি ও অনিয়মে যুক্ত ছিলেন শামীম আখতার : ২০১৯ সালের এপ্রিলে ‘নন-ফায়ার ব্রিক প্লান্ট’ নির্মাণের জন্য ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান কিংডম বিল্ডার্সের সঙ্গে চুক্তি করে এইচবিআরআই। আইনানুযায়ী, ১০ থেকে ৫০ কোটি টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ প্রকল্পের জন্য পরিকল্পনা মন্ত্রণালয়ের অনুমোদন নিতে হয়। এক্ষেত্রে তা করা হয়নি। এমনকি এ ধরনের প্রকল্প বাস্তবায়নে এইচবিআরআইয়ের বাজেটও নেই।
তারপরও ‘নন-ফায়ার ব্রিক প্লান্ট’ নির্মাণের প্রায় ১৪ কোটি টাকার কাজ কিংডম বিল্ডার্সকে দেন সংস্থাটির তৎকালীন মহাপরিচালক, যার কাজ এখনো শুরু হয়নি। কিংডম বিল্ডার্সের ব্যবস্থাপনা পরিচালক মোহাম্মদ নুসরত হোসেনকে পীর সাহেবের ঘনিষ্ঠ মুরিদ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে এইচবিআরআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে। কিংডম বিল্ডার্স, কিংডম হাউজিং, কিংডম কনস্ট্রাকশনসহ একাধিক প্রতিষ্ঠানের কর্ণধার নুসরত হোসেন।
২০১৮-১৯ অর্থবছরে এইচবিআরআইয়ের গবেষণা খাতে ২ কোটি ৮০ লাখ টাকা বরাদ্দ ছিল। গবেষণা খাতের এ টাকা থেকে ১ কোটি ১১ লাখ টাকায় ‘অটোমেটিক বøক মেকিং প্লান্ট’ স্থাপন করা হয়। এ কাজও পায় কিংডম বিল্ডার্স। ঠিকাদারকে সব বিল প্রদান করা হলেও প্লান্টটির কাজ অসমাপ্ত রয়েছে। এ ধরনের কাজ বাস্তবায়নের ক্ষেত্রে সংস্থার অভিজ্ঞ ব্যক্তি বা প্রকৌশলীদের নিয়ে কমিটি গঠনের নিয়ম থাকলেও সে ধরনের কোনো কমিটিই হয়নি।
অন্যদিকে একই প্লান্টের শেড নির্মাণের জন্য ৭০ লাখ টাকার কাজে কোনো ধরনের চুক্তি ছাড়াই কিংডম বিল্ডার্সকে নিযুক্ত করা হয়। অর্ধকোটি টাকায় একই কাজ আরেক ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠান অর্থি এন্টারপ্রাইজকে দেয়া হয়, যার মালিক আল আমীনকেও পীর সাহেবের মুরিদ হিসেবে চিহ্নিত করা হয়েছে এইচবিআরআইয়ের তদন্ত প্রতিবেদনে। দৈনিক ২০ ঘনমিটার বøক উৎপাদন শুরু করার লক্ষ্যে ‘এসিসি প্লান্ট’ উন্নয়নকাজে ২০১৯ সালে ব্যয় হয়েছে প্রায় ২ কোটি টাকা। কাজটি করে কিংডম বিল্ডার্স, অর্থি এন্টারপ্রাইজ ও জামান বিল্ডার্স। ঠিকাদারদের সিংহভাগ বিল দেয়া হলেও এখনো চালু হয়নি প্লান্টটি, উল্টো কাজ শেষ করতে আরো সাড়ে ৩ কোটি টাকা প্রয়োজন বলে জানিয়েছে তারা।
একই সময়ে প্রায় ১ কোটি টাকায় এইচবিআরআইয়ে বিদ্যুৎ উপকেন্দ্র নির্মাণকাজ পায় কিংডম বিল্ডার্স। চুক্তির চেয়ে ঠিকাদারদের ৮ লাখ টাকা বেশি বিল দেয়া হলেও কাজটি থেকে গেছে অসমাপ্ত। অন্যদিকে দরপত্রের আগেই অফিস সংস্কারের কাজ শুরু করে দেয় অর্থি এন্টারপ্রাইজ। তার আরেক ঘনিষ্ঠ মুরিদ মোহাম্মদ ইয়ামীন। ক্যামিকন গ্রুপ নামের একটি কেমিক্যাল সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠানের মালিক তিনি। এইচবিআরআইয়ে প্রতি মাসে ১ লাখ টাকা বেতনে ইয়ামীনকে স্যান্ড সিমেন্ট বøক তৈরির কাজে পরামর্শক হিসেবে নিয়োগ দেন শামীম আখতার।
কোনো টেন্ডার ছাড়াই আড়াই কোটি টাকার কাজ দেন ইয়ামীনকে। নিযুক্ত করেন গবেষণার কাজে। এইচবিআরআইয়ের টাকায় গবেষণা করে উৎপাদন করা কেমিক্যাল এইচবিআরআইয়ের কাছেই বিক্রি করেছেন ইয়ামীন। নিয়মবহিভর্‚তভাবে ঠিকাদারি কাজ পাওয়া ছাড়াও রিসার্চ আর্কিটেক্ট, সিনিয়র ড্রাফটসম্যান, সহকারী মেকানিক, পেইন্টার, বাবুর্চি, মালিসহ বিভিন্ন পদে নিয়োগ পেয়েছেন মুরিদরা।
মোহাম্মদ শামীম আখতারের জন্ম রাজশাহীর বাঘা উপজেলায়। রাজশাহী ক্যাডেট কলেজ ও বাংলাদেশ প্রকৌশল বিশ^বিদ্যালয় (বুয়েট) থেকে পাস করার পর বিসিএস-১৫ ব্যাচে উপবিভাগীয় প্রকৌশলী হিসেবে যোগদান করেন গণপূর্ত অধিদপ্তরে। ২০১৮ সালে এইচবিআরআইয়ের মহাপরিচালকের দায়িত্ব পান। আর ২০২০ সালের ডিসেম্বর থেকে গণপূর্ত অধিদপ্তরের প্রধান প্রকৌশলীর দায়িত্বে আছেন তিনি। জানা যায়, হাকিমাবাদ খানকার প্রতিষ্ঠাতা শায়েখ মোহাম্মদ মামুনুর রশীদ।
নারায়ণগঞ্জের ফতুল্লার ভুঁইগড়ে জমি কিনে প্রতিষ্ঠা করেন খানকা। ২০০১ সালে তিনি হিজরত করার উদ্দেশে কম্বোডিয়া যান। সেখানে জমি কিনে খোলেন খানকার একটি শাখা। কম্বোডিয়ার এ শাখা ছাড়াও বাংলাদেশেও হাকিমাবাদ খানকার একাধিক শাখা রয়েছে। মামুনুর রশীদের একমাত্র মেয়ের নাম আরজুমান্দ বানু। এ আরজুমান্দ বানুর স্বামী হলেন শামীম আখতার। ২০১৬ সালে মামুনুর রশীদের মৃত্যুর পর খানকার পীরের দায়িত্ব নিয়েছেন তিনি।
ভোরের আকাশ/নি
মন্তব্য